Home » , » মুড়াপাড়ায় একদিন by সালেহ শফিক

মুড়াপাড়ায় একদিন by সালেহ শফিক

Written By Unknown on Sunday, February 6, 2011 | 3:59 PM

যেতে দুই ঘণ্টা লেগে গেল। আমি আর অপু আসলে বেড়াতে বের হইনি। আমরা সূত্রাপুর থানার দুই বাসিন্দা 'এই সেই' নানা কিছু নিয়ে মাথা ঘামাই মাঝেমধ্যে। গত নভেম্বরে ঘামল গার্মেন্টশ্রমিকরা রাস্তায় নেমে এলে। তারা সরকারনির্ধারিত বেতন কাঠামোয় বেতন চায়।

কিন্তু মালিকের তো টাকার মায়া আছে। তাঁকে শালা-শালি নিয়ে সুইজারল্যান্ড যেতে হয়। খোঁজখবর নিয়ে আমরা ভুলতায় রওনা হলাম সায়েদাবাদ থেকে। বাসটা যাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আমরা ভুলতা নেমে পড়ব। সিনহা গ্রুপের টেঙ্টাইল মিল এলাকা দেখতে দেখতে কাঁচপুর ব্রিজ পার হয়ে সিলেট মহাসড়কে উঠি। সড়কের দুই পাশে রিরোলিং মিল, ডাইং ফ্যাক্টরি ছাড়া আর কিছু দেখার নেই। ভুলতায় এসে দেখি বাজারঘাট ঠিকঠাক চলছে, কোথাও কেউ রাস্তা আটকে বসে নেই। আমরা হতাশ হব কি না মনস্থির করতে পারছিলাম না। বাজারে দু-একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি, গতকাল রবিনটেক গার্মেন্ট কর্তৃপক্ষ সপ্তাহখানেক সময় চেয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে বোঝাপড়া করেছে। আজ তাই গণ্ডগোল নেই। কুছ পরোয়া নাই ভাব নিয়ে মুড়াপাড়া চললাম। রিকশাওয়ালা ২০ টাকায় রাজি হয়ে গেল। মুড়াপাড়ার কথা জেনেছিলাম গাইড ট্যুর সূত্রে। আগে তারা শীতলক্ষ্যা নদী ধরে পর্যটকদের মুড়াপাড়া জমিদারবাড়ি নিয়ে আসত। দিনে দিনে বেড়ানোর জন্য ঢাকার কাছে এটি ভালো জায়গা। যেতে যেতে জানতে পারি চালক আসলে রবিনটেকের শ্রমিক। যত দিন গার্মেন্ট বন্ধ থাকবে তত দিন রিকশা চালাবে। অপু জিজ্ঞেস করে, আন্দোলন না করে কি সমস্যা মেটানো যায় না? চালক বলে, 'আমরা কি ইচ্ছা কইরা রাস্তায় নামি ভাই?
: এখন যদি পুরাই বন্ধ হয়ে যায়?
: বড়লোকের ট্যাকার মায়া বেশি। বন্ধ করব না।'
রাস্তার দুই ধারে প্রচুর ঝুট (কাপড়ের বাড়তি অংশ) শুকাতে দেওয়া। এ এলাকায় অনেক প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছে। মুড়াপাড়া এসে আবদুল লতিফ জুট মিলের দরজায় নামি। ভেতরে যেতে চাইলে দারোয়ান বলে, মালিক আসছে।
অগত্যা দরজা থেকেই বিদায় হই। জমিদারবাড়ির দিকে যেতে থাকি। পিচঢালা পথ থেকে কাঁচা রাস্তায় নামি আমগাছের সারির ভেতর দিয়ে। সদর দরজা সাদামাটা। তবে বাড়িটি প্রথম দেখাতেই মন কেড়ে নিল। দোতলা বাড়ি বিরাট উঁচু। ইয়া মোটা মোটা গোটাকয়েক সিমেন্টের থামের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সামনে সবুজে মোড়া মাঠ। মাঠের মাঝখানে বাড়ির দিকে মুখ করে কালো কোট পরে কে যেন বসে আছে! কাছে গিয়ে দেখি রুটি-ভাজি খাচ্ছেন। সালাম দেওয়া থেকে মুখকে বিরত রাখলাম। আলাপে জানলাম তিনি মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ। বয়স বেশি নয়, মাস দুয়েক হলো এসেছেন, পরিবার এখনো আনেননি, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক। জানতে চাই, জমিদাররা জাতে কী ছিলেন? কিভাবে পয়সা করলেন? তিনি বলেন, 'আমি এখনো জেনে উঠতে পারিনি।' আমরা বলি, ভেতরে যেতে পারব?
তিনি মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বলেন। দুটি থামের মাঝখানে কাঠের পাটাতনে পা রাখি। চোখের সামনে ভেতর-বাড়ির উঠান, ডানে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। সিঁড়িই টানল আগে। দোতলার বারান্দা প্রশস্ত, ঘরের দরজা-জানালা কাঠের। দরজার ওপরের প্যানেলে গাঢ় নীল ও লাল কাচের নকশা_ফুল, পাতা, ময়ূর ইত্যাদির। ঘরগুলো বন্ধ। এসব ঘরে এখন কলেজের ক্লাস বসে। বারান্দার দক্ষিণ মাথায় বসার জায়গা আছে। বসে বসে সামনের বড় পুকুর দেখি। আমবাগানও দেখি। এ বাড়ির বিশেষ আকর্ষণ এর বয়সী আমগাছগুলো। তারপর সঙ্গে আনা বিস্কুট খাই। জমিদারবাড়িতে বসে বিস্কুট খাওয়ার বিশেষ আনন্দ আছে। দুপুর গড়িয়ে এলে হাই তুলে উঠে দাঁড়াই। সরু প্যাসেজ ধরে ভেতর-বাড়ির ছাদে যাই। দোতলার ছাদে ওঠার লোহার সিঁড়িটা দেখি ভেঙে পড়ে আছে। কষ্ট পেলাম বড়! ভেতর-বাড়ির ছাদ থেকে উবু হয়ে নিচে উঠান দেখি। দোতলার ছাদে একটা পিরামিড দেখে হৈ হৈ করে উঠি। নিচে নেমে এসে দুর্গামণ্ডপ দেখি। পূর্বদিকের রান্নাঘরটি বেশ বড়। বেরিয়ে এসে বাড়ির পেছন দিকে যাই। বাগান করার জন্য জায়গা আছে। আছে পুরনো একটি তেঁতুল গাছ। এ দিকটায় কেমন যেন পুরনো পুরনো গন্ধ। এক বৃদ্ধকে দেখি গোসল সেরে আসছেন। বাড়ি তাঁর চাঁদপুর। স্বাধীনতার আগে থেকে এখানে আছেন। কর্তাদের (জমিদার) শেষ পুরুষকে দেখেছেন। তাঁরা সন্দ্বীপ এলাকায় ব্যবসা করতেন। জাতে কায়স্থ। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পাততাড়ি গুটিয়ে কলকাতায় চলে গেছেন।
আলাপ-সালাপ সেরে আমবাগানের ভেতর দিয়ে সামনে চলে এলাম। পাশাপাশি দুটি মন্দির দেখলাম। একটা মন্দিরের প্রবেশমুখে খিলান আছে, মাথায় গম্বুজও আছে_কোন দেবতার ঠাহর করতে পারলাম না। আরেকটা মন্দির, বোধকরি শিবের হবে। গায়ে অনেক রিলিফ ওয়ার্ক (সিমেন্টে গড়া দ্বিমাত্রিক মূর্তি)_গঙ্গা, সরস্বতী, বরাহ, কূর্ম ইত্যাদি। এই প্রথম যমুনা দেবীর মূর্তিও দেখলাম। তারপর আর কাজ খুঁজে পেলাম না। বাজারে গিয়ে একটি মিষ্টির ঘরে বসলাম। পরোটা-ভাজি সুস্বাদু লাগল। অপু আবার গার্মেন্ট আন্দোলনের খোঁজখবর নিতে গেল। নতুন কিছু জানা গেল না। আমরা নৌকায় শীতলক্ষ্যা পার হয়ে টেম্পুস্ট্যান্ডে গেলাম। গ্রামের ভেতর দিয়ে পিচঢালা পথ। বাচ্চারা রাস্তার মাঝখানেই ছোটাছুটি করছে। ওদেরই বা দোষ কী! পথ খেয়েছে খেলার মাঠ। জমির দাম এখানে বেলায় বেলায় বাড়ছে। ঝিলের জমিও লাখ টাকা। টেম্পু নামিয়ে দিল চিটাগাং রোডে। ভ্রমণক্লান্ত দুই সূত্রাপুরিয়া ঝিমুতে ঝিমুতে বাড়ির পথ ধরলাম। উল্লেখ্য, মুড়াপাড়া নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানার একটি গ্রাম। জমিদার বাড়িতে বসেছে বেসরকারি মহাবিদ্যালয়।

কিভাবে যাবেন
ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়াগামী বাসে চড়ে নামতে হবে ভুলতা-গাউছিয়া। ভাড়া ৫০ টাকা। মুড়াপাড়া বাজারে খাওয়ার ভালো আঞ্জাম আছে। শীতলক্ষ্যার তাজা মাছও মিলতে পারে।

0 comments:

Post a Comment

 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. XNews2X - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু