Home » , , » মুহুর্মুহু স্লোগান ওঠে 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' by হালিমা খাতুন

মুহুর্মুহু স্লোগান ওঠে 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' by হালিমা খাতুন

Written By Unknown on Sunday, February 6, 2011 | 6:10 AM

মার জন্ম ১৯৩৩ সালে তৎকালীন খুলনা জেলার বাগেরহাটের বাদেকাড়া পাড়ায়। বাবা মৌলভি আবদুর রহিম ছিলেন কূপমণ্ডূকতা-বিরোধী মানুষ। এ জন্য তাঁকে একঘরে করে রাখা হয়েছিল। এমন সব বৈরিতার ভেতরেই গ্রামে আমার বেড়ে ওঠা। স্কুলজীবন থেকেই আমার মনে এক ধরনের স্বাধিকার বোধ কাজ করত।
কলেজে গিয়ে শিক্ষকদের আদর্শে আরো অনুপ্রাণিত হই। খুলনার বাগেরহাট কলেজে পড়াকালীন কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকায় ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতির কথা জানতে পারি। সিদ্ধান্ত নিই ভাষা আন্দোলনে একাÍ হওয়ার। এরপর ১৯৫১ সালে ২১ বছর বয়েসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হই।
তখন ‘উইম্যান স্টুডেন্ট রেসিডেন্টস’ (ডাব্লিওএসআর) হলে থাকতাম। বর্তমান রোকেয়া হল। পুরো হলে আমরা মাত্র ৩০ জন ছাত্রী। পুরো বিশ্ববিদ্যালয়েই মেয়ের সংখ্যা ছিল ৪০ থেকে ৫০ জন। ভাষা আন্দোলনে প্রথম সুফিয়া খান, রোকেয়া খাতুন এবং বন্ধু আবদুর রাজ্জাকের হাত ধরে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হই। আমি ক্লাস করে বেরুচ্ছিলাম। রাজ্জাক জানাল, আমাদের এখন ‘হুইসপারিং ক্যাম্পেইন’ করা দরকার। অর্থাৎ কানে কানে সবাইকে জানাতে হবে, ‘ভাষা আন্দোলনে শামিল হও’। রাজ্জাক পরে সুইডেনের রাষ্ট্রদূত হয়েছিল।
তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক কালা-কানুন। ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদের কথা বলা মানা। আমরা মেয়েরা কমনরুমে বসে থাকতাম। টিচাররা এসে আমাদের ক্লাসে নিয়ে যেতেন। আমরা সামনের বেঞ্চে বসতাম। ক্লাস শেষে আবার পৌঁছে দিতেন। হলে কিংবা ডিপার্টমেন্টে কারো সঙ্গে কথা বলতে হলে প্রক্টরের অনুমতি নিতে হতো। তা সত্ত্বেও আমরা রাজনীতি করতাম। স্থানীয় অভিভাবকের চিঠি নিয়ে রাতে কমিউনিস্ট পার্টির ক্লাস করতাম। মেয়ে হিসেবে এসব কাজ করতাম বলে স্থানীয় লোকজন টিটকারি করত। অসহিষ্ণুতা দেখাত। এসব বিষয়কে পাত্তা দিতাম না। পরে তীব্র আন্দোলনের পর ওই লোকগুলোই উল্টো আপ্যায়ন করিয়েছ। অনেকে আন্দোলনেও যোগ দিয়েছে।
২১ ফেব্রুয়ারির দিনের কথা বলি। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। ১৯৫২ সাল। আমরা সবাই আমতলায় সমবেত হই। আমার ওপর ভার ছিল বাংলাবাজার গার্লস স্কুল ও মুসলিম গার্লস স্কুলের ছাত্রীদের নিয়ে আসার। ওই দুই স্কুলের বেশকিছু ছাত্রীকে আমি সংগঠিত করে সভায় নিয়ে আসি। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রী সংসদের পক্ষ থেকে এসেছিল মিটফোর্ড কলেজের ছাত্রীরা। সভা শুরু হলো। গাজী ভাই (অ্যাডভোকেট গাজীউল হক) সভাপতি। প্রথমে কেউ কেউ ১৪৪ ধারা না ভাঙার পক্ষে বক্তব্য দেন। এর পরপরই প্রচণ্ড প্রতিবাদ হয়। স্লোগান ওঠে, ১৪৪ ধারা ভাঙতেই হবে। স্লোগানে স্লোগানে ক্যাম্পাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। মুহুর্মুহু স্লোগান ওঠে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। চূড়ান্ত হয় ১৪৪ ধারা ভাঙার। সিদ্ধান্ত হয় মেয়েরা আগে বের হবে। চারজনের প্রথম দলটিতে ছিলাম আমি, জুলেখা (পুতুল), নূরী ও সেতারা। পরে আরো চারজনের একটি দল। তৃতীয় দলটির নেতৃত্বে ছিলেন ড. শাফিয়া খাতুন। আমরা প্রথমেই বন্দুকের নলের সামনে দিয়ে বের হয়ে এগোতে থাকি। পুলিশ সম্ভবত ঠিক কী করবে বুঝতে পারছে না। নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে তারা। নির্দেশ পেয়ে আমাদের পরের দুটি দলকেই আটক করে। পরে অবশ্য ছেড়ে দেয়। তারপর শুরু হয় স্বেচ্ছায় গ্রেপ্তারবরণের পালা। বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো ছেলেমেয়েদের দল গেট থেকে বেরিয়ে যেতে থাকে। এদিকে শুরু হয় পুলিশের অবিরাম লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস। চারদিক ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে যায়। ছাত্রছাত্রীরা সব এদিক সেদিক ছুটতে থাকে। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল অ্যাসেম্বলিতে যাওয়া। বর্তমান জগন্নাথ হল ছিল তখন অ্যাসেম্বলি ভবন। তখন পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের খণ্ডযুদ্ধ শুরু হলে আমরা মেডিক্যাল কলেজের ভেতর ঢুকে পড়ি। শুরু হয় প্রচণ্ড গোলাগুলি। স্ট্রেচারে করে আহতদের নিয়ে আসা হচ্ছে মেডিক্যালে। সে কী গগণবিদারি আর্তনাদ! পরে শুনেছি অনেক লাশ পুলিশ নিয়ে গেছে। গোলাগুলি বন্ধ হলে আমরা বাইরে বের হই।
বর্তমান শহীদ মিনারের স্থানটি তখন রক্তে ভাসছিল। একসঙ্গে এত রক্ত কখনো দেখিনি। ছড়িয়ে রয়েছে রক্তে ভেজা জামাকাপড়। একজনের মাথার খুলি উড়ে যায়। থোকা থোকা মাথার মগজ সমস্ত রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে। ছাত্ররা ব্লকে ওই মাথার খুলির ছবি ধারণ করে। ছবিটি রাখা হয় এসএম হলে শাহ এম এস কিবরিয়ার রুমে (প্রয়াত অর্থমন্ত্রী)। কিবরিয়া ছিল আমার ক্লাসফ্রেন্ড। এ ঘটনায় আর্মিরা হল ঘেরাও করে তল্লাশি চালায়। প্রভোস্টের ঘরের সঙ্গেই ছিল কিবরিয়ার রুম। পেছন দিকে বের হওয়া যেত। কিবরিয়ারা পালিয়ে যায়। পালিয়ে যাওয়ার সময় ভেতর দিয়ে দরজা আটকে রাখে। আমার দায়িত্ব ছিল তার ঘর থেকে ওই ব্লকের ছবিটা নিয়ে আসার। প্রভোস্টের সঙ্গে আমার জানাশোনা থাকায় প্রভোস্টের বাড়ির ভেতর দিয়ে পেছন থেকে গোপনে আমি এবং রাবেয়া বেগম কিবরিয়ার রুম থেকে ওই ছবিটা বুকের ভেতর করে নিয়ে আসি মিলিটারির সামনে দিয়ে। সেদিন ধরা পড়লে হয়তো ইতিহাস অন্য রকম হতো। সেদিনের সেই ছবিটা এখনো বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় দেখা যায়।
একুশের যে অর্জন, তা খাতা-কলমে হয়েছে। বাংলা ভাষার উন্নয়ন, ভাষার সত্যিকারের লালন হচ্ছে না। শিক্ষার প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা, প্রতিশ্রুতি ব্যাহত হচ্ছে। মানুষ সত্যিকারের শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সেজন্য ভাষা শিক্ষা এবং মানবিক শিক্ষা কোনোটিই হচ্ছে না। এসব ব্যাহত হচ্ছে বলে মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় হচ্ছে। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃত পেয়েছেÑএটা আমাদের পরম গৌরবের কথা। কিন্তু যে দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, এ গৌরব কত দিন ধরে রাখতে পারব তা নিয়ে শঙ্কা হয়। সেজন্য সবার কাছে অনুরোধÑভাষা, শিক্ষা, মানবতাকে বাঁচানোর জন্য আসুন সংগ্রাম করে যাই। একুশের সংগ্রাম এখনো শেষ হয়ে যায়নি। আমাদের এখনো সংগ্রাম করে যেতে হবে। নিজের ভাষাকে শিখতে হবে। সম্মান করতে হবে। পরিচর্যা করতে হবে। ইদানীং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে দোকানপাটের নামও ইংরেজিতে লেখা হচ্ছে। কেন? বাংলা শব্দের কি আকাল পড়েছে? অন্য ভাষা জাতি শিখবে। কিন্তু তা হবে নিজের ভাষাকে প্রাধান্য দিয়ে। ভাষা তো অস্তিত্বেরই অংশ।
সে সময়ের বেশ কিছু মজার স্মৃতিকথাও মনে পড়ছে। আমি সব সময় সাদা শাড়ি পরতাম এবং সিম্পল থাকতাম। তখন আমার নাম হয়ে যায় ‘হিন্দু বিধবা’। হলে একটিমাত্র মেয়ে বোরকা পরত। আমরা তার নাম দিয়েছি ‘বোরকা শামসুন’ নাহার। তার বাবা স্পিকার ছিলেন। সে সময় আমরা বেশ চাঁদা তুলতাম। বেইলী রোড এলাকা থেকে শুরু করে সব বাড়িতে যেতাম। আমাদের নেত্রী ছিলেন মুনীর চৌধুরীর বোন নাদেরা বেগম। সে সময় আজকের মতো এত বড় রাস্তাঘাট ছিল না, এত কোলাহল ছিল না। গাছপালা ছিল প্রচুর। নিউ মার্কেট, নীলক্ষেত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পুলিশ ফাঁড়ির উল্টোদিকে ধানক্ষেত দেখেছি। ওই সব স্মৃতি বেশ মনে পড়ে।
স্বাধীনতার এত দিন পরে এসে একটি বিষয়ে বেশ কষ্ট পাই। আমাদের মূল্যায়ন হয়নি। ১৯৬১ সাল থেকে দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছি। যদিও মূল্যায়নের জন্য সংগ্রাম করিনি। আমি শিক্ষক পদাতিক সৈনিক। বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করছি বলেই কথাটা বলা। এখন খাদ্যবস্তুর চেয়ে ওষুধ খেতে হয় বেশি। এ দায়িত্বটি অন্তত সরকারের নেওয়া উচিত।
অনুলিখন: শরীফা বুলবুল

0 comments:

Post a Comment

 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. XNews2X - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু