Home » , , » মহাস্থানগড় রাতের আঁধারে তছনছ

মহাস্থানগড় রাতের আঁধারে তছনছ

Written By Unknown on Thursday, February 10, 2011 | 2:26 AM

য়েক দফায় আদালত নিষেধাজ্ঞা দিলেও বগুড়ার মহাস্থানগড়ে খননকাজ বন্ধ হয়নি। পুরাকীর্তি ধ্বংসও চলছে অবিরত। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের চোখ ফাঁকি দিতে এখন রাতের আঁধারে সেখানে কাজ চলছে। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাতে মহাস্থানগড়ের মূল মাজার এলাকায় উঁচু স্থানের ওপর ১৪০০ থেকে ১৫০০ শতাব্দীর পুরনো পুণ্ড্র গেট 'পুণ্ড্র নগরীর প্রবেশদ্বার' এলাকায় ব্যাপক খোঁড়াখুঁড়ি করা হয়।

রাতে শ্রমিক লাগিয়ে মাজার উন্নয়ন কমিটির পক্ষে এই খননকাজ চালানো হয়। খননের সময় সেখানে অমূল্য ব্ল্যাক স্টোন, প্রাচীন ইট, টেরাকোটা, মূর্তির ভাঙা অংশ বেরিয়ে এলে সেগুলো পাশেই একটি স্থানে মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়। গতকাল বুধবার প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কর্মকর্তারা মাটি খুঁড়ে নিদর্শনগুলো উদ্ধার করেন। তাঁরা জানান, রাত ১২টার পর শ্রমিক লাগিয়ে এই ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে। মূল মসজিদ থেকে ১৫ ফুট দূরের এই অংশটি নামাজের স্থান হিসেবে গড়ে তুলতে সেখানে খননকাজ করা হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে। অথচ ঐতিহাসিক এই স্থানটিতে সব ধরনের খননকাজ বন্ধ এবং ওই স্থানটি সংরক্ষণের জন্য হাইকোর্ট থেকে দুই দফা নির্দেশনা এসেছে।
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সাইট পরিচালক রেজাউল করিম জানান, তিনি মাজার এলাকার দায়িত্বে রয়েছেন। সেখানে এর আগেও অন্ধকারে খননকাজ হওয়ায় প্রতিদিন রাত ১২টা পর্যন্ত তাঁকে ডিউটি করতে হয়। মঙ্গলবারও রাত ১২টা পর্যন্ত তিনি ডিউটি করেছেন। তখন সেখানে কোনো শ্রমিক ছিল না। তিনি চলে যাওয়ার পর গভীর রাতে শ্রমিকরা কাজ করে। কারণ সকালে এসে তিনি পুণ্ড্র গেটসংলগ্ন স্থানে বালি বিছানো দেখতে পান। পরে আশপাশের লোকজনকে (যাঁরা রাতে অবস্থান করেন) জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন, সেখানে রাতে শ্রমিকরা খনন কাজ করেছে।
মহাস্থান জাদুঘরের কাস্টডিয়ান (জিম্মাদার) নাহিদ সুলতানা কালের কণ্ঠকে জানান, অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, যারা খনন কাজ করেছে তারা প্রথমে চিন্তা করেনি সেখানে প্রাচীন পুরাকীর্তি থাকতে পারে। পুরনো নিদর্শন বের হয়ে আসতেই সেগুলো রাতেই সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়। আগে খনন করা একটি গর্তের মধ্যে নিদর্শনগুলো মাটি চাপা দেয় তারা। গতকাল সকালে নতুন মাটি দেখে সন্দেহ হলে তারা মাটি সরিয়ে ব্ল্যাক স্টোন, প্রাচীন ইট, টেরাকোটা ও মূর্তির ভাঙা অংশ উদ্ধার করেন। এ ঘটনার পর থেকে মহাস্থান মাজার উন্নয়ন কমিটির নেতারা গা-ঢাকা দিয়েছেন। এ ছাড়া ঘটনাটি প্রকাশ না করতে তাঁদের মাঠকর্মীদেরও বিভিন্ন ভাবে হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে। তিনি জানান, বারবার খননের জন্য টার্গেট করা স্থানটির নিচেই লুকিয়ে আছে পুণ্ড্র নগরীর গুরুত্বপূর্ণ কোনো ভবন। কারণ মূল মাজার ও মসজিদসংলগ্ন টিলার মতো উঁচু জমিটি মূল পুণ্ড্র নগরীর অংশ। এখানেই থাকতেন রাজা এবং তাঁর লোকজন। ফলে রাজপ্রাসাদ ও প্রশাসনিক ভবন এখানেই থাকার কথা। তবে জমিটি মাজার কমিটির হলেও এর প্রত্নতাত্তি্বক গুরুত্ব নিশ্চিত করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট বিভাগের। এখানে ইচ্ছে করলেই কেউ খোঁড়াখুঁড়ি কিংবা অবকাঠামো নির্মাণ করতে পারবে না। কিন্তু তাঁদের লোকজনকে ভয়ভীতি দেখিয়ে রাতের আঁধারে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চালানো হচ্ছে। নাহিদ সুলতানা জানান, তিনি ঘটনাটি দেখার পর এ ব্যাপারে শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করেছেন। এ ছাড়া প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের পদস্থ কর্মকর্তাদেরও বিষয়টি জানানো হয়েছে।
গতকাল সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পুণ্ড্র নগরীর একেবারে হার্ডপয়েন্টে হজরত শাহ সুলতান বলখি (রা.)-এর মাজারের পশ্চিম পাশে ২০ ফুট বাই ১০ ফুট এলাকায় খনন কাজ করা হয়। রাতে খনন কাজ প্রত্যক্ষ করেছেন সোলেমান আলী। তাঁর বাড়ি ফরিদপুর জেলায়। তিনি জানান, রাতে শ্রমিকরা যখন কাজ করে তখন তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তখন জেনেছেন, উলি্লখিত স্থানে নামাজের জায়গা করার জন্য টাইলস বসানো হবে। এরপর বেশ কিছু পাথর ও ভাঙা ইটের অংশ সেখান থেকে সরিয়ে ফেলতেও তিনি দেখেছেন। স্থানীয় ভিক্ষুক মোকারম বলেন, 'শুনিচনু এটি বলে আর কাম হবি না। কিন্তুক আত্রে ক্যামা কাম করিচ্ছে। তালে ব্যান কিছু একটা করবি। হামাকেরে একটা থ্যাকার জ্যাগা লাগবি। সেডা করলে ভালোই হলোনি।'
গর্ত খোঁড়ার কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের একজনের সঙ্গে কথা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সে জানায়, রাতে সেসহ ১০ শ্রমিক কাজ করে। মজুরি নিয়েছে ২০০ টাকা করে। সে আরো জানায়, তাদের কাছে মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা আড়াই হাজার বছর আগের নিদর্শনের কোনো দাম নেই। এ কারণে তারা ভেঙে ফেলছে অবলীলায়।
মহাস্থান মাজার উন্নয়ন কমিটির সদস্য সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ জানান, তাঁরা আদালতের নিষেধাজ্ঞা পেয়েছেন। কাজেই সেখানে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চালানোর প্রশ্নই ওঠে না। বাইরের কেউ এই কাজ করতে পারে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে জিন্নাহ জানান, বিষয়টি সম্পর্কে তাঁর জানা নেই। কাজেই এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারছেন না। তবে উলি্লখিত স্থানটিতে তাঁরা বালি ফেলে রেখেছিলেন মসজিদের ভেতরে কাজ করার জন্য বলে তিনি স্বীকার করেন। মহাস্থান মাজার কমিটির সভাপতি বগুড়ার জেলা প্রশাসক ইফতেখারুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে জানান, তিনি বিষয়টি জানেন না। কারা খুঁড়ল, এটা খুঁজে বের করতে শিবগঞ্জ থানার ওসিকে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান।
উল্লেখ্য, এর আগেও কয়েক দফা মহাস্থানগড় এলাকায় খনন করে পুরাকীর্তি ধ্বংস করার কয়েকটি প্রতিবেদন কালের কণ্ঠে প্রকাশ করা হয়। এরপর হাইকোর্টের রায়ে ঐতিহাসিক এই স্থানে নির্মাণ কাজ বন্ধ করাসহ মহাস্থানগড় সংরক্ষণ কমিটি করার নির্দেশ দেওয়া হয়। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি রিট পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়। এর পরও ধ্বংসযজ্ঞ থামেনি। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তথ্য মতে, অতি প্রাচীনকালে বগুড়ার মহাস্থানগড় একটি গুরুত্বপূর্ণ শাসনকেন্দ্র ছিল। এই স্থানটি ধর্ম, শিল্প, সংস্কৃতি ছাড়াও আন্তপ্রাদেশিক বাণিজ্যের একটি প্রধান কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় ১৫ শতক পর্যন্ত এই সমৃদ্ধ নগরী একটি সমৃদ্ধ জনপথ সৃষ্টি করেছিল। বেশ কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত স্থানটি বিখ্যাত মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন এবং অন্যান্য হিন্দু সামন্ত রাজারা প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরে গড়ে ওঠা এই প্রাচীন নগরের ধ্বংসাবশেষই এখন বগুড়া জেলার একটি গৌরবোজ্জ্বল সম্পদ।

0 comments:

Post a Comment

 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. XNews2X - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু