Home » , , » ফরিদপুরে 'সেলিম আল দীন স্মরণোৎসব' by জাহারাবী রিপন

ফরিদপুরে 'সেলিম আল দীন স্মরণোৎসব' by জাহারাবী রিপন

Written By Unknown on Saturday, January 22, 2011 | 1:44 PM

সাংসারিক চলমানতা ও যোগাযোগের নৈয়ায়িক ভেদবুদ্ধির কারণে ভ্রমণের সঙ্গে গতি ও গন্তব্যের যোগ প্রত্যক্ষ করি। যে চলেছে তার গতি আছে তবে গন্তব্যের ঘরে। কিন্তু সেখানে পেঁৗছানোর পরে গতি স্তব্ধ হয় নাকি! ঘরে পেঁৗছালেই গতি শেষ হয়ে যায় না।

সে তখনও অবিরাম চলতে থাকে। তাই তো কবি বলেন_ গতিতে জীবন মম স্থিতিতে মরণ। জঙ্গম জীবনে তবে স্থিতি নেই। ক্ষণিক অবসরে যেটুকু স্থিরতা জ্ঞান করি, তাও প্রাকৃত অর্থে স্থির নয়_ চলছে। তবে কি আমরা জীবন ঘরে বসে অবিরাম চলমানতার ছবি অঙ্কন করে চলেছি? অদৃশ্য তুলি ও ক্যানভাসে মন তবে ছবি অঙ্কন করে। গতি ও গন্তব্যের ঘরে ভ্রমণের ছবি! যার দেখার প্রখর দৃষ্টি_ দেখবে বলে জীবনের চলচ্ছবিতে কিছু ভ্রমণ অভিজ্ঞতার দৃশ্য সংযোজন করছি।

ডিসেম্বরের শুরুকালে শীতের শর্ষে ফুলের ভর দুপুরে প্রান্তর পারায়ে ঢাকা থেকে গেলাম ফরিদপুরে। শুক্রবার_৩ ডিসেম্বর। শীতের কাঁপন লাগা ভোরে গন্তব্য পথে যথারীতি নির্ধারিত বাহনের জন্য ঢাকার টেকনিক্যাল মোড়ে অপেক্ষা করছি। মাথায় শীত সকালের কুয়াশামাখা মস্নান সূর্য ক্রমে কুয়াশা ভেদ করে উত্তাপ ছড়াতে থাকে। ক্রমশ শীত কমে আসে। মোবাইলে রিং বাজলে ধরি। ঢাকার নাট্যসংগঠন 'স্বপ্নদল'-এর প্রধান সম্পাদক জাহিদ রিপনের কণ্ঠ। তিনি প্রায় আহত কণ্ঠে বলেন_গাড়িতে ঝামেলা হয়েছে, আসতে বিলম্ব হতে পারে_ আমরা শ্যমলী আছি, আপনি চলে আসেন। আহ্বানে সাড়া দিতে টেকনিক্যাল থেকে শ্যামলীর উদ্দেশে বাসে উঠি। পেঁৗছে পথে নেমে পকেটে হাত পড়তেই দেখি_ পকেট ফাঁকা। হায়_ কোন্ চোরায় করল রে চুরি! অর্থ পরিমাণে খুব বেশি নয়। কিন্তু মধ্যবিত্তের কষ্টার্জিত অর্থের এই অনাবশ্যক বিয়োগ বেদনা আমাকে আর অন্যদের মতোই ব্যথিত করে তোলে। আহত স্বরে ভ্রমণ সঙ্গীদের অর্থ বিয়োগের ঘটনা বললে তাদের কেউ কেউ ঠাট্টার ছলে যে ভাষায় সান্ত্বনার কথা বলেন তা যেন উজ্জ্বল অনলে ঘৃতাহূতি। আরো দ্বিগুণ বেগে বেদনা জ্বলে উঠে। মধ্যবিত্তের বিড়ম্বনার তো শেষ নেই। কিছুক্ষণ নীরব থাকি।

ভ্রমণে চলেছি_ত্রিশ জনের অধিক ভ্রমণ সঙ্গী। বয়সে সকলে সমান নয়, কিন্তু মনে মনে মিলের কোনো কমতি নেই। আমরা সকলে নাট্যকর্মী_ কেবল বাসের ড্রাইভার ও হেলপার ছাড়া। তবে জীবনমঞ্চে তারাও নিশ্চয় নটের ভূমিকা বহে নিয়ে চলেছে। নারী-পুরুষ মিলে বাহনে বসেছি। আমাদের সঙ্গে বয়োজ্যেষ্ঠ নাট্যব্যক্তিত্ব খায়রুল আলম সবুজও আছেন। তিনি ফরিদপুরের নাট্যোৎসবের একজন আমন্ত্রিত অতিথি। আমন্ত্রিত অতিথি যাত্রাপথের সামনে আরো একজন। আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। তবে তিনি আর কেউ নন_আমাদের প্রিয় 'পারুল ভাবি'। নাট্যগুরু সেলিম আল দীনের সহধর্মিণী বেগমজাদী মেহেরুন্নেসা পারুল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল তোরণে নেমে অপেক্ষমাণ পারুল ভাবিকে গ্রহণ করি। তিনিও সহাস্যে আমাদের বরণ করেন। অতঃপর যাত্রাপথের নির্ধারিত কর্মসূচির অংশে নাট্যগুরু সেলিম আল দীনের সমাধি প্রাঙ্গনে গমন করি। সেখানে কিছুক্ষণ শরণ ও অপেক্ষাতে পুষ্প-কৃতাঞ্জলিতে নীরব অশ্রুপাতের ক্ষরণ অনুভব করি। পাশে পূজ্যপাদ সৈয়দ আলী আহসানসহ আরো কয়েকজনার সমাধি দেখতে পাই। যার সবগুলো বাঁধাইকৃত_ মোড়কে নামের ফলকে আবৃত। কেবল সেলিম আল দীন সমাধি তখনও অপেক্ষমাণ। তবে আশা করছি_ এই সমাধিও মোড়কে ও নামের ফলকে অচিরেই শোভাময় হয়ে উঠবে নিশ্চয়। বিশ্ববিদ্যালয় কতর্ৃপক্ষ ও সেলিম অনুরাগীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

পুষ্পাঞ্জলি পর্ব অন্তে আবারও যাত্রা শুরু করি। পথে চলতে চলতে সেলিম আর দীন কৃত আর স্বপ্নদলের প্রযোজনায় মঞ্চে নিয়মিত 'হরগজ' নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র আবিদের কথা মনে পড়ে। কিন্তু সে ভাবনাতেও আছে বিপত্তি_ আমার পাশের আসনে বসা প্রযোজনায় আবিদের চরিত্রে রূপদানকারী জাহিদ রিপন। অবিদের কথা মনে করার সুযোগ কোথায়? তবুও যাত্রাপথের গতির সঙ্গে সে মহৎ নাটকের অভিগমনকে সাযুজ্য জ্ঞান করি। 'হরগজ' নাটকে আবিদ ত্রাণের উদ্দেশে আর্ত মানবের সেবায় ছুটে চলে গ্রামের মাঠ, প্রান্তর ও শস্যক্ষেত্র দৃষ্টির অমৃত কুম্ভে ভরে নিয়ে। তার গমনের উদ্দেশ্য মহৎ_ মানবতার সেবা ভিন্ন আর কিছু নয়। আমরাও চলেছি_ আবিদের মতো নয়। আবার আবিদের মতোও বটে! গতির বৈচিত্র্যে চিহ্নরেখার বন্ধনে ঘাট ভিন্নতর হলেও গন্তব্য হয়তো অভিন্ন। আমাদের উদ্দেশ্যও সেবা_ শিল্পের সেবা। সে অতি মহৎ কাজ কিনা জানি না_ তবে মানবের মনে ক্ষণিক আনন্দের অবসরে নবতর চেতনার স্ফূরণে তাকে জাগিয়ে তোলে। জানি এ কাজ সহজ নয়। তবুও ফরিদপুরে 'বৈশাখী নাট্যগোষ্ঠী'-র 'বিজন ভট্টাচার্য পথ নাট্যমেলা- ২০১০'-এর শেষ দিনে উৎসবে যোগ দিতেই আমাদের এই নির্ধারিত যাত্রা। উদ্দেশ্য আরো আছে। শোনার আগ্রহে জমিয়ে রাখছি।

যাত্রাপথের উপান্তে এসে পদ্মার সাক্ষাৎ মিলে। হায়রে প্রমত্তা পদ্মা! ভয়ঙ্কর বিস্তার ও খরতর প্রবাহের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। শীর্ণ-বিশীর্ণ মৃতপ্রায় নদী। এই নদীর সঙ্গে মানব জীবনের খানিক মিলও আছে বটে। ভর যৌবনে দেখা নদী আর জীবন সায়াহ্নে দেখা নদীতে এই বুঝি পার্থক্য। গাঙের জোয়ার অপসৃত হলে ভাটার টানে জীবন ও নদীর বাঁক ঐক্য সূত্রে বন্ধনের কথা মনে করিয়ে দেয়। এখনও যৌবনের চোখে দেখছি নদী। দেখে মনে হয় একদিন আমাদের যৌবনও ভাটার টানে এই মৃতকায় নদীর রূপ পাবে নিশ্চয়। দেহমনের উত্তাপ একদিন একদিন কমে যাবে। মনের ফুটন্ত বালিতে তখন স্বপ্ন-বুননের খই আর ফুটবে কি? কোন মরা গাঙের স্রোতে কোন অদৃশ্য অদেখা পুরীতে পেঁৗছে যাবে এই শিল্পীমন! কে জানে?

সে যাই হোক। পদ্মাপারের অনতিদূরেই ফরিদপুর শহর। নদী পারাপারের পরে গতিপথে বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। বাহন বাসটি চলছে। চলছি আমরাও। কিন্তু সে চলনে ভেদ আছে। আমরা সচল বাসের সঙ্গে। আর বাসটি সচল গতি ও পথের পরিক্রমণে গন্তব্যের ঘরে। চলতি পথের মাঠ, প্রান্তর, শীতের শর্ষে ফুলের হলুদ আভা, বিকেলের সোনা রোদে দেখা নানা দৃশ্যমালা মন ভুলিয়ে দেবার মতো আবহ সৃজন করে। তবু মনে কখনও কখনও পথের শুরুতে আকস্মিক অর্থ হারানোর বেদনা মনের ক্ষতে কাঁটার মতো বিঁধতে থাকে। কিন্তু ফরিদপুর শহরে পেঁৗছে আমাদের গন্তব্য কবি জসীমউদ্দীন হল প্রাঙ্গণে বাস থেকে নামতে গিয়ে নাট্যকর্মীদের শ্রীহস্ত থেকে রজনীগন্ধা ফুলের যে অভ্যর্থনা পেলাম তা যেন জগৎ সংসারের সকল দুঃখ-বেদনা ভুলিয়ে দেবার মতো মতো ঘটনা। পথের শ্রান্তি ও বেদনার বিবরে তখন আনন্দ আর প্রশান্তির অদৃশ্য প্রবাহ চলতে শুরু করেছে।

কবি জসীমউদ্দীন হল চত্তরে এসে মনটা ভরে যায়। সেখানে ফরিদপুরের নানান দলের নাট্যকর্মীরা মিলে দেয়ালে পোস্টারে ঢাকার নাট্যদল স্বপ্নদলকে উদ্দেশ ও উপলক্ষ করে কিছু প্রশস্তি কথা ও নিবেদন বাণীতে যে দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছে তা একেবারেই অভিনব। আমার মধ্য জীবনের অভিজ্ঞতাতে তো বটেই। মনে থাকবে অনেক দিন।

অতঃপর একটু দূরে রাত্রি যাপনের জায়গায় গমন করি। সেখানের পথে পথে ও তোরণে নাট্যকার সেলিম আল দীনের ছবি সম্বলিত লেখা_ 'স্মরণে নাট্যভাষে নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন'। যথার্থ এই বাক্য নির্মাণ_যেন কোনো ঘোষণার গতি বিলোপন করে মনে। আর সেজন্যই তো আমাদের ফরিদপুরে আসা। সেখানে বিকেলের বিশ্রাম অন্তে উত্তীর্ণ সন্ধ্যায় বৈশাখী নাট্যগোষ্ঠীর পথ নাট্যমেলায় যোগ দিতে গমন করি অম্বিকা ময়দানে।

অম্বিকা ময়দান_এক বিখ্যাত ব্যক্তির নামের সঙ্গে অন্বিত। ফরিদপুরের কৃতি সন্তান বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবক অম্বিকাচরণ মজুমদারকে স্মরণ করেই ফরিদপুরবাসীর এই নামকরণ। সার্থক নামকরণ বটে। সামন্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও যিনি মানবতার সেবায় নিজেকে নিবেদন করেন_তিনি মহৎ বলতে হবে। অম্বিকাচরণ মজুমদার মানবসমাজের এমনই একজন।

জাহিদ রিপনের নেতৃত্বে অম্বিকা ময়দানের মেলায় প্রবেশ মাত্র আয়োজন যা দেখলাম তাতে চক্ষু একেবারে চড়ক গাছ! এক অবিশ্বাস্য আয়োজনে। মেলার প্রবেশ মুখে নাট্যমেলার নামকরণ বৈদু্যতিক আলোকের ঝলকে জ্বলছে। ভেতরে একদিকে মঞ্চ_ তার বিপরীতে থৈ থৈ দর্শক নাটক দেখছেন। আর ময়দানের তিন দিকে পোস্টার প্রদর্শনীর এক বিশাল আয়োজন। শুধু আয়োজন নয়_ আয়োজন যজ্ঞ বলতে হবে। সে যজ্ঞে শোভিত পোস্টার প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের নাট্যপ্রযোজনার গুরুত্বপূর্ণ সকল পোস্টার ও নাট্যকারদের ছবি, বিশ্ব নাট্যপ্রযোজনার উলেস্নখযোগ্য পোস্টার ও খ্যাতিমান নাট্যকারদের ছবির সঙ্গে ঢাকার স্বপ্নদল ও ফরিদপুরের বৈশাখী নাট্য গোষ্ঠীর উলেস্নখযোগ্য প্রযোজনা ও কর্মকৃতির দলিল সমুপস্থিত। পাশ্চাত্যের প্রাচীন গ্রীস থেকে শুরু করে প্রাচ্য-ভারতীয় প্রবীণ নাট্যকারদের সঙ্গে সমকালীন নাট্যকারদের অনেক দূর্লভ ছবি সংগৃহীত হয়েছে নাট্যমেলায়। অনন্যসাধারণ এক শ্রমসাধ্য ঘটনা বলতে হবে। হাজারের অধিক ছবি ও পোস্টারের সংগ্রহের আয়োজন তো কম কথা নয়! বৈশাখী নাট্যগোষ্ঠীর সক্রিয় উদ্যোগের পশ্চাতে সেখানে আরো একজনকে খুঁজে পাই। তিনি সরকারি ইয়াসিন কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ আলতাফ হোসেন। এ বিশাল পোস্টার ও ছবির আয়োজনের নেপথ্যজন অধ্যক্ষ আলতাফ হোসেনকে শরণ্য জ্ঞান করি। এমন নিবেদিতপ্রাণ সংস্কৃতিকর্মী এদেশে সংখ্যায় খুব কমই জন্মেছে।

নাটকের পোস্টার দর্শন শেষে স্বপ্নদলের ডাক পড়ে মঞ্চে। ইতোমধ্যে ঢাকার একটি দল নাটক প্রদর্শন সমাপ্ত করেছে, স্থানীয় আরো নাট্যদল অপেক্ষা করছে। স্বপ্নদল তাদের সর্বশেষ প্রযোজনা 'ফেস্টুনে লেখা স্মৃতি' মঞ্চস্থ করবে। ঘোষণা অন্তে যথারীতি নাটক শুরু হলো। নাট্যকার সেলিম আল দীনের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্মৃতিকথার নাটক। নাট্য প্রদর্শন কালে কোনা এক সময় মঞ্চে গান ও কোরিওগ্রাফির সঙ্গে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ালেন নাট্যকর্মীরা। মঞ্চে তখন গানে ও পতাকার আবহে বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধ মূর্ত হয়ে উঠেছে। অভিভূত প্রায় হাজার তিনেক দর্শক যেন নিজেদের অজান্তেই প্রবল করতালির মধ্য দিয়ে মঞ্চ ও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠলেন! এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা। শিল্পের শক্তিকে আভূমি প্রণাম করি।

নাটক সমাপনান্তে মঞ্চে ডাক এলো। উপস্থিত হলাম। পারুল ভাবি এলেন। আরো এলেন জাহিদ রিপন। অতঃপর এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। এবার 'স্বপ্নদল' এবং ফরিদপুরে 'সেলিম আল দীন স্মরণোৎসব উদ্যাপন পরিষদ'-এর স্মরণ অনুষ্ঠান আয়োজনের উদ্বোধন ঘোষণার পালা। পারুল ভাবি 'ফেস্টুনে লেখা স্মৃতি' নাট্যপ্রযোজনা ও তদীয় অনুভুতির কথা ব্যক্ত করে স্বপ্নদল ঘোষিত বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বছরব্যাপী সেলিম আল দীন স্মরণোৎসবের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করলেন। ফরিদপুর থেকে শুরু হলো এ অনুষ্ঠান। আবারও প্রবল করতালি। মঞ্চ ও অম্বিকা ময়দান মুখর হয়ে উঠলো। সে এক উলেস্নখযোগ্য সন্ধ্যারাত্রি। অতঃপর 'ফরিদপুর চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি'-র নিমন্ত্রণে অম্বিকা ময়দান থেকে তাদের ভবনে নৈশভোজে গমন। উষ্ণ আতিথেয়েতায় মুগ্ধ হলাম। নাট্যকর্মীদের জন্য অত্যন্ত আন্তরিক ভোজের আয়োজন। খাদ্য তালিকায় অন্যান্য উপকরণের সঙ্গে নদীর বড় পাঙ্গাস ও আইড় মাছ। মাছে ভাতে বাঙালি এই ঐতিহ্য থেকেই এ আয়োজন কিনা জানি না। তবে অনেক দিন পরে টাটকা বড় মাছ সোয়াদ মনে রাখার মতো ঘটনা বটে!

নৈশভোজে অন্তে ঘুমানোর স্থলে ফিরে এলাম। তখনও আরেক আয়োজন। ঘরোয়া পরিবেশে 'হরগজ' নাটকের রিহার্সেল। সেখানে পারুল ভাবি উপস্থিত হয়ে মহড়া উপভোগ করলেন। মধ্যরাত পেরিয়ে গেল। মহড়া অন্তে 'হরগজ' নাটক লেখার সময়কার নানা ঘটনা আর সেলিম আল দীনের রসবোধ নিয়ে দারুণ আড্ডা শেষে পারুল ভাবি ঘুমাতে গেলেন। সারা দিনের ক্লান্তি তখনও নাট্যকর্মীদের কাবু করতে পারেনি। নাট্যকর্মী দম্পতি লাবণী-পিন্জু দুজনে আমার দুই হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন দালানের ছাদে ক্যাম্প ফায়ার শুরু করতে। সেখানেও সবাই আছেন। অবশেষে মধ্যরাতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে শীতে অগি্নর খানিক উত্তাপ ও আনন্দ নিয়ে ঘুমালাম।

পরদিন ভোরে উঠেই পূর্ব সূচি অনুযায়ী যেখানে নিয়ে যাওয়া হলো আমাদের তা দেখে আমি অভিভূত। ফরিদপুরের 'জগবন্ধু আশ্রম'। প্রাকৃতিক সজ্জা ও আবহে অভিরাম পরিবেশ। দেখে মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায়। শুনলাম এই আশ্রমে বিগত ৫০ বছরে কখনও গান থামেনি। গানের একদল আসে, গান গায় চলে যায়। আবার আরেক দল। চলছে। সেখানে আশ্রমের বিরাট আয়োজন। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে মানুষ আসে_ অতিথি হয়ে এই আশ্রমে। রাত্রি যাপন করে চলে যায়। এখানের সকল অর্থভার বহন করছেন ফরিদপুরের কয়েক সমাজ হিতৈষী ব্যক্তি। ভাবতে ভালোই লাগে।

আশ্রম দর্শন অন্তে গেলাম কবি জসীমউদ্দীনের গ্রামের বাড়ি। পাশে কুমার নদী। শীর্ণকায়_ ওপাশের বালুচর দেখা যায়। আর এপাশে কবির পৈতৃক বাড়ি। দাদি, নানা পরিজন ও কবির কবর। কবির বিখ্যাত 'কবর' কবিতার ডালিম গাছও বর্তমান। আরো দেখলাম কবির মিউজিয়াম ও তদীয় নানা নিদর্শন। সেখানে বৃক্ষতলে সঙ্গীতের আয়োজন হলো। সেও এক সুখস্মৃতি।

অতঃপর নাটকের মহড়া, বিশ্রাম ও বিকেলে পর পর দু'টি প্রদর্শনী। কবি জসীমউদ্দীন মঞ্চে। 'হরগজ' নাটকের। নাটকের প্রারম্ভে সেলিম আল দীন স্মরণোৎসবকে উপলক্ষ করে কবি জসীমউদ্দীন হল চত্তরে সেলিম আল দীনকে উৎসর্গীকৃত স্বপ্নদলের সঙ্গীত-কোরিওগ্রাফির অভিনব পরিবেশনা সমবেত দর্শককে মুগ্ধ করে। তারপর 'হরগজ' নাটকের মঞ্চায়ন। হল ভর্তি দর্শক প্রযোজনাটি উপভোগ করলেন। নাটক শেষে যিনি মঞ্চে গেলেন তিনি অধ্যক্ষ আলতাফ হোসেন। মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে কাঁদছেন। কেন? 'হরগজ' নাটকে বিধৃত ঘটনার উপস্থাপনা দেখে। তিনি বলেন_ শিল্প এতটাই মর্মস্পশর্ী ও সুন্দর হতে পারে। আমরা জানা ছিল না। কান্নার ইতিহাস আরো আছে_ ফরিদপুর সুনিয়ম নাট্যচক্রের আমিনুর রহমান ফরিদ মঞ্চে এসে কাঁদছেন জাহিদ রিপনকে জড়িয়ে ধরে। শিষ্যের শিল্পদর্শনের সার্থকতায় গুরুর এই আনন্দাশ্রুর তুলনীয় দৃশ্য সমগ্র বিশ্বে দুর্লভ নিঃসন্দেহে! ভালো করে তাকাতেই অনুভব করা গেল হল ভর্তি দর্শকও চক্ষু মুছছেন। ধন্য হে সেলিম আল দীন_ ধন্য স্বপ্নদল!

সে উৎসবের আরো অনেক স্মৃতি_ অনেক কথা। সব তো একদিনে বলা সম্ভব নয়। সুন্দর ও সফল স্মরণোৎসব আয়োজনের জন্য ফরিদপুরের নাট্যকর্মী ও সংশিস্নষ্ট সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। তাঁদের আতিথ্য ও সে উৎসবের অভিজ্ঞতা কখনই তো ভুলবার নয়।

0 comments:

Post a Comment

 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. XNews2X - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু