৯ মাসেও রানা প্লাজা নিয়ে স্বচ্ছ পরিসংখ্যান হয়নি

Sunday, January 26, 2014

রানা প্লাজা দুর্ঘটনার ৯ মাসেও নিহত ও নিখোঁজের প্রকৃত পরিসংখ্যান বের করা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে জানার জন্য আজ পর্যন্ত কোন ওয়েবসাইট বা ডাটাবেজ তৈরি হয়নি।
আর এতে আগামীতে নেয়া পদক্ষেপ বাস্তবায়নে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। একই সঙ্গে দুর্ঘটনার পর সরকারি-বেসরকারি যেসব প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে, সেগুলোরও সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না। এ অবস্থায় রানা প্লাজা নিয়ে সার্বিক তথ্য বের করা জরুরি। গতকাল ব্র্যাক সেন্টার ইনে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) উদ্যোগে আয়োজিত আলোচনায় অংশ নেয়া প্যানেল আলোচকরা এসব কথা বলেন। এতে ‘রানা প্লাজা দুর্ঘটনা ও পরবর্তী পদক্ষেপসমূহ, প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবায়নের সর্বশেষ পরিস্থিতিবিষয়ক’ রিপোর্ট উপস্থাপন করেন ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। আলোচনা সভার সভাপতিত্ব করেন সিপিডি’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তাফিজুর রহমানের সঞ্চালনায় আলোচনায় অংশ নেন শ্রম সচিব মিকাইল শিপার, ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, অধ্যাপক এমএম আকাশ, বিজিএমইএ’র সভাপতি আতিকুল ইসলাম, সাবেক সভাপতি টিপু মুন্সী, সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিসের (বিলস) যুগ্ম সচিব জাফরুল হাসান, বিকেএমইএ’র সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ও ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক আলী আহমেদ খান প্রমুখ।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, রানা প্লাজা ধসের পরে নিহত-আহত শ্রমিকদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে কত টাকা জমা হয়েছে, কে কত টাকা দিয়েছেন, আর কাকে কত টাকা দেয়া হয়েছে তা স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। আমরা শেষ পর্যন্ত দেখবো শ্রমিকরা কত টাকা পেয়েছে। আর শ্রমিকদের দেখিয়ে কে কত টাকা নিয়েছে। কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি থাকলে কোন প্রশ্ন উঠবে না। তিনি বলেন, রানা প্লাজায় দুর্ঘটনার ফলে সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু কাজের অগ্রগতি হয়নি। ব্যক্তি পর্যায়ে কিছু কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্ত সামগ্রিকভাবে উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এসব বিষয় সামনে রেখে দ্বিতীয় প্রজন্মের গার্মেন্ট শিল্প তৈরি করতে একটি জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন করা জরুরি বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। ড. দেবপ্রিয় বলেন, এখন তিনটি বিষয়ের দিকে নজর দিতে হবে। প্রথমত, নিহত-আহত শ্রমিকদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি সমাধান করতে হবে। দ্বিতীয়ত, দ্বিতীয় মেয়াদের কারখানাগুলো কিভাবে হবে তা ঠিক করা। তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় রেখে দরকষাকষি করে কারখানায় কাজ নিতে হবে। অনেকেই ঋণ দেয়ার কথা বলেন। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদি অবকাঠামোগত উন্নয়নে ঋণ কিভাবে পাওয়া যাবে সেটা ঠিক করা দরকার। তিনি বলেন, একটা সমন্বয়ের অভাব ছিল রানাপ্লাজা উত্তর পরিস্থিতিতে। মানুষের নিহত ও নিখোঁজের বিষয়টি এখনো নিশ্চিত নয়। তিনি আরও বলেন, দীর্ঘমেয়াদি অবকাঠামো সৃষ্টিতে কিভাবে ঋণ পাওয়া যায় তা নিয়ে চিন্তা করা উচিত। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এটি করতে হবে। ড. দেবপ্রিয় বলেন, স্বচ্ছতার বিষয়টি শেষ পর্যন্ত নিষ্পত্তি হতে হবে। ডিএনএ টেস্টে কাদের পরিচয় মিললো তা-ও প্রকাশিত হয়নি।
বিজিএমইএ’র সভাপতি আতিকুল ইসলাম বলেন, যে সব শ্রমিক ক্ষতিপূরণ পায়নি তাদেরকেও ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। এতিম শিশুদের শিক্ষা, খাদ্য, চিকিৎসাসহ সব ধরনের সহায়তা দেয়া হবে। ৩০০ জন এতিম শিশুর দায়িত্ব বিজিএমইএ নেবে বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, উত্তর আমেরিকান ক্রেতাদের জোট (অ্যাকর্ড) ও ইউরোপীয় ক্রেতাদের জোট (অ্যালায়েন্স) যে শর্ত দিচ্ছে তাতে দেশের কোন কারখানাই থাকবে না। তারা বলছে, নিচে দোকান ও উপরে কারখানা থাকলে কারখানা বন্ধ করে দিতে হবে। এভাবে করলে পুরো পোশাকখাত লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে। তারা আর্থিক সহযোগিতা করার কথা বললেও এক টাকাও দেয়নি। জাইকা একটি ফান্ড দেয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু তাদের চাহিদা পূরণ করে ফান্ড পাওয়া সম্ভব নয়। তিনি বলেন, গার্মেন্ট শিল্পে রাজনীতি ঢুকে গেছে। এ শিল্পকে ধ্বংস করতে উঠে পড়ে লেগেছে একটি চক্র। ২১ বিলিয়ন রপ্তানির এ খাত অনেকেই সহ্য করতে পারছে না। আমরা বিশ্বের দ্বিতীয় স্থানে এটাই আমাদের দোষ।
টিপু মুন্সি বলেন, নিহত-আহত শ্রমিকদের সহায়তার মনিটরিং সেল গঠন করা প্রয়োজন। যাতে সবাই সমান ভাবে ক্ষতিপূরণ পায়। তিনি সিপিডি’র উদ্দেশে বলেন, শুধু নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে কথা বললে সামনের দিকে এগোনো সম্ভব হবে না। সবাইকে মিলেই তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
জাফরুল হাসান বলেন, শ্রম আইনে ভাল-মন্দ দুই দিকই আছে। ২০০৬ সালের শ্রম আইনের অনেক কিছুই সংশোধন করতে হবে। যে করেই হোক আমাদেরকে গার্মেন্ট শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হবে। রানাপ্লাজা ও তাজরীনের মতো আর কোন ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
শ্রমিক নেতা বাবুল আকতার বলেন, রানা প্লাজায় যারা কাজ করেছেন তারা এখন কোন গার্মেন্টে কাজ করতে চান না। তাদেরকে অন্য চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে। শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির কথা এলেই বলে কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু কোন কারখানাই বন্ধ হয়নি। মালিকদের মানসিকতা পরিবর্তন হলে সবকিছু সম্ভব হবে। নয়তো কোন কিছুই সম্ভব নয়।
অনুষ্ঠানে রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় নিহত মোজাম্মেল হকের স্ত্রী কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, রানা প্লাজার তিন তলায় নিউ বটনে কাজ করতো তার স্বামী। তাকে কবর দেয়ার পরে এ পর্যন্ত বিকাশের মাধ্যমে মাত্র ২০ হাজার টাকা পেয়েছি। এরপর আর কেউ কোন খোঁজখবর নেয়নি। ঘরে এখন বাতি জ্বলে না। টাকার অভাবে ছোট মেয়ের বই কিনতে পারি না। মেয়ের স্কুলে যাওয়া বন্ধ।
বেঁচে যাওয়া আরেক শ্রমিক মরিয়ম বলেন, আমাকে একটা কৃত্রিম হাত দেয়া হয়েছে। কিন্তু এটা দিয়ে কাজ করতে পারি না। কারণ এটা অনেক ভারি, ব্যবহার করলে খুব কষ্ট হয়, শরীরে যন্ত্রণা হয়।
রানা প্লাজার ওপর প্রতিবেদনে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, দুর্ঘটনায় নিহত ও নিখোঁজের সংখ্যা নিয়ে একেকটি সংস্থা একেক ধরনের তথ্য দিয়েছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিলস নিখোঁজের সংখ্যা জানাচ্ছে ৩৭৯ জন। অন্যদিকে রানা প্লাজা কো-অর্ডিনেশন সেল এই সংখ্যা ১৮৯ জন এবং সিপিডি’র মতে ৯৮ জন। প্রতিবেদনে তিনি বলেন, দুর্ঘটনার সময় ভবনটিতে কর্মরত মানুষের সংখ্যা নিয়েও রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য। বিজিএমইএ-অ্যাকশন এইড-এর রিপোর্ট বলছে ৩৫৭২ জন, সিপিডি ৩৬৭০, বিলস ৩৯৪৮ আর কো-অর্ডিনেশন সেল ৩৮৪৮ জন। দুর্ঘটনার নয় মাসেও নিহত ও নিখোঁজের প্রকৃত সংখ্যা বের করতে না পারা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং এ কারণেই পরবর্তী পদক্ষেপ বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানান গোলাম মোয়াজ্জেম। প্রতিবেদনে আরও বলেন, দুর্ঘটনায় আহতদের যারা পরে কাজে যোগ দিয়েছেন তাদের কেউই কাজের জন্য পুরোমাত্রায় সক্ষম নন। এতে তাদের আয় কমেছে। গার্মেন্ট খাতে স্বাভাবিক আয়ের তুলনায় ৬০ শতাংশ কম আয় করছেন এই শ্রমিকরা।

কিশোরগঞ্জে সোনালী ব্যাংকের সাড়ে ১৬ কোটি টাকা লুট by আশরাফুল ইসলাম

গোপন সুড়ঙ্গপথে কিশোরগঞ্জে সোনালী ব্যাংকের প্রধান শাখা থেকে ১৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা লুট করে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। জেলা শহরের রথখলা এলাকায় ব্যাংকের ওই শাখার পাশের বাসভবনের একটি কক্ষ থেকে সুড়ঙ্গপথ তৈরি করে ব্যাংকের ভল্টরুমে রাখা এ টাকা লুট করা হয়।
শুক্র ও শনিবার ব্যাংক বন্ধ থাকার পর গতকাল ব্যাংক খোলার পর বেলা আড়াইটার দিকে টাকা লুট হওয়ার বিষয়টি ধরা পড়ে। শুক্র কিংবা শনিবারের কোন একসময় এ ঘটনা ঘটেছে বলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা ধারণা করছেন। শহরের অন্যতম ব্যস্ততম এলাকার প্রধান সড়কের ওপর অবস্থিত ব্যাংকের শাখা থেকে দুঃসাহসিক লুটের ঘটনায় পুরো এলাকায় ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক হুমায়ূন কবির ভূঁইয়া ও প্রিন্সিপাল অফিসার হাসান আহমেদ মঈন জানান, ভল্টরুমে দু’টি কক্ষ রয়েছে, তবে প্রবেশপথ একটিই। সামনের কক্ষ পেরিয়ে পেছনের কক্ষে যেতে হয়। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার ব্যাংক চলাকালে ভল্টরুমে তারা প্রবেশ করেছিলেন। তারা জানান, সে সময় ভল্টের দু’টি কক্ষের মধ্যে পেছনের কক্ষটিতে ৬টি স্টিলের আলমারির বাইরে টেবিলের ওপর উন্মুক্ত অবস্থায় ১৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা ও সংশ্লিষ্ট রেজিস্ট্রার রাখা ছিল। এরপর নির্ধারিত সাপ্তাহিক ছুটির কারণে শুক্র ও শনিবার ব্যাংক বন্ধ ছিল। গতকাল সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসের শুরুতে ভল্ট খুলে দু’টি কক্ষের সামনেরটিতে তারা কাজ করেন। বেলা আড়াইটায় তালাবদ্ধ পেছনের কক্ষটি খুলে ভেতরে প্রবেশ করেন। সে সময় টেবিলের ওপর রাখা টাকা দেখতে না পেয়ে এবং কক্ষের মেঝেতে গর্ত দেখতে পেয়ে টাকা লুট হওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারেন। দুর্বৃত্তরা স্টিলের আলমারির লক ভাঙারও চেষ্টা করেছিল বলে তারা জানান। বিষয়টি সদর মডেল থানার ওসিকে অবহিত করার পর পুলিশ ঘটনাস্থলে ছুটে যায়।

এদিকে ঘটনাটি জানার পরপরই রহস্য উদ্ঘাটনে পুলিশ, ডিবি পুলিশ ও সিআইডি তদন্তে নামে। ভল্টরুমের সুড়ঙ্গপথ ধরে তারা পাশের একটি টিনশেড বাসায় সুড়ঙ্গপথের উৎসমুখ আবিষ্কার করে। ওই সুড়ঙ্গপথের মাধ্যমেই ভল্টরুম থেকে লুট করা টাকা সরানো হয়েছে বলে তারা ধারণা করছেন। সুড়ঙ্গপথের বর্ণনা দিতে গিয়ে সদর থানার এসআই শফিকুল ইসলাম জানান, সুড়ঙ্গপথটি খুব কৌশলে তৈরি করা হয়েছে। প্রায় ১৮ ফুট দীর্ঘ সুড়ঙ্গপথটি যেন ভেঙে না পড়ে সে জন্য সুড়ঙ্গের দু’পাশের পাড়ে বাঁশের খুঁটি দেয়া হয়েছে। প্রায় সাড়ে ৩ ফুট উঁচু ও ৩ ফুট প্রস্থ সুড়ঙ্গপথ ধরে একজন ব্যক্তি অনায়াসেই চলাচল করতে পারবেন।
পুলিশ ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুড়ঙ্গপথের উৎসমুখটি যে টিনশেড বাসার একটি কক্ষে পাওয়া গেছে সে বাসাটির মালিক আমিনুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি। তিনি বেশ কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। বর্তমানে ওই বাসার মালিক তার মেয়ে মিনা আক্তার। তিনি ঢাকার উত্তরায় ১২ নম্বর সেক্টরের ৫ নম্বর রোডের ৫৩নং বাসায় স্বামীর সঙ্গে বসবাস করেন। মিনা আক্তার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা এবং তার স্বামী মো. ইব্রাহীম উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। ঢাকায় বসবাসকারী মিনা আক্তারের মালিকানাধীন ওই বাসায় বর্তমানে ১১টি পরিবার ভাড়ায় রয়েছেন। বাসার যে রুমে সুড়ঙ্গপথটির উৎসমুখ পাওয়া গেছে সে বাসার ১নং রুমে সোহেল নামে ৩২-৩৩ বছর বয়সী যুবক ভাড়া থাকতেন বলে জানান বাসার ৩নং রুমের ভাড়াটিয়া মার্জিয়া আক্তার। মার্জিয়া জানান, প্রায় আড়াই বছর আগে সোহেল বাসার ওই রুমটি ভাড়া নিলেও অন্য ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে তার তেমন কোন সম্পর্ক ছিল না। সে একাকী ওই রুমে বসবাস করতো। তার বাবা ঢাকায় সোনালী ব্যাংকের কোন এক শাখায় চাকরি করেন বলে তারা শুনেছেন। তার বাড়ি হোসেনপুরের চরপুমদি এলাকায় হতে পারে বলে তিনি ধারণা দেন। বাসায় যাতায়াতের ক্ষেত্রে সে সোনালী ব্যাংক গলির দিকের দরজা ব্যবহার করতো বলেও তিনি জানান।
ওই বাসার মালিক মিনা আক্তারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, সেলিম নামে শহরের এক ব্যবসায়ীর মাধ্যমে সোহেলকে তার বাড়ির দায়িত্বে থাকা গোকুল বাবু বাসাভাড়া দিয়েছিলেন। সোহেলের বাবার নাম না জানলেও তিনি ঢাকায় সোনালী ব্যাংকের কোন এক শাখায় চাকরি করেন বলে তিনি জানতেন।
এ ঘটনার মূল সন্দিগ্ধ সোহেলের ভাড়া বাসায় গিয়ে দেখা গেছে, দুই রুমবিশিষ্ট বাসার একটি রুমে কাঠের কিছু আসবাবপত্র এলোপাতাড়ি পড়ে রয়েছে। অন্য রুমের অবস্থাও তথৈবচ। সোনালী ব্যাংক ভবনের ভল্টরুম থেকে সবচেয়ে কাছের ওই বাসার দরজা সংলগ্ন পরিত্যক্ত একটি টয়লেটের পাশে খোঁড়া হয়েছে সুড়ঙ্গটি। সুড়ঙ্গের পাশে একটি হাতুড়ি ও কোদাল পড়ে থাকতে দেখা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজে এসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়েছে। কোন রুমেই থাকার কোন খাট পাওয়া যায়নি। তবে প্রথম রুমটিতে খাট ছিল বলে জানা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ঘটনার পর পালানোর আগে খাটটি অন্যত্র নিয়ে গেছে সোহেল।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বখাটে টাইপের সোহেল অন্য ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে মিশতো না। কয়েক দিন ধরে রাতে তার বাসায় হাতুড়ির শব্দও শোনা গেছে। বিষয়টি নিয়ে কেউ জিজ্ঞেস করলে বাসায় কাঠের কাজ করছেন বলে সে জানাতো। সর্বশেষ শুক্রবার রাতেও বাসায় সোহেলের অবস্থান টের পেয়েছিলেন ২-১ জন প্রতিবেশী ও ভাড়াটিয়া।
এদিকে ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর থেকে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকের ওই শাখায় দায়িত্বরত কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ব্যাংকেই অবস্থান করছিলেন। এ ছাড়া সোহেলকে বাসা ভাড়া পাওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতাকারী স্থানীয় ব্যবসায়ী সেলিমকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করছে বলে জানান সদর সার্কেলের এএসপি মো. শাহেন শাহ। অন্যদিকে ব্যাংকের নিরাপত্তা ক্যাম্পে দায়িত্ব পালনকারী ২ এএসআই ও ৬ কনস্টেবলকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। পরে তাদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. আনোয়ার হোসেন খান জানান, ভাড়াটিয়া সোহেলসহ একাধিক ব্যক্তি এ কাজে জড়িত থাকতে পারে। ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন এবং জড়িতদের চিহ্নিত করার জন্য পুলিশের বেশ কয়েকটি টিম কাজ করছে।

বদনামের শেষ নেই এমপি বদির by বিপ্লব রহমান ও তোফায়েল আহমেদ

Tuesday, September 27, 2011

বাংলাদেশের দক্ষিণে একদম শেষ প্রান্তের সাগর-পাহাড়-বনভূমিঘেরা সুন্দর জনপদটি এখন বিষে জর্জরিত। এ বিষ ছড়িয়েছেন সেখানকার খোদ সরকারদলীয় এমপি আবদুর রহমান বদি। তাঁর বদনামের শেষ নেই এলাকায়। টেকনাফ ও উখিয়া নিয়ে গঠিত কক্সবাজার-৪ সংসদীয় আসন এলাকায় সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে এমপি বদির চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, অনিয়ম, দখল, ক্ষমতার দাপটের নজিরবিহীন সব কাণ্ড। তাঁর অপকর্মে এলাকাবাসী এখন অসহায়। বিরোধিতা করলেই নেমে আসে নির্যাতন। এমপি নিজেই মারধর করেছেন সরকারি কর্মচারী, স্কুলশিক্ষক, আইনজীবী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাসহ অনেককেই।
জানা গেছে, এমপিকে চাঁদা না দেওয়ায় শাহপরীর দ্বীপরক্ষা বাঁধের ঠিকাদার লাঞ্ছনার শিকার হয়ে এলাকা ছেড়েছেন। সেই বাঁধ নির্মিত না হওয়ায় নিয়মিত জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে উপকূলীয় ১০টি গ্রাম। আরো জানা গেছে, টেকনাফের সরকারি স্থলবন্দর, মিয়ানমারের চোরাই পণ্য খালাসের ঘাট, দমদমিয়ার বেসরকারি জাহাজঘাট ও সেন্ট মার্টিনের ঘাটের টোল আদায় থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য_সর্বত্রই রয়েছে এমপি বদির ভাগ। স্থানীয় রোহিঙ্গাদের ভোট হাতিয়ে নিতে জঙ্গি সম্পৃক্ত একটি সন্দেহজনক এনজিওকে তিনি তোষণ করছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। তাঁর স্বাক্ষরিত ৭৫ হাজার পরিচয়পত্রে চলছে সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ বিতরণ।
এমপি বদির নামে বিভিন্ন সময় খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি, ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসা, চোরাচালান, সন্ত্রাসসহ নানা অভিযোগে মোট ২৩টি মামলা হয়েছে। অবশ্য তিনি এমপি হওয়ার পর সন্ত্রাসের দু-তিনটি মামলা বাদে সব মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। দুর্নীতিবাজের তালিকায়ও তাঁর নাম উঠেছে। এক-এগারোর জরুরি সরকারের সময় জেলও খেটেছেন তিনি। তাঁর দাপটে আওয়ামী লীগের দলীয় নেতা-কর্মীরাও এখন কোণঠাসা। প্রকাশ্যেই নেতারা এমপি বদির অনিয়ম-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে এলাকায় বিক্ষোভ মিছিলও হয়েছে।
টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. শফিক মিয়া ও উখিয়া আওয়ামী লীগের সভাপতি আদিল উদ্দীন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, এমপি বদি দলের নীতি, আদর্শ ও সততার রাজনীতি থেকে অনেক দূরে সরে গেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে বন্দর দখল, চোরাচালান, চাঁদাবাজিসহ সন্ত্রাসের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। এমপি হওয়ার পর তিনি ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন। এ ধরনের লোক দলকে ডোবানোর জন্য যথেষ্ট। লুটপাট ও সন্ত্রাসই এমপি বদির শেষ কথা। দলের জন্য তো বটেই, দেশের জন্যও তিনি ভয়ংকর।
তবে এমপি আবদুর রহমান বদি এসব অভিযোগ অস্বীকার করে কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, তাঁর সুনাম নষ্ট করার জন্যই একটি মহল তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রচারণা চালাচ্ছে। রোহিঙ্গারা বিভিন্ন ধরনের চাঁদাবাজি ও আইনশৃঙ্খলা অবনতির সঙ্গে জড়িত। এর সঙ্গে জামায়াতসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলও রয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কারণে বিভিন্ন সময়ে হয়রানিমূলক মামলা হয়েছে। তিনি বলেন, 'আমি রাজনীতি বুঝি না, দল বুঝি না, আমি দলীয় নেতা-কর্মীদেরও বুঝি না। আমার এলাকার ৭৫ হাজার লোককে ত্রাণের মাধ্যমে খুশি রাখতে পারলেই আমার রাজনীতির ষোলো আনা পূর্ণ।'
কিন্তু স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানায়, গত মে মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের মতবিনিময় সভায় মো. শফিক মিয়া ও আদিল উদ্দীন চৌধুরী প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার কাছে এমপি বদির নানা কীর্তিকলাপ তুলে ধরেন। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও জানান তাঁরা। তবে সরকারের পক্ষ থেকে কখনো কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় এমপি বদি হয়ে উঠেছেন আরো বেপরোয়া।
এ বিষয়ে এমপি বদি বলেন, 'তাঁরা যে অভিযোগ করেছেন, তা সবই তাঁদের ব্যক্তিগত মতামত। এগুলো দলের সাধারণ নেতা-কর্মীদের বক্তব্য নয়।'
স্থানীয় আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এইচ কে আনোয়ার কালের কণ্ঠকে বলেন, এমপি বদির উত্থান আওয়ামী লীগের ভেতর থেকে নয়। তাই দলীয় নীতি-আদর্শ নিয়ে তিনি মোটেই চিন্তিত নন। তিনি মারধর, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও চোরাচালান করে দলকে তছনছ করে ফেলেছেন। টেকনাফ বন্দরকে এমপি বদি ব্যক্তিগত বন্দরে পরিণত করেছেন। তিনি বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীদের নিয়ে টেকনাফ বন্দর দখল করেছেন। এ ছাড়া তাঁর পরিবারের সদস্যরাও বন্দর ও ঘাটের সব বৈধ-অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তাঁর দাপটে আওয়ামী লীগের লোকজন কাছে ঘেঁষতে পারে না।
টেকনাফ উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল্লাহ অভিযোগ করে বলেন, এমপির দাপটে ঐতিহ্যবাহী পর্যটন নগরী টেকনাফ এখন পর্যটনশূন্য। টেকনাফের বদলে দমদমিয়া থেকে সেন্ট মার্টিনগামী জাহাজগুলোকে চলাচলে এমপি বদি বাধ্য করছেন বলে এখানে পর্যটকরা একেবারেই আসছে না। কারণ দমদমিয়া দিয়ে জাহাজ চলাচলের আয়ে এমপির 'বাড়তি কমিশন' রয়েছে।
কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানেও বেরিয়ে এসেছে বদি এমপির নানা অপকর্মের কথা।
শাহপরীর দ্বীপের দুঃখ : টেকনাফ উপজেলার শাহপরীর দ্বীপ পশ্চিমপাড়ায় বেড়িবাঁধের ৬৬০ মিটার ভাঙা অংশ মেরামত এবং বাঁধের একপাশে সিসি ব্লক বসানোর জন্য চলতি বছর দরপত্র আহ্বান করা হয়। চার কোটি ৭৫ লাখ টাকায় কাজ পায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান 'মেসার্স উন্নয়ন ইন্টারন্যাশনাল'। ৩০ জুন ছিল কাজ শেষ করার শেষ সময়। কিন্তু এখন পর্যন্ত ঠিকাদার কাজই শুরু করতে পারেননি। ফলে বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে শাহপরীর দ্বীপের ১০টি গ্রামের কয়েক শ ঘরবাড়ি প্লাবিত হচ্ছে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে প্রাণহানির আশঙ্কায় চরম উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ।
মেসার্স উন্নয়ন ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী আতিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে অভিযোগ করে বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) থেকে কার্যাদেশ পাওয়ার পরপরই প্রকল্প এলাকায় নির্মাণসামগ্রী মজুদ করা হয়। শতাধিক শ্রমিক নিয়োগ করে কাজও শুরু করা হয়। তিন দিন পরই এমপি বদির লোকজন মোটা অঙ্কের চাঁদার দাবিতে কাজ বন্ধ করে দেয় এবং প্রকল্প এলাকা থেকে শ্রমিকদের তাড়িয়ে দেয়। ঠিকাদার আতিকুল বলেন, এরপর এমপি বদির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানিয়ে দেন, চাঁদা না দিলে তাঁর এলাকায় কাজ করতে দেওয়া হবে না। এমপির চাঁদা দাবির বিষয়টি লিখিতভাবে গত ২২ মে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব ও চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনারকে তিনি জানিয়েছেন। কিন্তু কোনো সমাধান না হওয়ায় তিনি কাজ শুরু করতে পারছেন না।
তবে এমপি আবদুর রহমান বদি কালের কণ্ঠকে বলেন, ঠিকাদার আতিকুল ইসলাম ২০১০ সালে এখানে চার কোটি ৪০ লাখ টাকার কাজ করেছিলেন। কিন্তু বালু দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করায় সেটি স্থায়ী হয়নি, যা এখন সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে বিলীন হচ্ছে। গত এপ্রিল মাসে একই প্রতিষ্ঠানকে আবার চার কোটি ৭৫ লাখ টাকার কাজ দেওয়া হয়। কিন্তু বালু দিয়ে বাঁধ নির্মাণ শুরু করলে স্থানীয় লোকজন প্রতিবাদ জানায়। এরপর ঠিকাদার কাজ না করে পালিয়ে যান।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, গত ১৭ জুন জেলা প্রশাসক মো. গিয়াস উদ্দিন আহমদ, ঠিকাদার আতিকুল ইসলাম, পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মইনুদ্দীন এবং উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা শাহপরীর দ্বীপের ওই ভাঙা বেড়িবাঁধ পরিদর্শনে যান। এ সময় এলাকাবাসী তাদের দুর্ভোগের কথা জানায়। এরপর ঘটনাস্থলে হাজির হন এমপি বদি। তিনি ঘটনাস্থলেই ঠিকাদার আতিকুল ইসলামের হাত ধরে টানাটানি করেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে বালু দিয়ে বাঁধ নির্মাণের অভিযোগ তোলেন। জবাবে ঠিকাদার তাঁকে জানান, এর আগে তিনি বেড়িবাঁধে ব্লক ফেলার কাজ পেয়ে তা সুষ্ঠুভাবে শেষ করেছেন, বাঁধ নির্মাণ তাঁর কাজের এখতিয়ারভুক্ত নয়। পরে টেকনাফে পাউবোর অতিথিশালায় জেলা প্রশাসকের বৈঠকটি চাঁদা চাওয়া না-চাওয়ার প্রশ্নে উভয়ের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ে ভণ্ডুল হয়ে যায়।
সন্ত্রাস ও দখলবাজি : অনুসন্ধানে জানা যায়, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর টেকনাফ স্থলবন্দর, হাট-বাজার, ঠিকাদারি, পরিবহন, পর্যটকবাহী জাহাজ, টার্মিনাল, জেটিসহ সীমান্ত চোরাচালান ব্যবসা পুরো নিয়ন্ত্রণে নেন এমপি বদি। সঙ্গে রয়েছেন তাঁর ছোট ভাই আবদুল আমিন। এখন আবদুল আমিনের ইচ্ছা অনুযায়ী টেকনাফ বন্দরের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হচ্ছে। আমিন মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী। তিনি ইয়াবা ও হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর জানিয়েছে।
এমপির অন্য তিন ভাই মৌলভী মজিদ, আবদুস শুকুর ও মো. শফিকও বন্দরের কোনো না কোনো ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। এমপি বদির দুই ভগি্নপতি শওকত আলী ও আবদুল গফুর এবং আরেক ভগি্নপতি রাউজান থানার ওসি আবদুর রহমানের ছেলে নিপু, ফুপা হায়দার আলীও বন্দর ব্যবসা করছেন। এমপির চাচা মোজাহের কোম্পানি বন্দরের শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ করেন। এমপির নিজস্ব বন্দর বলে খ্যাত অবৈধ কাইয়ুকখালী ঘাটের চিংড়ি মাছ, কাঠ, ফলমূল আমদানি নিয়ন্ত্রণ করেন তাঁর আরেক ভগি্নপতি গিয়াস উদ্দীন ও ফুফাতো ভাই সৈয়দ আলম। এমপি তাঁর প্রভাব খাটিয়ে মিয়ানমার থেকে আনা মালামাল অবৈধভাবে এ ঘাট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের সুযোগ করে দেন। এই বন্দর দিয়ে বিপুল পরিমাণ চোরাই পণ্য মিয়ানমার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে। প্রতিটি মালবাহী নৌকা ও ট্রাকের জন্যও রয়েছে বিভিন্ন অঙ্কের চাঁদা। এ ছাড়া উখিয়া থানা প্রশাসন চলছে এমপির দুই শ্যালক হুমায়ুন কবির মন্টু ও জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীর ইশারায়।
অন্যদিকে সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটকদের চাহিদা পুঁজি করে জাহাজ জেটিতে চলে চাঁদাবাজি। ফলে পর্যটকদের খরচ অনেক বেড়ে যায়। টেকনাফের কয়েক কিলোমিটার আগে দমদমিয়ায় একটি অবৈধ বেসরকারি জেটি দিয়ে পর্যটকরা এখন টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন যাওয়া-আসা করে। 'কেয়ারি সিন্দাবাদ' নামের একটি মাত্র জাহাজ দমদমিয়া ঘাট থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত মাত্র ৩৬ কিলোমিটার যাওয়া-আসার ভাড়া নেয় সাড়ে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। অথচ সরকারি হিসাবে ভাড়া প্রতি কিলোমিটার মাত্র এক টাকা ২০ পয়সা। উপরন্তু এসব জাহাজ ভাড়ার সঙ্গে পর্যটকদের কাছ থেকে মাথাপিছু ৫০ টাকা করে 'বাড়তি কমিশন' আদায় করেন এমপি বদির লোকজন। অভিযোগ আছে, অবৈধ ব্যবসাটি টিকিয়ে রাখতে তিনি টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে জাহাজ চলাচল চালু করছেন না। ফলে টেকনাফ এখন পর্যটনশূন্য হয়ে পড়েছে।
তবে এমপি বদি তাঁর পরিবারের মাদক, চোরাচালান ও চাঁদাবাজির সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, 'ব্যবসায়ী পরিবার হিসেবে এলাকায় আমাদের সুনাম রয়েছে। আমার পরিবারের সদস্যরা সবাই বৈধভাবে বহু বছর ধরে ব্যবসা করছেন। আমরা সরকারকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ কর দিয়ে আসছি। রাজনৈতিক কারণে আমাকে হেয় করার জন্য বিভিন্ন মহল আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে।'
এদিকে 'অবাধ্যতার দায়ে' বিভিন্ন সময় এমপি বদি নিজেই মারধর করে পুরো এলাকায় ত্রাসের রাজস্ব কায়েম করেছেন। গত সংসদ নির্বাচনে কক্সবাজারের চারটি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের একমাত্র এমপি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার মাত্র ২৩ দিন পর ২২ জানুয়ারি টেকনাফ উপজেলা নির্বাচনের দিন একটি ভোটকেন্দ্রের সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ও ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তা গিয়াস উদ্দিনকে মারধর করেন বদি। এরপর তাঁর হাতে প্রহৃত হন টেকনাফের বন বিট কর্মকর্তা মুজিবুর রহমান। এ ছাড়া ভোটার তালিকা তৈরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে টেকনাফের প্রাথমিক স্কুলশিক্ষক আবদুল জলিল ও পুলিন দে প্রহৃত হন বদি এমপির হাতে। টেকনাফের কুলালপাড়ার মুক্তিযোদ্ধা হাজি মোস্তফা, কক্সবাজারের সড়ক ও জনপথের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল হাকিম, উখিয়ার সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গোলামুর রহমান, কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য রাখালচন্দ্র মিত্রও এমপির হাতে প্রহৃত হন। টেকনাফের সাবরাং হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মুফিজ উদ্দিন, টেকনাফের হোয়াইক্যংয়ের ছাত্রলীগ নেতা জসিম উদ্দিনকেও মারধর করেছেন এমপি। গত ১৫ জানুয়ারি টেকনাফ পৌর এলাকায় এমপির চাচা হাজি ইসলামের নির্বাচনী সভার ভিডিও করার সময় কক্সবাজার সদরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবদুর রহমানকে ধরে এমপি বদি বেধড়ক পিটুনি দেন। মামলাটি এখনো বিচারাধীন। সবশেষ গত ৩ জুলাই আবদুর রহমান বদি টেকনাফের শামলাপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মঞ্জুর আলমকে (৫২) প্রকাশ্যে পিটিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেন। আহত হওয়ায় পুলিশ তাঁকে থানায় নিয়ে ছেড়ে দেয়। মঞ্জুর আলমকে উদ্ধার করতে গিয়ে শামলাপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সাইফুল্লাহ কোম্পানিও এমপির হাতে নাজেহাল হন। পরে আহত শিক্ষককে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
সবার বড় বদি : আন্তর্জাতিক চোরাচালান সিন্ডিকেটের অন্যতম গডফাদার ছিলেন টেকনাফের এজাহার মিয়া ওরফে এজাহার কোম্পানি। নিরাপত্তা বাহিনীর তালিকাভুক্ত এই শীর্ষ চোরাচালানির ১২ জন স্ত্রীর ২৬ সন্তানের মধ্যে সবার বড় আবদুর রহমান বদি। জানা যায়, বাবার বিশাল চোরাই ব্যবসায় কিশোর বয়সেই হাতে খড়ি হয় তাঁর। বঙ্গোপসাগর দিয়ে অস্ত্র, মাদকসহ নানা চোরাই পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশের টানেলখ্যাত টেকনাফের আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যবসার পুরো নিয়ন্ত্রণ একসময় চলে আসে বদির হাতে। রাতারাতি ধনী হয়ে ওঠেন তিনি। পাশাপাশি রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য বিভিন্ন দলের সঙ্গেও গড়ে তোলেন সুসম্পর্ক।
১৯৯৬ সালের দিকে আবদুর রহমান বদি প্রকাশ্যে রাজনীতি শুরু করেন। সেই বছর ১৫ ফেব্রুয়ারির সংসদ নির্বাচনে প্রথমে বিএনপির টিকিটে মনোনয়ন পাওয়ার দেনদরবার করেন। ব্যর্থ হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে হেরে যান। একই বছরের ১২ জুনের নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন পেলেও পরে দলের পক্ষ থেকে তা বাতিল করা হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ১২ জুনের নির্বাচনে কক্সবাজার-৪ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী অধ্যাপক মো. আলী নির্বাচিত হন। নির্বাচিত এমপির ছত্রচ্ছায়ায় উখিয়া-টেকনাফের সব ধরনের বৈধ-অবৈধ ব্যবসায় ব্যাপক সাফল্য আসে তাঁর। আওয়ামী লীগের পাঁচ বছরে বদির অর্থ-বিত্ত ফুলে-ফেঁপে উঠতে শুরু করে।
২০০০ সালের দিকে আওয়ামী লীগের সমর্থনে টেকনাফ পৌরসভার প্রশাসক হন বদি। তবে এক মাসের মাথায় দলীয় সিদ্ধান্তে তাঁকে অপসারণ করা হয়। ২০০৩ সালের পৌর নির্বাচনে চেয়ারম্যান হিসেবে জয়ী হন বদি। একমাত্র জামায়াত দলীয় কমিশনারকে ১ নম্বর প্যানেল চেয়ারম্যান করায় দলীয় কমিশনাররা তাঁর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। এ সময় একের পর এক ধর্ষণ, খুন, মারামারি, নির্যাতনসহ বেশ কয়েকটি মামলায় জড়িয়ে পড়েন তিনি। বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময় যৌথ বাহিনীর 'অপরেশন ক্লিন হার্ট'-এর সময় বদি ছিলেন পলাতক। জোট সরকারের শেষ সময়ে টেকনাফ উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় তিনি প্রথম গ্রেপ্তার হন। এক-এগারোর জরুরি অবস্থার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শুরুতেও তিনি এক দফা গ্রেপ্তার হন। পরে জামিনে মুক্তি পেয়ে তিনি ডজন দুয়েক মামলা থেকে একে একে খালাস পান। তবে এখনো তাঁর বিরুদ্ধে দুই-তিনটি সন্ত্রাস-মারধরের মামলা রয়েছে।
'আমি সন্ত্রাসী নই, ব্যবসায়ী' : টেকনাফ বন্দর দখল, মাদক ব্যবসা, চোরাচালান, চাঁদাবাজিসহ সন্ত্রাসের বিষয়ে এমপি বদি বলেন, 'বন্দর দিয়ে আসা ৮০ ভাগ মালই আমার। তাই আমি চাঁদাবাজি করব কিভাবে? আমি ব্যবসায়ী মানুষ, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ নই। আমার পরিবারের সবাই বৈধ ব্যবসায়ী। মাদক বা অন্য কোনো চোরাচালানমূলক অপরাধের সঙ্গেও কেউ জড়িত নয়। প্রতিবছর আমরা সরকারকে বিপুল পরিমাণ কর দিই। '
এমপি বদি বলেন, 'টেকনাফ বন্দরের বেশির ভাগ ব্যবসাই মিয়ানমারের সঙ্গে। মিয়ানমারের ব্যবসায়ীরা আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে সব সময়ই ক্ষমতাসীনদের বেশি বিশ্বাস করেন। এ কারণে তাঁরা বেশির ভাগ ব্যবসা আমার সঙ্গে করতেই আগ্রহী। তবে আমি তো কাউকে ব্যবসা করতে বাধা দিচ্ছি না। অন্যরা চাইলেই ব্যবসা করতে পারে।'
কাইয়ুকখালী নামে নিজের অবৈধ ও ব্যক্তিগত বন্দর দিয়ে প্রতিনিয়ত ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদক, অস্ত্রসহ বিপুল পরিমাণ চোরাই মালামাল ঢোকার কথা অস্বীকার করে এমপি বদি বলেন, 'এ নামে আদৌ কোনো বন্দরই নেই। আমার ব্যক্তিগত কোনো ঘাটও নেই। টেকনাফের বেশির ভাগ তরুণ-যুবক ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদক ব্যবসা ও চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত।'
বিভিন্ন সময় অনেককে মারধর করার বিষয়ে জানতে চাইলে এমপি বদি বলেন, 'সব ঘটনা সত্য নয়। আপনারা অনেক খবরই জানেন না। নির্বাচনী ম্যাজিস্ট্রেটকে মারধরের মামলটি যেহেতু আদালতে বিচারাধীন, তাই আমি এ বিষয়ে মন্তব্য করব না। তবে সবশেষ স্কুলের প্রধান শিক্ষক মঞ্জুর আলমকে মারধরের যে খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, ওই শিক্ষক নিজেই সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ। তিনি শিক্ষক নামের কলঙ্ক। একজন স্কুলশিক্ষক কিভাবে বাজার কমিটির সভাপতি হন? তিনি শিক্ষক হয়ে কিভাবে শ্রমিক ফেডারেশনের নেতা হন?'

নানা কৌশলে সীমান্তে হত্যা-নির্যাতন চলছেই by মেহেদী হাসান

Saturday, September 24, 2011

ভারতের পক্ষ থেকে বারবার আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও সীমান্তে নিরস্ত্র বাংলাদেশি হত্যা বন্ধ হয়নি, বরং সাম্প্রতিক সময়ে সিলেট সীমান্তে বাংলাদেশিদের ওপর ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) পাশাপাশি সে দেশের খাসিয়া জনগোষ্ঠীর লোকজনও গুলি ছুড়ছে। সীমান্তে ভারতের নির্মিত কাঁটাতারের বেড়া বিদ্যুতায়িত করে রাখার কারণে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এবং বিএসএফের ছোড়া পাথরের আঘাতে বাংলাদেশি নাগরিক হতাহত হচ্ছে। আটকের পর নিতম্বে ইনজেকশনের মাধ্যমে পেট্রল-জাতীয় তরল পদার্থ পুশ করে নতুন কায়দায় নির্যাতনের ঘটনাও ঘটছে।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সীমান্ত সম্মেলনে সীমান্তে নিরস্ত্র বাংলাদেশি হত্যা ও নির্যাতনের এ বিষয়গুলো উঠবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। আজ রবিবার ঢাকায় শুরু হচ্ছে বিজিবি ও বিএসএফের মহাপরিচালক পর্যায়ের এ সম্মেলন। চলবে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। ছয় দিনের সম্মেলন হচ্ছে পিলখানায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদর দপ্তরে। এর আগে গত মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে নয়াদিলি্লতে পাঁচ দিনব্যাপী সীমান্ত সম্মেলন হয়। রীতি অনুযায়ী এবারের সম্মেলন হচ্ছে ঢাকায়।
গতকাল বিজিবির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, এবারের সীমান্ত সম্মেলনে বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোসহ আরো কিছু দ্বিপক্ষীয় ইস্যু নিয়ে আলোচনা হবে।
সম্মেলনে যোগ দিতে বিএসএফ মহাপরিচালক রমন শ্রীবাস্তবের নেতৃত্বে ২১ সদস্যের ভারতীয় প্রতিনিধিদল আজ রবিবার ঢাকায় এসে পেঁৗছবেন। সম্মেলনে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আনোয়ার হোসেন ২৩ সদস্যের বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন।
সীমান্তে হত্যা-নির্যাতন : বাংলাদেশের বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের হিসাব অনুযায়ী, ২০০০ সাল থেকে গত আগস্ট মাস পর্যন্ত বিভিন্ন সীমান্তে মোট ৯৯৮ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছে। এর মধ্যে বিএসএফের হাতে ৯২৩ এবং ভারতীয় বেসামরিক নাগরিকদের হাতে ৭৫ জন। একই সময়ে বিএসএফের হাতে ৬৬১ এবং ভারতীয় বেসামরিক নাগরিকদের হাতে ৩৩৫ জন বাংলাদেশি আহত হয়। প্রায় ১১ বছরে সীমান্তে ৯৫৭ জন অপহৃত এবং ১০৭ জন বাংলাদেশি নিখোঁজ হয়। ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৪ জন বাংলাদেশি।
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ গত বছর এক প্রতিবেদনে সীমান্তে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের পরও বিএসএফ জওয়ানরা পার পেয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছে।
জানা গেছে, সিলেটের গোয়াইন ঘাট উপজেলার পান্তুমাই গ্রামের আবদুল মজিদের ছেলে তেরা মিয়া (১৮) গত ১১ সেপ্টেম্বর পাদুয়া সীমান্তে বাংলাদেশি ভূমিতে গরু চরানোর সময় গুলিবিদ্ধ হন। সীমান্তের ওপর থেকে আসা ওই গুলি বিএসএফ ছোড়েনি। তাদের উপস্থিতিতে ভারতীয় খাসিয়ারা গুলি করে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ঘটনায় বিজিবির পক্ষ থেকে বিএসএফের কাছে প্রতিবাদলিপি পাঠানো হয়। এর আগে ১২ আগস্ট ওই সীমান্তের বিছনাকান্দি এলাকায় কামাল উদ্দিন জহুর (৩২) ও কামাল আহমদ (৩০) নামের দুই বাংলাদেশি পাথর কোয়ারিতে কাজের সময় ভারতীয় খাসিয়াদের গুলিতে নিহত হন।
অধিকারের তথ্য অনুযায়ী, গত আগস্টে বিএসএফ একজন বাংলাদেশিকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করেছে। বিএসএফের গুলিতে আহত হয় আরো একজন। এর আগে ২২ জুলাই চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা থানার ঠাকুরপুর গ্রামের লিয়াকত হোসেনের ছেলে মো. সেলিম উদ্দীন (২২) ভারতের রাঙ্গিয়ারপোতা থেকে ৯০ নম্বর সীমান্ত পিলারের পাশ দিয়ে দেশে ফেরার পথে বাঁশের বিদ্যুতায়িত বেড়ায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান। চোরাচালান রোধের অজুহাতে বিএসএফ রাত ৮টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত সীমান্তের এ বেড়ায় ১১ হাজার ভোল্টের বৈদ্যুতিকসংযোগ দিয়ে বিদ্যুতায়িত করে রাখে বলে অভিযোগ রয়েছে। সীমান্তে যেখানে কাঁটাতারের বেড়া এখনো নির্মিত হয়নি, সেখানে বাঁশ দিয়ে বেড়া দিয়েছে ভারত।
মে মাসের প্রতিবেদনে অধিকার বলেছে, গত ৭ মে দিনাজপুর জেলার সুন্দরা সীমান্ত এলাকায় ফয়জুর রহমানের ছেলে হাফিজুর রহমান (৩০) বিএসএফের গুলিতে নিহত হন। এর আগের দিন কুড়িগ্রামের রাজিবপুর সীমান্তে রউফ মিয়া নামের এক বাংলাদেশি কৃষককে বিএসএফ অপহরণ করে নিয়ে যায়।
গোয়াইনঘাট উপজেলার ভিতরগুল গ্রামের আবদুল মালেকের ছেলে রুবেলকে (১৬) গত এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সিলেটের গোয়াইনঘাট সীমান্তে অপহরণের পর গুলি করে হত্যা করে ভারতীয় খাসিয়ারা। নিহতের পরিবার ও স্বজনরা জানিয়েছে, এই কিশোর তার দুই বন্ধুসহ সীমান্তের কাছাকাছি বাংলাদেশের ভূখণ্ডেই পায়চারি করছিল। গত ১৮ এপ্রিল সাতক্ষীরা জেলার গাজীপুর সীমান্তে মনসুর আলীর ছেলে রেকাতুল ইসলাম (১৭) বিএসএফের গুলিতে মারা যায়।
বারবার আশ্বাস : গত ৭ জানুয়ারি কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার অনন্তপুর সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার সময় বিএসএফের গুলিতে কিশোরী ফেলানি নিহত হওয়ার কয়েক দিন পরই ঢাকায় বাংলাদেশ ও ভারতের স্বরাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক হয়। বৈঠকে ভারতীয় স্বরাষ্ট্রসচিব গোপাল কৃষ্ণ পিল্লাই সীমান্তে হত্যা বন্ধের আশ্বাস দেন। এর আগেও প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন পর্যায়ে আশ্বাস দিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি জানিয়ে সাংবাদিকরা এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ভারতের স্বরাষ্ট্রসচিব বলেছিলেন, 'ভারত আবারও সীমান্তে হত্যার সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনার আশ্বাস দিচ্ছে এবং এটি নিশ্চিত করতে বিএসএফ সদস্যের সঙ্গে কাজ করছে।'
ভারতীয় স্বরাষ্ট্রসচিবের নতুন করে আশ্বাসের পরও সীমান্তে হত্যা দৃশ্যত থামেনি। ওই মাসে মোট চারজন বাংলাদেশি বিএসএফের গুলি ও নির্যাতনে নিহত হয়। পরের মাসে বিএসএফের নির্যাতনে এক বাংলাদেশি নিহতসহ ছয়জন আহত হয়। মার্চ মাসে দুজন বাংলাদেশি সীমান্তে নিহত হয়েছে ভারতীয় বেসামরিক নাগরিকের গুলিতে। একই মাসে বিএসএফের গুলিতে আহত হয় ২১ জন। এপ্রিল মাসে বিএসএফের গুলিতে পাঁচ ও ভারতীয় বেসামরিক ব্যক্তিদের গুলিতে একজন বাংলাদেশি প্রাণ হারায়। ওই মাসেই বিএসফের গুলি ও নির্যাতনে আহত হয় ১২ বাংলাদেশি। অন্যদিকে, ভারতীয় বেসামরিক ব্যক্তিদের গুলিতে আহত হয় আরো দুজন। মে মাসে বিএসএফের গুলি ও নির্যাতনে চারজন এবং ভারতীয় বেসামরিক ব্যক্তিদের নির্যাতনে একজন বাংলাদেশির মৃত্যু হয়। জুনে বিএসএফের গুলিতে দুজন এবং নির্যাতনে একজন নিহত হয়। জুলাই মাসে বিএসএফের গুলিতে একজন এবং নির্যাতনে দুজন মারা যায়। আগস্ট মাসে মারা যায় বিএসএফের হাতে একজন। এ সময় ভারতীয় বেসামরিক নাগরিকদের গুলিতে নিহত হয় আরো দুজন।
আশ্বাস সত্ত্বেও সীমান্তে হত্যা-নির্যাতন চলার বিষয়ে গত ৭ জুন ঢাকায় সাংবাদিকরা জানতে চাইলে সফররত ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব (বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রাষ্ট্রদূত) নিরুপমা রাও বলেছিলেন, 'আমরা সব ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে। অনেক সময় ভারতীয়রা মারা যায়, কখনো কখনো বাংলাদেশিরা। কারো মৃত্যুই আমাদের কাম্য নয়। রাতে সীমান্তে কারফিউ থাকে। চোরকারবারীরা সাধারণত রাতে সীমান্ত অতিক্রম করে। নিরস্ত্র সাধারণ মানুষও করে। আমরা এ হত্যা বন্ধে রূপরেখা নিয়ে কাজ করছি। এর মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে সীমান্তের কয়েকটি অংশে বিএসএফকে প্রয়োজনে প্রাণঘাতী নয় এমন অস্ত্র ব্যবহার করতে বলা হয়েছে।'
এরপর ৭ জুলাই ঢাকা সফরের সময় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণা সাংবাদিকদের বলেন, 'সীমান্তে এখনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চলছে। অপরাধ ঠেকানোর সর্বশেষ উপায় হলো হত্যা। হতাহতের শিকার হওয়া ৪০ শতাংশ ভারতীয় নাগরিক। বাংলাদেশের মতো বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্রের নাগরিকদের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়ার জন্য বিএসএফকে বলা হয়েছে। সীমান্ত একটি স্পর্শকাতর ইস্যু।'
গত ৩০ জুলাই ঢাকায় সফরকালে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি নিহত হওয়াবিষয়ক এক প্রশ্নের উত্তরে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সীমান্ত পাড়ি দেওয়া ব্যক্তিদের লক্ষ্য করে যাতে কোনো অবস্থাতেই গুলি ছোঁড়া না হয়, সেজন্য বিএসএফ জওয়ানদের কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ওই নির্দেশনা দেওয়ার পর এ বছর সীমান্তে নিহতের সংখ্যা সাতে নেমে এসেছে। বিএসএফ জওয়ানরা হামলার শিকার হয়ে আত্মরক্ষার্থে গুলি ছুঁড়তে বাধ্য হয়েছে বলে তিনি জানান।
হত্যা বন্ধে ভারতীয় কৌশল : নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কূটনীতিক কালের কণ্ঠকে বলেছেন, সীমান্তে হত্যা বন্ধে কয়েক মাস আগে বিএসএফ পরীক্ষামূলকভাবে প্রাণঘাতী নয় এমন অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর দৃশ্যত ওই বাহিনীর গুলিতে হতাহতের ঘটনা কমেছে। কিন্তু বিএসএফের উপস্থিতিতে সীমান্তে বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে ভারতীয় বেসামরিক নাগরিকদের অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ অত্যন্ত উদ্বেগের। কার স্বার্থে কে ওই অস্ত্রের জোগান দেয়, তার অনুসন্ধান করা উচিত।
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম কেবল আত্মক্ষার্থেই বিএসএফ গুলি চালায় বলে যে মন্তব্য করেছিলেন, তা খুব একটা ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন না ওই কূটনীতিক। তিনি বলেন, প্রতিটি হতাহতের ঘটনাতেই বিএসএফ আত্মরক্ষার্থে গুলি করেছে বলে দাবি করে থাকে। অথচ হতাহতদের নিরস্ত্র অবস্থায় পাওয়া যায়।
বিজিবির সাবেক এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, মারণাস্ত্রের বিকল্প ব্যবহারের কথা শুনে তিনি খুব একটা আশাবাদী ছিলেন না। সবাই গুলি বন্ধের দাবি করে। কিন্তু গুলি ছাড়াও শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে হতাহতের অনেক ঘটনা ঘটে। এগুলোও বন্ধ হওয়া উচিত।
গত ২২ জুন বিএসএফের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (ডিআইজি) পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বিবিসিকে মারণাস্ত্রের বিকল্প ব্যবহার শুরুর কথা নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, বিএসএফ জওয়ানদের হাতে পাম্প অ্যাকশন গান বা ছড়রা বন্দুক তুলে দেওয়া হয়েছে, যা সাধারণত ছোট আকারের পাখি মারার কাজে ব্যবহার করা হয়।
বিএসএফের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশিদের নিতম্বে ইনজেকশনের মাধ্যমে পেট্রল পুশ করার অভিযোগও উঠেছে। জানা গেছে, যশোর জেলার শার্শা উপজেলার সীমান্তবর্তী ধান্যখোলা গ্রামের আবদুস সামাদের ছেলে শরিফুল ইসলাম (২৬), মিজানুর রহমানের ছেলে শাহিন (২৫) ও ময়েনুদ্দিনের ছেলে মুলফিক্কারকে (২৫) বিএসএফ গত ১৬ জুন রাতে হকিস্টিক ও লাঠি দিয়ে পিটিয়ে নিতম্বে দুই সিরিঞ্জ করে পেট্রল পুশ করে।
ঢাকায় আজ থেকে সীমান্ত সম্মেলন
গত ৩০ জুলাই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা স্বাক্ষর হয়। এ ছাড়া গত ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ঢাকা সফরের সময় '৭৪-এর স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য একটি প্রটোকল স্বাক্ষর হয়। এবারের সীমান্ত সম্মেলন ওইসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
বিজিবির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সম্মেলনের আলোচ্যসূচিতে রয়েছে সীমান্ত এলাকায় নিরস্ত্র বাংলাদেশিদের গুলি করে হত্যা ও আহত করা, অবৈধভাবে আন্তর্জাতিক সীমান্ত অতিক্রম বা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ, বাংলাদেশিদের আটক ও ধরে নিয়ে যাওয়া, বাংলাদেশি নাগরিক অপহরণ ইত্যাদি।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরো জানানো হয়, ভারতীয় প্রতিনিধিদলে থাকবেন বিএসএফ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, ফ্রন্টিয়ার ইন্সপেক্টর জেনারেল (আইজি), ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। সম্মেলন উপলক্ষে বিশেষ অতিথি হিসেবে বিএসএফ মহাপরিচালকের স্ত্রীও বাংলাদেশ সফর করবেন।
বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলে বিজিবির উপমহাপরিচালক, পরিচালক (অপারেশন ও প্রশিক্ষণ), সংশ্লিষ্ট সেক্টর কমান্ডার, বিজিবি সদর দপ্তরের স্টাফ অফিসার ছাড়াও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর এবং যৌথ নদী কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অংশ নেবেন।
আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর জয়েন্ট রেকর্ড অব ডিসকাশন্স (জেআরডি) স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে সম্মেলন শেষ হবে বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।

তিতাসের সাড়ে ৯০০ কোটি টাকা 'নাই' by আরিফুজ্জামান তুহিন

রকারি গ্যাস বিতরণ কম্পানি তিতাসের ব্রাহ্মণবাড়িয়া-আশুগঞ্জ এলাকা আরেক সরকারি প্রতিষ্ঠান বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানির কাছে বিক্রি হয়ে গেছে। এই বিক্রি-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তিতাসের প্রায় সাড়ে ৯০০ কোটি টাকা 'নাই' হয়ে গেছে। তিতাসের অডিট করা হিসাব বাদ রেখে পেট্রোবাংলা নিজেরা অডিট করে ওই সম্পদের মূল্য প্রায় হাজার কোটি টাকা কম দেখিয়ে বিক্রি করে দিয়েছে। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আশঙ্কা করছেন, পরবর্তী সময়ে বাখরাবাদকে কম টাকায় বেসরকারি খাতে বেচে দেওয়া এবং পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ ফাঁকি দেওয়ার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জ্বালানি মন্ত্রণালয় ও পেট্রোবাংলার নির্দেশেই এটা করা হয়েছে।

জানা গেছে, তিতাসের ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও আশুগঞ্জ এলাকাটি বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানির কাছে ২৬৮ কোটি ২০ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। অথচ তিতাসের নিয়োজিত অডিট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এলাকাটির মূল্য এক হাজার ২০৭ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। সেই হিসাবে ৯৩৯ কোটি ২৫ লাখ টাকার কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান হোসেন মনসুর কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এগুলো হলো পেট্রোবাংলার অধীন কম্পানি। তিতাস তাদের নিয়োজিত অডিট ফার্ম দিয়ে নিজেদের মতো হিসাব করে অঞ্চলটির মূল্য অনেক বেশি দেখায়। তিতাসের হিসাব ও বাখরাবাদের হিসাব দুই রকম হওয়ায় পেট্রোবাংলা আরেকটি কম্পানিকে দিয়ে অডিট করিয়ে মন্ত্রণালয়কে বিক্রির সুপারিশ করে।' তিনি বলেন, তিতাসের এ অঞ্চলটি হস্তান্তরও হয়ে গেছে। তিতাসের বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত বাতিল না করে কেন পেট্রোবাংলা এ রকম সিদ্ধান্ত নিল_এমন প্রশ্নের জবাবে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, 'দীর্ঘদিন বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বাংলাদেশের জ্বালানি খাত বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার জন্য সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে আসছে। সেই চাপেরই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে এখানে। তিতাস একটি লাভজনক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, এই প্রতিষ্ঠানকে হুট করে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না। তাই ধীরে ধীরে তারা এভাবে বাস্তবায়ন করছে।' তিনি আরো বলেন, 'কম দাম দেখিয়ে তিতাসের ব্রাহ্মণবাড়িয়া-আশুগঞ্জ এলাকা ছেড়ে দেওয়া হলো, এর কারণ পরবর্তী সময়ে বাখরাবাদ যখন বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হবে, তখন এই
প্রতিষ্ঠানের মূল্য যেন কম দেখানো যায়। বেসরকারীকরণ হলে তা বিদেশি বহুজাতিক কম্পানির হাতে চলে যাবে। এর ভাগ স্থানীয় কিছু দালাল লুটেরাও পাবে। জ্বালানি খাত বিদেশি বহুজাতিক কম্পানি দখলের যে চেষ্টা করছে, এটা সেই ষড়যন্ত্রেরই অংশ।'
তিতাস সূত্রও জানায়, বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানি বেসরকারি খাতে ছাড়ার চক্রান্ত চলছে। এদের সহায়তায় বাখরাবাদ চলে যাবে ব্যবসায়ীদের হাতে। তিতাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হস্তান্তর শেষ হয়েছে, এখন খুব শিগগির পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হবে বাখরাবাদ। পুঁজিবাজারে বাখরাবাদের তালিকাভুক্ত হওয়ার বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে অনুমোদিত হয়ে আছে। তিতাসের শেয়ারহোল্ডারদের আর্থিকভাবে ঠকানোর জন্যই মূল্য কম দেখানো হয়েছে বলে সূত্র অভিযোগ তুলেছে।
সূত্রে জানা যায়, তিতাস মেসার্স আহমেদ অ্যান্ড আকতার নামের একটি ফার্ম দিয়ে অডিট করায়। তারা তিতাসের এ এলাকাটির মূল্য এক হাজার ২০৭ কোটি ৪৫ লাখ এক হাজার ৬৫৪ টাকা বলে প্রতিবেদন দেয়। প্রতিবেদনটি গত বছরের ১৯ অক্টোবর তিতাসের ৬১৩তম সভায় অনুমোদনও করা হয়। ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, বাখরাবাদ শতকরা ২০ ভাগ টাকা এককালীন (ডাউন পেমেন্ট) দেবে, বাকিটা ১৫ বছরের কিস্তিতে পরিশোধ করবে। ২৫ অক্টোবর এই সিদ্ধান্ত পেট্রোবাংলাকে জানিয়ে দেয় তিতাস কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশন (এসইসি), ডিএসই ও সিএসইকেও জানানো হয়। তিতাসের এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না করে নতুন করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-আশুগঞ্জ অঞ্চলটি অডিট করায় পেট্রোবাংলা। তাদের মনোনীত অডিট ফার্ম হোদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কম্পানি তিতাসের ওই অঞ্চলটির মূল্য নির্ধারণ করে ২৬৮ কোটি ২০ লাখ টাকা। চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি পেট্রোবাংলার ৪১৭তম বোর্ড সভায় তা অনুমোদনও করা হয়।
তিতাসের বোর্ড সভায় পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানও সদস্য। পেট্রোবাংলার এই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে মো. আলাউদ্দিন ও মো. সাঈদ নামের তিতাস গ্যাসের দুজন শেয়ারহোল্ডার হাইকোর্টে একটি রিট মামলা (নং-৫৮১৭/২০১১) করেন। রিট আবেদনটি উচ্চ আদালত খারিজ করে দেন। রিট আবেদনকারীরা তখন খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেন।
রিট আবেদনকারীর আইনজীবী মো. নুরুল ইসলাম চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মামলাটি বর্তমানে চূড়ান্ত শুনানির অপেক্ষায় আছে। আদালত খুললে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পাওয়া যাবে।'
পেট্রোবাংলার কাছে তিতাসের অডিট প্রতিবেদনের চিঠি পাঠানোর প্রায় পাঁচ মাস পর গত ২৪ মার্চ পেট্রোবাংলা তিতাসকে চিঠি দিয়ে এলাকাটির নতুন মূল্যের বিষয়টি অবহিত করে। পেট্রোবাংলার মনোনীত হোদা ভাসি অডিট ফার্মের প্রতিবেদনটি গত ২০ মে তিতাসের বোর্ড সভায় 'বাস্তবতাবর্জিত' বলে মত দেন কম্পানির পরিচালকরা। সরকার ও সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন সে জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও আশুগঞ্জ প্রকল্পের উপযুক্ত মূল্য নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ওই সভায়। এ কারণে পরবর্তী সময়ে আরো আলোচনা করার সুপারিশও করা হয়।
জানা যায়, তিতাসের পরিচালনা বোর্ডের কাছে হোদা ভাসির করা অডিট প্রতিবেদনের হিসাবে বেশ গরমিল ধরা পড়ে। পেট্রোবাংলার অডিটে মেনটেইনেবল প্রফিট পদ্ধতিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-আশুগঞ্জ এলাকার ভবিষ্যৎ রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে শতকরা মাত্র ২ ভাগ। অথচ তিতাসের ২০০৮-০৯, ২০০৯-১০ এবং ২০১০-১১ অর্থবছরে ওই এলাকার রাজস্ব প্রবৃদ্ধি যথাক্রমে ১৩.৪৯, ১৭.১৭ ও ১২.৪৬ শতাংশ। পেট্রোবাংলার অডিটে ওই এলাকায় গ্যাসস্বল্পতার কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে তিতাস কর্তৃপক্ষের দাবি ব্রাহ্মণবাড়িয়া-আশুগঞ্জ এলাকায় কোনো গ্যাসস্বল্পতা নেই।
তিতাস বোর্ড সূত্রে জানা যায়, হোদা ভাসির করা অডিট প্রতিবেদনে ডিসকাউন্ট ক্যাশ ফ্লো (ডিসিএফ) পদ্ধতিতে ২০১০-১১ অর্থবছরে এলাকাগুলোর আর্নিং বিফোর ইন্টারেস্ট অ্যান্ড ট্যাঙ্সে (ইবিআইটি) ধরা হয়েছে ৩৯২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এটা আগের বছরের তুলনায় শতকরা ৫৩ দশমিক ৫৬ ভাগ কম। অথচ এর আগের বছরে এ ক্ষেত্রে আয় ছিল ৯০৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা।
তিতাসের দাবি, এ হিসাব নিরীক্ষণের কোনো আইনি এখতিয়ার নেই পেট্রোবাংলার। কেননা তিতাস পেট্রোবাংলার অধীন কম্পানি হলেও তারা একটি স্বতন্ত্র কম্পানি। শুধু এই দুটি প্রকল্পের দাম কম দেখাতেই পেট্রোবাংলা নিজেদের মতো অডিট করিয়েছে বলে তিতাসের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অভিযোগ করেন।
এত কিছুর পরও তিতাসের ৬৩০তম বোর্ড সভায় হোদা ভাসির অডিট প্রতিবেদনটির অনুমোদন দেওয়া হয়। তিতাসের বোর্ড সভার এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'তিতাস বাধ্য হয়েই অনুমোদন দিয়েছে। এর পেছনে মন্ত্রণালয় ও পেট্রোবাংলার বড় ধরনের চাপ ছিল।'
অন্যদিকে যে কম্পানি তিতাসের এলাকাটি কিনে নিচ্ছে সেই বাখরাবাদ কোনো অডিট করেনি। নিয়মানুযায়ী বাখরাবাদেরও অডিট করার কথা। তিতাস পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কম্পানি হওয়ায় হিসাবটি এসইসি, ডিএসই ও সিএসইরও মূল্যায়ন করার কথা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এসইসির নির্বাহী পরিচালক এ টি এম তারিকুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এ ব্যাপারে কোনো কাগজপত্র আমাদের কাছে আসেনি। তাই আমরা কিছু বলতে পারছি না।' তবে এসইসির একটি সূত্র দাবি করে, এটি একটি খারাপ নজির।
তিতাসের জনসংযোগ কর্মকর্তা সূত্রে জানা যায়, তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুল আজিজ খান স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য ভারতে অবস্থান করছেন। তাঁর ফিরতে দেরি হবে। তিতাসের ভারপ্রাপ্ত এমডি ও পেট্রোবাংলার প্রশাসন বিভাগের পরিচালক মো. রফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে 'তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গে কোনো কথা বলবেন না'_এ কথা তাঁর অধীন কর্মকর্তাদের বলে দিয়েছেন বলে অফিস সূত্রে জানা যায়।

কবে হবে চার লেন by হকিকত জাহান হকি ও তৌফিকুল ইসলাম বাবর

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ কাজ কবে শেষ হবে? বিদ্যমান দুই লেনের সড়কটি চার লেনে উন্নীত করতে ১৯৬৭ সালে জমি অধিগ্রহণ করা হলেও এর মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়েছে ২০১০ সালে। গত ৪৪ বছরেও নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি 'ইকোনমিক লাইফ লাইন' হিসেবে ব্যবহৃত এ সড়কটি। চট্টগ্রামসহ সারাদেশের শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সার্বিক অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করে এ সড়কটি। সব ধরনের আমদানি-রফতানি পণ্য আনা-নেওয়া হয় এ সড়ক দিয়েই। এ সড়কটি চার লেনে উন্নীত করার পর শুরু হবে 'ঢাকা-চট্টগ্রাম অ্যাক্সেস কন্ট্রোল হাইওয়ে'। এ সড়কটি হবে বিশেষায়িত।

২০১৩ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা; কিন্তু গত দেড় বছরে কাজ হয়েছে মাত্র ২৫ শতাংশ। হাতে সময় রয়েছে মাত্র ৯ মাস। এ সময়ে প্রকল্পের বাকি ৭৫ শতাংশ কাজ শেষ করা প্রায় অসম্ভব। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত দেড় বছরে প্রকল্পের ৫০ শতাংশ কাজ হলেই কেবল নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করা যেত। কিন্তু তা হয়নি। বর্তমানে প্রকল্পের কাজ যেভাবে এগোচ্ছে তাতে বাকি কাজ শেষ হতে বাড়তি আরও এক বছর সময় লেগে যেতে পারে। অর্থাৎ ২০১৪ সালের জুনের আগে চার লেনের কাজ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।
বর্ষার কারণে সাড়ে তিন থেকে চার মাস ধরে প্রকল্পের কাজ বন্ধ
থাকার পর ক'দিন আগে থেকে শুরু হয়েছে। এর আগে ঠিকাদারদের ওয়ার্ক অর্ডার দেওয়া হলেও ভারতীয় প্রতিষ্ঠান দেব কনসালট্যান্ট লিমিটেডকে কনসালট্যান্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া নিয়ে সৃষ্ট জটিলতায় ৭-৮ মাস সময়ক্ষেপণ, নতুন লেন নির্মাণে মাটি সংকট, মন্ত্রণালয় থেকে যথাসময়ে অর্থ ছাড় না করা, সর্বোপরি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজে ধীরগতির কারণে নির্ধারিত সময়ে শেষ করা যাচ্ছে না প্রকল্পের কাজ। তবে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা না গেলেও যত
দ্রুত সম্ভব শেষ করতে সরকারের পক্ষ থেকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। প্রকল্পের বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন, প্রকল্প পরিচালনার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা ও প্রকল্পের দেশি-বিদেশি তিন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই, পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএসহ বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে চার লেনের সড়ক নির্মাণের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছিল। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে বন্দরনগরী ও প্রধান বাণিজ্যিক শহর চট্টগ্রামের উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য চার লেনের সড়কের দাবি আজ সব শ্রেণী-পেশার মানুষের। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে পুরোপুরিভাবে সরকারি অর্থায়নে।
সরকারের এক হিসাব থেকে জানা গেছে, জিডিপিতে এ মহাসড়কের অবদান ৩০ শতাংশ। প্রতিদিন গড়ে ১৬ হাজার হালকা ও ভারী যানবাহন চলাচল করে এ সড়ক দিয়ে। এর মধ্যে পণ্যবাহী ৬০ ভাগ যানবাহন চলাচল করে এ সড়ক দিয়েই।
যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন সমকালকে বলেন, নির্মাণ ব্যয় মেটানোর জন্য যথাসময়ে পর্যাপ্ত টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দেশের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ চার লেনের সড়কটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, সর্বশেষ ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ১১৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বাকি টাকা চলতি ও আগামী অর্থবছরের মধ্যে বরাদ্দ দেওয়া হলে নির্মাণকাজ অনেকটা এগিয়ে যাবে। মাটি ভরাটসহ অন্যান্য কাজ পুরোদমে চলছে বলে মন্ত্রী জানান।
যোগাযোগমন্ত্রী আরও বলেন, টেন্ডার প্রক্রিয়ার জন্য নির্মাণকাজ শুরু করতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। তবে আগামী ২ বছরের মধ্যে প্রাক্কলিত ব্যায়ের পুরো টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলে যথাসময়েই এ সড়কের নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, সড়কের বেশিরভাগ ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণে বেশি সময় লাগবে না। এরপর পুরোদমে শুরু হবে মাটি ভরাটের কাজ।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের পরিচালক শফিকুল ইসলাম সমকালকে বলেন, নির্মাণকাজ অব্যাহত আছে। সামনে কাজের চাপ আরও বাড়বে। সে সময় প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। অর্থের সরবরাহ থাকলে যথাসময়ে নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, পুরো কাজ সম্পন্ন করতে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ৬-৭ মাস সময় বেশি লাগতে পারে।
অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে কার্পণ্য করা হলে চার লেনে উন্নীত করার কাজ যথাসময়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট অনেকে। দাউদকান্দি থেকে চট্টগ্রাম সিটি গেট পর্যন্ত ১০ মিটার প্রস্তের ১৯২ কিলোমিটার নতুন সড়ক নির্মাণে চলতি অর্থবছরে ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হলে দেওয়া হয় ১১৩ কোটি টাকা। মাটি ভরাট, ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণকাজে আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যে এ টাকা শেষ হয়ে যাবে। এরপর হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হবে ঠিকাদারদের। তখন অর্থ বরাদ্দের জন্য আবারও ছোটাছুটি শুরু করতে হবে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে। চার লেনের এ নতুন সড়ক নির্মাণে এ পর্যন্ত গড়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মাটি ভরাটের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
বিদ্যমান সড়ক দিয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে ডান পাশ দিয়ে নির্মিত হচ্ছে ১০ মিটার প্রস্থের নতুন সড়কটি। ১০ মিটার প্রস্থের বিদ্যমান সড়কটি দুই লেনবিশিষ্ট। প্রস্থের দিক থেকে একই মাপের দুই লেনের নতুন সড়কটিসহ প্রায় তিনশ' কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়টি হবে চার লেনের। চার লেনের সড়কের মাঝখানে থাকবে ৬ মিটারের ডিভাইডার। এর মধ্যে ঢাকা থেকে দাউদকান্দি পর্যন্ত ৩৯ কিলোমিটার সড়ক চার লেন করা হয়েছে বেশ আগে।
পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী সমকালকে বলেন, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কটি যেভাবে উন্নীত করার কথা ছিল গত ৪০ বছরেও তা হয়নি। এতে রফতানি খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, এখন পণ্যবাহী একটি গাড়ি ঢাকা থেকে ছাড়লে তা কখন চট্টগ্রামে পেঁৗছবে নিশ্চিত করে বলা যায় না। চার লেনে উন্নীত হলে এ সংকট থাকবে না। কোনো কারণে নির্মাণকাজ যেন পিছিয়ে না যায় সে জন্য সরকারের সব ধরনের সহায়তা অব্যাহত রাখার দাবি জানান তিনি।
মহাসড়কের বর্তমান অবস্থা : ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক এখন রীতিমতো মহাদুর্ভোগের মহাসড়কে পরিণত হয়েছে। এমনিতেই সড়কটির নাজুক অবস্থা। তার ওপর ভারী বৃষ্টিতে অবস্থার আরও অবনতি ঘটেছে। সড়কটির স্থানে স্থানে শুধু দেবেই যায়নি অনেক স্থানে সৃষ্টি হয়েছে বড় খানাখন্দ। সড়কের বিভিন্ন জায়গা উঁচু-নিচু হয়ে যাওয়ায় ব্যাপক ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। গাড়িতে স্বাভাবিক গতি তোলা যাচ্ছে না। প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হচ্ছে দীর্ঘ যানজট। সর্বোচ্চ ছয় ঘণ্টায় ঢাকা-চট্টগ্রামে চলাচলের কথা থাকলেও এখন সময় লেগে যাচ্ছে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা। সম্প্রতি সড়কটি যানবাহন চলাচলের প্রায় অযোগ্য হয়ে পড়লে সরকার চুক্তি অনুযায়ী চার লেন প্রকল্পের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সড়কের কিছুটা সংস্কার-মেরামত করলেও পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি হয়নি; কিন্তু দায়সারা গোছের কাজের কারণে তা খুব বেশি টেকসই হয়নি।
মহাসড়কে চলাচলকারী গাড়িচালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মহাসড়কের কমপক্ষে ৩০টি পয়েন্ট এখনও ছোট-বড় খানাখন্দে ভরা। এর মধ্যে সড়কের মিরসরাইয়ের ১০টি, সীতাকুণ্ডের ৫টি, কুমিল্লার ১০টি এবং ফেনীর ৪টি পয়েন্টের অবস্থা খুবই নাজুক। সড়কের মিরসরাইয়ের বড় দারোগাহাট, নিজামপুর কলেজ, হাদিফকির হাট, বড়তাকিয়া, মিরসরাই সদর, মিঠাছড়া, জোড়ারগঞ্জ, বারৈয়ারহাট পৌর সদর, ইসমাইল কার্পেট মিল এলাকা, ছোটকমলদহ বাইপাস মোড় ও মিরসরাই সদর, সীতাকুণ্ডের উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন বাইপাস সড়ক, মছইদ্দা স্কুলের সামনের মোড়, ফৌজদারহাট পোর্ট কানেকটিং সড়কের সংযোগস্থল, এসকেএন জুট মিল এলাকা, ফকিরহাট ফায়ার সার্ভিস মোড়ে সড়ক সংস্কার হয়েছে জোড়াতালি দিয়ে। এ ছাড়া কুমিল্লার রায়পুর, চৌদ্দগ্রামের বাতিসাবৈদ্যের বাজার এলাকা, দক্ষিণ উপজেলার ধনাইতরী, দাউদকান্দির মেঘনা-গোমতী টোল প্লাজা মোড়, হাসনপুর, বিতপুর, ইলিয়টগঞ্জের আমিরাবাদ রাস্তার মাথা, চৌদ্দগ্রামের চিওড়া এলাকা, বুড়িচংয়ের নিমসার এবং ফেনী জেলার মুহুরীগঞ্জ, লেমুয়াব্রিজ, মহীপাল ও মোহাম্মদ আলী বাজার এলাকায় এখনও আছে ছোট-বড় গর্ত। এসব স্থানে গাড়ি চলাচল করতে হচ্ছে ঝুঁকি নিয়ে।
ঠিকাদারদের স্বেচ্ছাচারিতা : চুক্তি অনুযায়ী চার লেন প্রকল্প কাজের পাশাপাশি বিদ্যমান সড়কের রক্ষণাবেক্ষণ কাজ তিনটি ঠিকাদার কোম্পানির করার কথা থাকলেও তারা এ কাজ সঠিকভাবে করছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। খোদ যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তার কাছ থেকে এ বিষয়ে আপত্তির কথা জানা গেছে। তারা বলেছেন, অনেকটা তাদের অবহেলার কারণেই বিদ্যমান সড়কটির ছোট ছোট গর্ত আজ খানাখন্দে রূপ নিয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী প্রকল্পের কাজ চলাকালে বিদ্যমান সড়কটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের। নতুন সড়ক নির্মাণের জন্য নির্মাণ সামগ্রীসহ অন্যান্য পণ্য আনা-নেওয়া করতে হয় বিদ্যমান সড়ক দিয়ে। এ ছাড়া জনগণের চলাচল ও পণ্য পরিবহন স্বাভাবিক রাখার দায়িত্বও ঠিকাদারদের ওপর ন্যস্ত হয়। এ ক্ষেত্রে চীনা কোম্পানি সাইনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড বেশি অবহেলা করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া রেজা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড ও তাহের ব্রাদার্স লিমিটেড নামমাত্র রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করছে বলে জানা গেছে।
ঠিকাদারের বক্তব্য : রেজা কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের পরিচালক স ম মমতাজউদ্দিন বলেন, নতুন সড়কের কাজ চলাকালে বিদ্যমান সড়কটির রক্ষণাবেক্ষণের স্বাভাবিক কাজের দায়িত্ব ঠিকাদারদের ওপর ন্যস্ত থাকে। বিশেষ কারণে ব্যাপক সংস্কারের কাজ করে ঠিকাদাররা পোষাতে পারবেন না। ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের বেহাল দশা সম্পর্কে তিনি বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে সংস্কার কাজ না হওয়ায় এখন সড়কটির অবস্থা বেশ নাজুক। সড়কটি সংস্কারের জন্য আলাদাভাবে টেন্ডার ডাকা হবে। নতুন সড়ক নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত ঠিকাদাররাই এ টেন্ডারে অংশ নিয়ে সংস্কারকাজ করবেন।
মহাজোট সরকারের আমলে নির্মাণ কাজ শেষ হবে কি : বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, এ সরকারের আমলে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে হলে বাস্তবায়ন কাজে তদারক বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে যথাসময়ে যথাযথ অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। এ বছর বরাদ্দ দেওয়া ১১৩ কোটি টাকার কাজ আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে। শিগগির যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া না হলে নভেম্বরে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের কাজ বন্ধ হয়ে যাবে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এ সড়ক বাস্তবায়নে অর্থ বরাদ্দে গড়িমসি করা হলে যথাসময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে না। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন সড়ক নির্মাণের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছিল।
জানা গেছে, ক্ষমতায় আসার পর এ সরকার ১৫২টি সড়ক প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোর প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে বিভিন্ন এলাকার মন্ত্রী, এমপিদের চাপে তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ সড়ক নির্মাণে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে বেশি। এ কারণে দেশের মূল সড়ক নির্মাণকাজ পিছিয়ে যাচ্ছে। পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো, কার্যক্রম ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ যাচাই করে সড়ক প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে থাকে।
ব্রিজ, কালভার্ট, ওভার পাস, বাস বে : নতুন ১৯২ কিলোমিটার সড়কে ২৮টি ব্রিজ নির্মিত হবে। এর মধ্যে রয়েছে পাঁচটি বড় ব্রিজ। কালভার্ট নির্মাণ করা হবে ১৯৫টি। দুর্ঘটনা রোধে তিনটি রেলওয়ে ওভারপাস, দুটি আন্ডারপাস, ৩৩টি ফুটওভার ব্রিজ ও যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে দীর্ঘ সড়কের পাশে ৬১ স্থানে বাস বে নির্মাণ করা হবে।
প্রাক্কলিত ব্যয় ও বরাদ্দ : প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা। গত তিন অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৪৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১০-১১ অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া হয় ১১৮ কোটি টাকা। চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে ৭০০ কোটি টাকা চাওয়া হলে বরাদ্দ দেওয়া হয় ১১৩ কোটি টাকা।
রোড ফান্ড : সূত্র জানায়, সারাদেশের সড়ক উন্নয়নে সরকারের আলাদা কোনো তহবিল নেই। এ খাতের জন্য আলাদা তহবিলের ব্যবস্থা থাকলে জনগুরুত্বসম্পন্ন সড়ক নির্মাণে অর্থ সংকটের কথা ভাবতে হতো না সরকারকে। সরকারের মধ্যে এ তহবিল গঠনের কোনো উদ্যোগও নেই। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারতে সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়নে 'রোড ফান্ড' নামে একটি বিশেষ তহবিল রয়েছে। দেশটির ফুয়েল স্টেশন থেকে প্রতি লিটার তেল বিক্রি করে ক্রেতার কাছ থেকে ২ রুপি করে নেওয়া হয় ওই তহবিলের জন্য। এ ছাড়া সড়কের বিশেষ স্থান থেকে টোল আদায়ের টাকা জমা করা হয় ওই তহবিলে। এ তহবিলের অর্থে ভারত সরকার সর্বশেষ জয়পুর থেকে আজমীর পর্যন্ত ১৩০ কিলোমিটার সড়ক ৬ লেনে উন্নীত করছে। এর সঙ্গে রাখা হচ্ছে সার্ভিস লেন। জম্মু থেকে অমৃতসর প্রায় ৩০০ কিলোমিটার সড়কও উন্নয়ন করা হচ্ছে একই তহবিলের অর্থ খরচ করে।
ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তি : মহাসড়কটি ১০ ভাগ করে ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তি করা হয়। এর মধ্যে চীনা কোম্পানি সাইনোহাইড্রো করপোরেশন ৭টি প্যাকেজ, রেজা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড দুটি প্যাকেজ এবং তাহের ব্রাদার্স ও আল আমীন কনস্ট্রাকশন যৌথভাবে একটি প্যাকেজে কাজ পেয়েছে।
রেজা কনস্ট্রাকশন : এ কোম্পানি দুটি প্যাকেজে ৩৭ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করছে। এর মধ্যে ১নং প্যাকেজে দাউদকান্দি টোল প্লাজা থেকে কুটুম্বপুর পর্যন্ত ২২ কিলোমিটার ও ৭নং প্যাকেজে ধুমঘাট ব্রিজ থেকে মিরসরাই বাজার পর্যন্ত সাড়ে ১৫ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। দুটি প্যাকেজে ৩৩৪ কোটি টাকার কাজ পেয়েছে এ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। বর্ষার কারণে মাটি ভরাটের কাজ তেমন এগোচ্ছে না। আগামী নভেম্বর থেকে শুকনো মৌসুম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্মাণকাজ পুরোদমে শুরু হবে।
১নং প্যাকেজ : এ প্যাকেজে ২২ কিলোমিটারে ২৫ থেকে ২৮ শতাংশ মাটি ভরাট হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী এতটুকু সড়কে একটি ছোট আকারের ব্রিজ ও সাতটি কালভার্ট নির্মাণ করতে হবে। এর মধ্যে তিনটি কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। চুক্তির বাইরে আরও ছয়টি কালভার্ট নির্মাণ করতে হবে বলে জানিয়েছে নির্মাণ প্রতিষ্ঠান। ব্রিজ নির্মাণ কাজ শুরু হবে আগামী ডিসেম্বর থেকে।
৭নং প্যাকেজ : এ প্যাকেজে ১৫ কিলোমিটারে মাটি ভরাট হয়েছে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ। আগামী মার্চের মধ্যে মাটি ভরাটের কাজ পুরোপুরি শেষ হবে। ৩০টি কালভার্টের মধ্যে সাতটি নির্মিত হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এ ১৫ কিলোমিটার নতুন সড়ক নির্মাণ করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন ঠিকাদার।
ঠিকাদারের বক্তব্য : রেজা কনস্ট্রাকশনের পরিচালক স ম মমতাজউদ্দিন সমকালকে বলেন, এ সড়কটি দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সড়ক। যথাসময়ে সড়কটির নির্মাণকাজ শেষ করতে হলে সরকারের পক্ষ থেকে টাকার সরবরাহ বজায় রাখতে হবে। তিনি বলেন, সর্বশেষ বরাদ্দ দেওয়া ১১৩ কোটি টাকার কাজ আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে। এরপর হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হবে। সামনের শীত মৌসুমে কাজের চাপ বেড়ে যাবে। তখন সে অনুপাতে টাকা সরবরাহ করতে হবে। টাকার অভাবে কাজ বন্ধ থাকলে ২০১৩ সালের মধ্যে পুরো সড়কটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না।
তাহের-আল আমীন : কুমিরা বাইপাস থেকে চট্টগ্রাম সিটি গেট পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করছে তাহের ব্রাদার্স লিমিটেড ও আল আমীন কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। ১০নং প্যাকেজের আওতায় এ দুটি কোম্পানি পেয়েছে ১৭২ কোটি টাকার কাজ। তাহের ব্রাদার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল বাশার সমকালকে বলেন, তারা এরই মধ্যে ৪০ শতাংশ মাটি ভরাটের কাজ সম্পন্ন করেছেন। ১৬ কিলোমিটার রাস্তায় মাঝারি আকারের ছয়টি ব্রিজ ও নয়টি কালভার্ট নির্মাণ করতে হবে। এরই মধ্যে সাতটি কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। ব্রিজের পাইলিংয়ের কাজ চলছে। তিনি বলেন, কোনো ধরনের সংকট সৃষ্টি না হলে ২০১৩ সালের মধ্যে ১৬ কিলোমিটার সড়কের নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে।
সাইনোহাইড্রো করপোরেশন : কুটুম্বপুর থেকে ধুমঘাট ব্রিজ পর্যন্ত পাঁচটি প্যাকেজ ও মিরসরাই বাজার থেকে কুমিরা বাইপাস পর্যন্ত দুটি প্যাকেজসহ মোট সাতটি প্যাকেজে ১৩৯ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করছে চীনা কোম্পানি সাইনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড। মাটি ভরাট, কালভার্ট ও ব্রিজ নির্মাণের কাজ চলছে। জানা গেছে, দরকষাকষিতে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে সাতটি প্যাকেজের আওতায় কাজ পেয়েছে এ কোম্পানি।

ঝুঁকিতে মেঘনা সেতু by আনোয়ার হোসেন

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওপর নির্মিত মেঘনা সেতু খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। সেতুর মাঝ বরাবর ছয়টি পিলারের (ভারবাহী স্তম্ভ) আশপাশে ৫২ থেকে ৬৫ ফুট পর্যন্ত জায়গার মাটি সরে গেছে। এ ছাড়া সেতুর অনেকগুলো সম্প্রসারণশীল সংযোগ ও বিয়ারিং অকেজো হয়ে পড়েছে।

যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের নিয়োগ করা বিশেষজ্ঞরা সরেজমিন জরিপ করে এ তথ্য দিয়েছেন। জরিপ করার জন্য গত বছর সওজ জেপিজেড-মালয়েশিয়া-এইচসিইএল নামের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করে।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, পিলারের কাছের মাটি সরে যাওয়ায় এবং বিয়ারিং-সম্প্রসারণশীল সংযোগ (এক্সপানশন জয়েন্ট) ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে সেতুটির ভারবহন ক্ষমতা কমে গেছে। ফলে যানবাহন চলাচলের সময় পুরো সেতু কেঁপে ওঠে। এ জন্য যেকোনো সময় দুর্ঘটনার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক উপাচার্য এ এম এম সফিউল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, পিলারের কাছের মাটি সরে গেলে সেতুর শক্তি কমে যায়। সে ক্ষেত্রে ভূমিকম্প হলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া অতিরিক্ত পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল করলেও সেতুটির স্থায়িত্ব কমে যাবে। এটা মেরামতযোগ্য সমস্যা এবং দ্রুত মেরামত করাই একমাত্র সমাধান।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মেঘনা সেতুর সম্প্রসারণশীল সংযোগগুলোর অধিকাংশের ওপরের অংশে নাট-বল্টু খুলে পড়ে গেছে। ওপরে রাবার ও স্টিলের আবরণ উঠে গেছে। ফলে যানবাহন চলাচলের সময় বিকট শব্দ হচ্ছে, সেতু কাঁপছে।
২০০৪ সাল থেকে পিলারের মাটি সরে যাওয়া শুরু হলেও মেরামতের উদ্যোগ নেয়নি কর্তৃপক্ষ। সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (সেতু শাখা) সাইদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, দুই-তিন বছর ধরে মাটি সরে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞরা এটি মেরামতের পদ্ধতি জানিয়ে দিয়ে গেছেন। শিগগিরই মেরামত শুরু হবে। এভাবে মাটি সরে যাওয়া সেতুটির জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, সম্প্রসারণশীল সংযোগের নাট-বল্টু খুলে যাওয়ায় স্টিল ও রাবারের পাতগুলো কয়েক ইঞ্চি ফাঁকা হয়ে গেছে। অনেক স্থানে পাত নেই। যানবাহনের চাকার ঘর্ষণে কিছু কিছু পাত লাফিয়ে কয়েক ইঞ্চি ওপরে ওঠানামা করছে।
এই সেতু দিয়ে ট্রাক চালান আবুল বাশার। তিনি বলেন, সেতুর ওপরে খুব ধীরে ট্রাক চালাতে হয়। বিকট শব্দ হলে ভয় হয়। কখন না ভেঙে পড়ে। ঢাকা-কুমিল্লা পথে চলাচলকারী তিশা পরিবহনের চালক মহিউদ্দিন বলেন, এই সেতুতে দীর্ঘদিন ধরেই নাট-বল্টু খোলা দেখা গেছে।
মেঘনা সেতুর দুই প্রান্তেই সাইনবোর্ড টাঙিয়ে কর্তৃপক্ষ লিখে দিয়েছে, ‘মেরামতকাজ চলছে। যানবাহন চলাচলের সর্বোচ্চ গতিসীমা ২০ কিলোমিটার।’ তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন কোনো মেরামতকাজ চলছে না। ঝুঁকিপূর্ণ বলেই গতি কমানোর নির্দেশনা টাঙানো হয়েছে।
১৯৯১ সালে জাপান সরকারের অর্থায়নে সেতুটি নির্মিত হয়। সেতুর আয়ুষ্কাল ধরা হয় ১০০ বছর। কিন্তু ২০ বছর না যেতেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এতে ১২টি পিলার এবং ১৩টি সম্প্রসারণশীল সংযোগ রয়েছে।
যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, সেতুটি মেরামতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিশেষ বরাদ্দ চাওয়া হয়েছিল। অনুমোদনও পাওয়া গেছে। অর্থ পেলেই মেরামত শুরু হবে।
মূল সমস্যা: সেতুর পিলারের পাশে মাটি সরে যাওয়া শুরু হয় ২০০৪ সাল থেকেই। কিন্তু এ পর্যন্ত তা মেরামত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
জরিপে বলা হয়েছে, ১২টি পিলারের মধ্যে নদীর মাঝখানের তিনটি পিলারের পাশের মাটি সরে গিয়ে ৬৫ ফুট গভীর গর্ত হয়ে পড়েছে। মাঝামাঝি অন্য আরও তিনটি পিলারের পাশে মাটি সরে ৫২ ফুট গর্ত হয়েছে। মেঘনা সেতুর পিলার ১৩৩ থেকে ১৪৬ ফুট পর্যন্ত গভীর। অন্তত তিনটি পিলার যে গভীরে পাইল করা হয়েছে, তার গোড়ার অর্ধেক মাটি সরে গিয়ে গভীর গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।
সম্প্রতি সওজের নারায়ণগঞ্জ কার্যালয় থেকে প্রধান দপ্তরে চিঠি পাঠিয়ে মেঘনা সেতুর দুরবস্থার কথা জানানো হয়। মাটি সরে যাওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়, সেতুর নিচ দিয়ে গড়ে তিন হাজার টন পণ্যবাহী নৌযান চলাচল করছে। কিন্তু ৫০০ টন পণ্যবাহী নৌযান চলবে—সে হিসাব করেই নকশা করা হয়েছিল। এ ছাড়া অবাধে বালু উত্তোলন চলছে। ফলে নদীর স্রোত, নৌযানের গতি ও কম্পনের ফলে পিলারের পাশের মাটি সরে যাচ্ছে।
চিঠিতে বলা হয়, সেতুর সম্প্রসারণশীল সংযোগ ও কল-কবজাগুলো দুই থেকে আড়াই ইঞ্চি পর্যন্ত ফাঁকা হয়ে গেছে। অনেক কল-কবজা স্থানচ্যুত হয়ে পড়ায় যান চলার সময় সেতুটি অস্বাভাবিকভাবে নড়ে। এখনই মেরামত করা না হলে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
সওজ সূত্র জানায়, গোমতী সেতুর সম্প্রসারণশীল সংযোগগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মেঘনা সেতুর তিন বছর পর গোমতী সেতু চালু হয়। এই দুটি সেতু খুব কাছাকাছি। দুটি সেতুর জন্য একসঙ্গেই টোল আদায় করা হয়। ২০০৮ সালে মেঘনা ও গোমতী সেতুর সম্প্রসারণশীল সংযোগ মেরামত করা হয় ছয় কোটি টাকা ব্যয়ে। কিন্তু তিন বছরও টেকেনি সেই মেরামত।
সওজ সূত্র জানায়, মেঘনা সেতু এখন মেরামত করতে গেলে ভূমিকম্পের সহনীয় মাত্রাও বাড়াতে হবে। কারণ ১৯৯১ সালে সেতুটি ত ৎকালীন বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) অনুযায়ী ভূমিকম্পের জন্য মান ধরা ছিল দশমিক শূন্য ৫ জি। বর্তমানে বিএনবিসি কোড অনুযায়ী ভূমিকম্পের মান ধরা হয়েছে দশমিক ১৫ জি।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সারসংক্ষেপ: সেতুটি মেরামতে ১৫০ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দের জন্য সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি সারসংক্ষেপ পাঠানো হয়েছে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে। এতে বলা হয়, ক্ষতিগ্রস্ত সেতুটি পরিপূর্ণ মেরামত করতে হলে সম্ভাব্যতা যাচাই ও নতুন করে নকশা প্রণয়ন করতে হবে। এতে অন্তত দুই বছর সময় লাগবে। কিন্তু মেঘনা সেতুর বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করে দুই বছর অপেক্ষা করা বাস্তবসম্মত হবে না।
প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠানো সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, মেঘনা সেতু কোনো কারণে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়লে বন্দরনগর চট্টগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হুমকির সম্মুখীন হবে।
ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র অকেজো: বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে মেঘনা ও গোমতী সেতুর দুই প্রান্তে দুটি ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। প্রায় ছয় কোটি টাকা ব্যয়ে এই কেন্দ্র স্থাপন করা হলেও কখনোই তা ব্যবহার করা হয়নি। সওজের কর্মকর্তারা বলছেন, অতিরিক্ত মালবাহী যানবাহনও সেতুর জন্য ক্ষতিকর।
মেঘনা-গোমতী সেতুর টোল প্লাজা সূত্রে জানা গেছে, এই সেতু দিয়ে দৈনিক গড়ে ১৬ হাজার যানবাহন চলে। এর মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশই বাণিজ্যিক অর্থা ৎ মালবাহী যান।

হাজারীবাগ খালে ক্ষমতার থাবা by আপেল মাহমুদ

পুরান ঢাকার লালবাগ, ইসলামবাগ, হাজারীবাগ, নবাবগঞ্জ ও কামরাঙ্গীরচর এলাকার তরল বর্জ্য ও বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন হয় হাজারীবাগ খাল দিয়ে। অতীতে মূল খালের সঙ্গে ছিল দুটি শাখা খাল। সেগুলো এখন আছে শুধু সরকারি রেকর্ডপত্রে। বাস্তবে সেখানে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন বাড়িঘর ও কলকারখানা। অন্তত ২০ বছর ধরে জলাশয়ের জায়গা দখল চলছে। দখল সিন্ডিকেটে এবার যোগ হয়েছে অপরাধজগতের পরিচিত মুখ তনাই মোল্লাসহ ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতার নাম। এ নেতাদের কয়েকজন কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, তাঁরা বায়না সূত্রে জমির মালিক।

ঢাকা জেলা প্রশাসনের রেকর্ড রুম সূত্রে জানা যায়, হাজারীবাগ মূল খালটি একসময় বুড়িগঙ্গা নদীর শাখা ছিল। সে শাখার একটি খাল ইসলামবাগ লবণ ফ্যাক্টরি দিয়ে কেল্লার মোড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মূল খালটি থাকলেও বর্তমানে এ শাখার কোনো অস্তিত্বই নেই। জেলা প্রশাসকের সার্ভে প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, খালের জমিতে কাঁচা, আধা কাঁচা এবং বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। অথচ ২৫০৫ নম্বর আরএস এবং ২০০১ নম্বর এসএ দাগের অন্তর্ভুক্ত হলো ওই খাল। সরকারের নথিতে তা ১ নম্বর খাস খতিয়ান হিসেবে তালিকাভুক্ত। জমির পরিমাণ ২ দশমিক ২৫২৬ একর।
স্থানীয়ভাবে অভিযোগ পাওয়া গেছে, স্থানীয় বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন মিয়ার নেতৃত্বে প্রায় ৫০ ব্যক্তি ওই খালের জায়গা দখল শুরু করে ২০ বছর আগে। আর বর্তমানে তনাই মোল্লাসহ ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতা অভিনব কৌশলে ইসলামবাগ লবণ ফ্যাক্টরি থেকে কেল্লার মোড় প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত শাখা খালের জায়গায় দখলের কাজ চালাচ্ছেন। দখলকারী হিসেবে যাঁদের নামে অভিযোগ পাওয়া গেছে, তাঁদের মধ্যে আছেন মোশারফ হোসেন, তনাই মোল্লা, মো. জাহাঙ্গীর, হাজি সিরাজুল ইসলাম রাডো, সফিকুর রহমান জাহাঙ্গীর, মো. বাবুল ঢালী, মতিউর রহমান জামাল, সের ইসলাম, আমির হোসেন, মো. আকিব প্রমুখ। ইতিমধ্যে তাঁরা ক্রয়সূত্রে মালিক এমন সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দখল করে নিয়েছেন হাজারীবাগ শাখা খালের উল্লেখযোগ্য অংশ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মোশারফ হোসেন লালবাগ থানা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি। হাজি সিরাজুল ইসলাম রাডো ৬৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি। তবে তাঁদের সহযোগী তনাই মোল্লা ঢাকার অপরাধজগতের একজন অতিপরিচিত ব্যক্তি।
স্থানীয় ভূমি অফিসের এক তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এ সিন্ডিকেট ইতিমধ্যে খালের প্রায় দুই একর খাসজমি ভরাট করে ফেলেছে। অবশিষ্ট জমি দখলের জন্য ড্রেজার দিয়ে রাত-দিন বালু ফেলা হচ্ছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ইসলামবাগ বেড়িবাঁধের পশ্চিম পাশে (লবণ ফ্যাক্টরি-সংলগ্ন) পুরনো মজা খালের ওপর একটি সাইনবোর্ড ঝুলছে। স্থানটি এলাকাবাসীর কাছে বাঁশপট্টি হিসেবে পরিচিত। সাইনবোর্ডে লেখা 'ক্রয়সূত্রে এ জমির মালিক মোশারফ হোসেন, তনাই মোল্লা, মো. জাহাঙ্গীর, হাজি সিরাজুল ইসলাম রাডো, সফিকুর রহমান জাহাঙ্গীর, মো. বাবুল ঢালী, মতিউর রহমান জামাল, সের ইসলাম, আমির হোসেন ও মো. আকিব।' সেই সাইনবোর্ডে হাজারীবাগ মৌজার সিএস দাগ নম্বর ৪১, এসএ দাগ নম্বর ৬৬৭৬, ৬৬৭৭, আরএস দাগ নম্বর ১৩৫৫২, ১৩৫৫৩, ১৩৫৫৪, ১৩৫৫৫ এবং মহানগর দাগ নম্বর ১২৫০৪, ১২৫০৫। জমির পরিমাণ ১ দশমিক ৩৩ একর বা ১৩৩০০ অযুতাংশ। রেকর্ড সূত্রে উলি্লখিত জমির মালিক স্থানীয় বাসিন্দা হাজি আবদুল হালিমের বংশধররা।
কিন্তু সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিস সূত্রে জানা গেছে, যেখানে খাসজমি ভরাট করা হচ্ছে, এর পাশে কিছুু ব্যক্তিগত সম্পত্তি রয়েছে। মূলত দখলদার সিন্ডিকেট ওই জমিকে পুঁজি করেই সরকারি খাসজমি দখল করে নেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে। স্থানটি হাজারীবাগ ও লালবাগ সীমান্তবর্তী হওয়ায় তারা সে সুযোগটা সহজেই কাজে লাগিয়ে মাটি ভরাটের কাজ করতে পারছে। কিন্তু স্থানীয় লোকজন বলছে, দখলদার সিন্ডিকেট এক দাগের জমি বায়নাসূত্রে কিনে অন্য দাগের জমি ভরাট করছে। মৌজার মানচিত্র দিয়ে ভূমি অফিসের সার্ভেয়ারের মাধ্যমে মাপজোখ করলে আসল ঘটনা বেরিয়ে আসবে বলে জানান স্থানীয় ইসলামবাগের বাসিন্দা কুদরত উল্লাহ।
ধানমণ্ডি ভূমি সার্কেলের সার্ভেয়ার জহির হোসেন জানান, যে জমিতে মাটি ভরাট করা হচ্ছে, এর মালিকানা এখনো নির্ণয় করা হয়নি। কারণ সেখানে সরকারি খাসজমি ছাড়াও সরকারি অধিগ্রহণ করা জমি রয়েছে। সব কিছু বিশ্লেষণ করে কোনটা খাসজমি, কোনটা ব্যক্তিগত জমি, তা চিহ্নিত করা হবে।
খালের নকশা ও রেকর্ড-পর্চা থেকে জানা গেছে, বায়নাসূত্রে যে জমিতে বালু ফেলা হচ্ছে, এর পাশেই হাজারীবাগ খালের বিপুল পরিমাণ জমি রয়েছে, যা লালবাগ মৌজার অন্তর্ভুক্ত। ২০০১ নম্বর এসএ দাগেই রয়েছে কয়েক একর সরকারি খাসজমি। এর কিয়দংশ ভরাট করার কাজ ইতিমধ্যে শেষ পর্যায়ে রয়েছে। বাকি ভরাটের কাজ দ্রুত শেষ করা হচ্ছে। স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা জানান, মাটি ভরাটের কাজ শেষ হলে ওই সিন্ডিকেট পুরো জমি কাউকে সাবকবলা দলিলমূলে বিক্রি করে দেবে। তবে ধানমণ্ডি ভূমি সার্কেলের সহকারী কমিশনার আবুল হাসনাত মঈনউদ্দিন বলেন, শিগগিরই ভরাট করা জমি সার্ভেয়ার দিয়ে মেপে দখলকৃত সরকারি জমি উদ্ধার করা হবে। কেউ মাটি ভরাট করলেও তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও তিনি জানান।
লালবাগ তহশিল অফিস সূত্রে জানা গেছে, হাজারীবাগ খালের পাশে মাটি ভরাটের কাজ শুরু হলে তারা বিষয়টি জানিয়ে ধানমণ্ডি ভূমি সার্কেল অফিসে চিঠি দিয়েছে। গত ২৪ জুলাই লেখা সেই চিঠিতে বলা হয়, মাটি ভরাটের জায়গায় ব্যক্তিগত সম্পত্তির পাশাপাশি অনেক সরকারি জমি রয়েছে। বিশেষ করে লালবাগ মৌজার ১/১ খতিয়ানে ২০০১ নম্বর এসএ দাগে বিপুল পরিমাণ খাসজমি বিদ্যমান। কিন্তু ওই দাগের জমির সীমানা চিহ্নিত করা নেই। ফলে বায়নাসূত্রে মালিকদের ভরাট করা অংশ খাসজমি কি না, তা চিহ্নিত করার জন্য চিঠির মাধ্যমে তহশিলদার আলমাস হোসেন খান ভূমি সহকারী কমিশনারের অফিসকে জানান। এরপর ধানমণ্ডি ভূমি সার্কেল অফিসের সার্ভেয়ার দিয়ে খাসজমি নির্ণয়ের জন্য মাপজোখ শুরু করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে বায়নাসূত্রে ওই জমির মালিক এবং লালবাগ থানা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি মোশারফ হোসেন বলেন, ওই জমির প্রকৃত মালিকদের কাছ থেকে সঠিক কাগজপত্র দেখেই বায়না করা হয়েছে। এখানে সরকারি খাস কিংবা অধিগ্রহণ করা কোনো জমি ভরাট করা হয়নি। তনাই মোল্লার নাম সাইনবোর্ডে সংযুক্ত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রকৃতপক্ষে বায়না দলিলে তনাই মোল্লার স্ত্রীর নাম রয়েছে। তিনি মহিলা হওয়ায় স্ত্রীর পরিবর্তে স্বামী তনাই মোল্লার নাম দেওয়া হয়েছে। অপর বায়না দলিলগ্রহীতা হাজি সিরাজুল ইসলাম ওরফে রাডো সিরাজ বলেন, ওই জমি বায়না করার ব্যাপারে সব কিছু করেছেন তনাই মোল্লা। তাই জমির সব কিছু তিনিই বলতে পারবেন।
হাজারীবাগ খালের আরেকটি শাখা কোম্পানীগঞ্জঘাট থেকে এনায়েতগঞ্জের ভেতর দিয়ে হাজারীবাগের সাত্তারের ট্যানারি ফ্যাক্টরি পর্যন্ত এসেছে বলে এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়। কিন্তু ওই খালের কোনো অস্তিত্ব স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা সম্ভব হয়নি। তবে অনেক অনুসন্ধানের পর ওই খালের চিহ্ন পাওয়া গেল, যাকে নালা বলাই ভালো। খালের দুই পাশে বড় বড় বহুতল ভবন উঠেছে। স্থায়ী বাসিন্দা হাজি একলাছ উদ্দিন বলেন, পাকিস্তান আমলে বুড়িগঙ্গা নদী হয়ে এনায়েতগঞ্জের খাল দিয়ে ময়মনসিংহ, সিলেট, কুমিল্লা ও উত্তরবঙ্গ থেকে নৌকা বোঝাই করে হাজারীবাগে কাঁচা চামড়া আসত। বর্তমানে সেই খালের জায়গায় পাকা রাস্তায় যানবাহন চলাচল করছে।
জেলা প্রশাসন কিংবা স্থানীয় ভূমি অফিস থেকেও ওই খালের বিবরণ জানা সম্ভব হয়নি। ওয়াসার ড্রেনেজ বিভাগে যোগাযোগ করা হলে তারা জানায়, ঢাকায় যে ৩৬টি খাল তারা ব্যবস্থাপনা করছে, এর মধ্যে হাজারীবাগ কিংবা এনায়েতগঞ্জ খালের কথা নেই। তবে লালবাগ তহশিল অফিসের ২৮ নম্বর আরএস রেকর্ড নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সেখানে ১ দশমিক ৫৩৮৪ একর জমি রয়েছে সরকারের ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত। ওই জমিতেই একসময় খাল ছিল বলে স্থানীয় বর্ষীয়ান ব্যক্তি হোসেন আলী মাতবর জানান।
হোসেন আলী আরো বলেন, খালের আরো অনেক জমি থাকলেও পর্যায়ক্রমে তা ব্যক্তিমালিকানায় চলে গেছে। এর পরই খাল দখল করে সেখানে বাড়িঘর এবং কলকারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। ফলে এলাকায় জমে থাকা বিষাক্ত তরল বর্জ্যে অনেকে নানা অসুখে ভুগছে। হাজারীবাগের স্থানীয় চিকিৎসক ডা. আবদুল কাদের বলেন, এসব বর্জ্য ঠিকমতো অপসারণ হয় না বলে এলাকার অনেকে শ্বাসকষ্ট, শরীর চুলকানি, নাসিকা প্রদাহ, চোখের রোগসহ আরো অনেক জটিল রোগে আক্রান্ত হয়।
বুড়িগঙ্গা নদীর তীরবর্তী জঙ্গলবাড়ী মৌজার ২৯৮৭ ও ২৯৮৬ নম্বর আরএস দাগে সরকারের আরো প্রায় ৩০ একর খাসজমি থাকলেও তা বিভিন্ন লোকের দখলে চলে গেছে। এর মধ্যে কোম্পানীগঞ্জ ঘাটের পাশে খাল ভরাট করে প্রায় দুই একর জমিতে ম্যাটাডোর কলম এবং ভলভো ব্যাটারি ফ্যাক্টরির স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। এতে বুড়িগঙ্গা নদীর সঙ্গে হাজারীবাগ খালের সংযোগ চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। কোম্পানীগঞ্জ ঘাটের ব্যবসায়ী সোহরাব হোসেন বলেন, এলাকার প্রভাবশালী মহলের যোগসাজশেই এসব দখলের ঘটনা ঘটছে। তবে ফ্যাক্টরির কর্মকর্তারা জানান, তাঁরা পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে খালের জমি লিজ নিয়ে স্থাপনা নির্মাণ করেছেন।
সরকারি খাল এবং খাসজমি দখল হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে ঢাকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) জনেন্দ্রনাথ সরকার বলেন, হাজারীবাগ খালের সরকারি খাসজমি দখলের বিষয়টি অনেক পুরনো। ধীরে ধীরে খাসজমি দখল করে নিয়েছে কিছু প্রভাবশালী মহল। তবে সম্প্রতি জেলা প্রশাসন খালের সার্ভে করে বেদখল হয়ে যাওয়া জমি কিভাবে উদ্ধার করা যায়, সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে ভূমি কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। খালের জায়গা চিহ্নিত হলেই তা উদ্ধারের জন্য অভিযান চালানো হবে।

হারিয়ে যাচ্ছে নৌপথ by অরূপ দত্ত

Sunday, September 18, 2011

৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথ ছিল। সেই নৌপথ কমতে কমতে এখন প্রায় ছয় হাজার কিলোমিটারে নেমেছে। শুকনো মৌসুমে আরও কমে হয় তিন হাজার ৮০০ কিলোমিটার। অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) নদী সংরক্ষণ বিভাগ এই হিসাব দিয়েছে।
১৯৬৫ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত নেদারল্যান্ডের নদী বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতায় জরিপ করে তৈরি করা ‘নেডেকো রিপোর্ট’ এবং ১৯৭৫ সালে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) প্রকাশিত নদীর দূরত্ববিষয়ক প্রতিবেদন থেকে দেশে ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথ থাকার তথ্য পাওয়া যায়।
পলি ও বালু পড়ে নদীর নাব্যতা কমে যাওয়া এবং দখল ও দূষণের কারণে প্রায় ১৮ হাজার কিলোমিটার নদীপথ বন্ধ বা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক স্থানে নদীতে পানির গভীরতা নেমে এসেছে তিন ফুটেরও নিচে।
বর্তমানে নাব্যতার সংকট এতটাই তীব্র যে মাঝেমধ্যেই ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। চলতি মাসের শুরুতে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া চ্যানেলে অন্তত পাঁচটি ফেরি বেশ কয়েকবারে প্রায় আড়াই শ ঘণ্টা ডুবোচরে আটকে ছিল। অসংখ্য ডুবোচরের ফাঁক দিয়ে কোনোমতে ফেরি চলছে।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে খননকাজে প্রায় ১০০ কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হয়। ওই সময় শুকনো মৌসুমে নদীপথ কমতে থাকে বেশি হারে। তখন পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া-গোদাগাড়ী চ্যানেলে পদ্মা, দৈ-খাওয়ায় যমুনা; ছাতক ও লক্ষ্মীপুরের মজু চৌধুরীর ঘাটে মেঘনায় ৩৬ লাখ ঘনমিটার নদী খননকাজের নামে ৪৬ কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এই অভিযোগের তদন্ত করছে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে খননকাজের জন্য ২৪ হাজার কোটি টাকার পরিকল্পনা নিলেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। বলা হচ্ছে, খননকাজে ১২৫ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। অথচ বিআইডব্লিউটিএ সূত্রের হিসাব অনুযায়ী, গত দুই বছরে ৪০৭ কিলোমিটার নৌপথ এবং ১২টি ঘাট বন্ধ হয়ে গেছে। নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে এখন অন্তত ৫০টি ড্রেজার বা খননযন্ত্র প্রয়োজন। আছে মাত্র ১০টি। ভাড়া করা হচ্ছে ১৫টি।
প্রথম শ্রেণীর নদীপথ মাত্র ৬৮৩ কিলোমিটার: বর্তমানে দেশে পাঁচ হাজার ৯৯৫ কিলোমিটার নৌপথের মধ্যে ১২-১৩ ফুট গভীরতার প্রথম শ্রেণীর নৌপথ আছে মাত্র ৬৮৩ কিলোমিটার। চট্টগ্রাম-ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ-ভৈরব, আশুগঞ্জ, বরিশাল-মংলা ও খুলনায় সংযোগকারী নৌপথগুলো এই শ্রেণীভুক্ত। সাত-আট ফুট গভীরতার দ্বিতীয় শ্রেণীর নৌপথ আছে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার। পাঁচ-ছয় ফুট গভীরতার তৃতীয় শ্রেণীর নৌপথ আছে এক হাজার ৮৮৫ কিলোমিটার। পাঁচ ফুটের নিচে বাকি নৌপথ নৌযান চলাচলের অযোগ্য।
এখন প্রায়ই ফেরি আটকে যাচ্ছে: ১০ সেপ্টেম্বর সকাল সাতটা থেকে দৌলতদিয়া ঘাটের কাছে নৌযান চলাচলকারী চ্যানেলে একে একে সাতটি ফেরি আটকা পড়ে। এতে মানিকগঞ্জ-পাটুরিয়া হয়ে রাজধানীর সঙ্গে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগ নয় ঘণ্টা বন্ধ থাকে। পদ্মা ও যমুনা নদীর সংযোগস্থল বরাবর দুই তীরে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাটে কয়েক শ যাত্রীবাহী যানবাহন আটকা পড়ে।
বিআইডব্লিউটিএর স্থানীয় কর্মকর্তারা স্বীকার করেন যে সেখানে চ্যানেলের প্রশস্ততা ও নাব্যতা কম। খননকাজের জন্য চ্যানেলে খননযন্ত্র স্থাপন করা হলে ফেরি চলাচল বিঘ্নিত হয়। এসব কারণে খননকাজ বন্ধ রাখতে হয়।
ওই দিন ভোর চারটার দিকে যানবাহন ও যাত্রী নিয়ে ফেরি কেরামত আলী পাটুরিয়ার উদ্দেশে দৌলতদিয়া ঘাট ছাড়ার পর চ্যানেলের মুখে আটকা পড়ে। এর প্রায় দুই ঘণ্টা পর পাটুরিয়া থেকে দৌলতদিয়ায় যাওয়ার পথে একই স্থানে আটকা পড়ে ফেরি বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান। প্রায় এক ঘণ্টা চেষ্টা করে সংস্থার উদ্ধারকারী জাহাজ আইটি-৩৯৮-এর সাহায্যে সকাল সাড়ে আটটার দিকে ঘাটে ফিরিয়ে আনা হয় কেরামত আলীকে। আটকে পড়া হামিদুর রহমানকে উদ্ধার করা হয় সকাল ১০টায়। এরপর পাটুরিয়া থেকে ছেড়ে যাওয়া ফেরি শাহ মখদুম, শাহ আলী, বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান, আমানত শাহ ও হামিদুর রহমান দৌলতদিয়া চ্যানেলের মুখে পর্যায়ক্রমে আটকা পড়ে। এসব ফেরিতে আটকা পড়ে প্রায় ১০০ যানবাহন আর বিপুলসংখ্যক যাত্রী।
১১ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টার দিকে মাত্র আটটি যানবাহন নিয়ে দৌলতদিয়া ঘাট থেকে পাটুরিয়ার উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়ার কয়েক মিনিট পরই ফেরি খানজাহান আলী চরে আটকে যায়। কিছুক্ষণ পর আটকে পড়ে শাহ মখদুমসহ আরও দুটি ফেরি। আধা ঘণ্টা চেষ্টা করে ফেরির মাস্টাররা দুটি ফেরি নিয়ে পাটুরিয়া ঘাটে ভিড়তে সক্ষম হলেও ফেরি খানজাহান আলী আটকে থাকে। পরে বিআইডব্লিউটিএর উদ্ধারকারী জাহাজ ‘আশা’ দুপুর একটার দিকে ফেরিটি উদ্ধার করে। রাত ১২টার দিকে ছোট ফেরি কুমারী দৌলতদিয়া থেকে পাটুরিয়ার উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর ডুবোচরে আটকা পড়ে।
১২ সেপ্টেম্বর মাওয়া-কাওরাকান্দি ও দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ফেরিঘাটে নাব্যতার সংকট তীব্র হয়ে ওঠে। দুটি ফেরিপথে ধারণক্ষমতার কম যানবাহন নিয়েও ডুবোচরে একের পর এক ফেরি আটকে যায়। মাওয়া-কাওরাকান্দি ফেরিপথে নাওডোবা-হাজরা-মাগুখণ্ড সরু চ্যানেল দিয়ে ধারণক্ষমতার অনেক কম যান নিয়ে চলতে হয় ফেরি। এ সময় শুধু যাত্রীবাহী যান ও কাঁচামালবাহী ট্রাকই চলাচল করছিল। পণ্যবাহী ট্রাককে পারাপারের জন্য তিন দিন পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হয়। এই পরিস্থিতিতে টাস্কফোর্স গঠন করা হলেও অবস্থার তেমন পরিবর্তন হয়নি।
যোগাযোগ করা হলে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল মান্নান হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, গত মাসে কিছু সমস্যা হলেও এখন নৌপথে ফেরি চলাচল অনেকটা ভালো অবস্থায় এসেছে। নাব্যতা সংকট কমাতে নিরন্তর চেষ্টা চলছে। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় যথেষ্ট সতর্ক রয়েছে। এ-সংক্রান্ত প্রকল্পও বাস্তবায়ন করা হবে বলে জানান তিনি।
দুই বছরে ৪০৭ কিলোমিটার নৌপথ বন্ধ: বিআইডব্লিউটিএর নদী সংরক্ষণ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, গত দুই বছরে পানির গভীরতা পাঁচ ফুটের নিচে নেমে আসায় ৪০৭ কিলোমিটার নদীপথ বন্ধ হয়ে গেছে। এগুলো হচ্ছে কিশোরগঞ্জের পাগলামোড়-মোহনগঞ্জে কংস নদে ৪৩ কিলোমিটার, খুলনা-কালিকাপুর রুটে মধুমতী নদীতে ১৩৮, কালিকাপুর-মাদারীপুর-নন্দীপাড়ায় মধুমতী নদীতে ৫৬, যশোরে কপোতাক্ষ-টেপাখালীতে ৮৫ এবং পাইকগাছা-আশাশুনি-প্রতাপনগরে ৮৫ কিলোমিটার নৌপথ।
বন্ধ ১২টি ঘাট: নাব্যতা সংকটের কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে ১২টি ঘাট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এগুলো হচ্ছে— গোয়ালন্দঘাট, ভাগ্যকুল, জসিলদিয়া, গৌরগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সরিষাবাড়ী, গোদাগাড়ী, রাজশাহী, মিরকুটিয়া, পাকশী, জগন্নাথগঞ্জ ও ফুলছড়ি বন্দর।
বিআইডব্লিউটিএর দাবি: বিআইডব্লিউটিএ দাবি করেছে, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ৪১ কিলোমিটার নৌপথের উন্নয়ন করে প্রথম শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে কালীগঞ্জ-হিজলায় ২৫ কিলোমিটার এবং সদরঘাট-মিরপুর সেতু পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা নদীর ১৬ কিলোমিটার পথ রয়েছে। এ ছাড়া মিরপুর থেকে আশুলিয়া পর্যন্ত সাড়ে ১৩ কিলোমিটার এবং সাহেবের হাট নালার ১২ কিলোমিটার অংশকে খনন করে উন্নয়ন করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এই উন্নয়ন চোখে পড়ে না। সদরঘাট থেকে আশুলিয়া পর্যন্ত বৃত্তাকার নৌপথের প্রথম ভাগে নাব্যতার অভাবে বড় নৌযান চলতে পারছে না, যে কারণে বর্তমান সরকারের বহুল প্রচারিত ‘ওয়াটার বাস’ চলাচল প্রায় বন্ধ করতে হয়েছে।
খননে অতি খরচ: বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর খননযন্ত্র ভাড়া নেওয়া, কর্মপরিকল্পনা, খননযন্ত্রের খুচরা যন্ত্রাংশ সংগ্রহ ইত্যাদি কাজে মোট ১২৫ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে বলে জানা যায়। ২০০৮-০৯ সালে খরচ হয়েছে ৩১ কোটি ৪১ লাখ টাকা, ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা আর গত অর্থবছরে ৪৬ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। এসবের সুফল তেমন পাওয়া যায়নি। চলতি অর্থবছরের জন্য খননকাজে বাইরের খননযন্ত্র ভাড়ার জন্য ৩৭ কোটিসহ মোট বাজেট রাখা হয়েছে ৭১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। এদিকে যে খননযন্ত্রগুলো আছে, সেগুলোও সময়মতো কাজে লাগানো হয় না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। যেমন, গত জুলাই মাসের শেষ দিকে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ায় নদী খননের জন্য বিআইডব্লিউটিএর পাঁচটি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি খননযন্ত্র পাঠানো হলেও ব্যবহার করা হয়নি। এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর ব্যাখ্যা হচ্ছে, স্রোতের গতি দুই নটিক্যালের বেশি থাকলে খননকাজ করা যায় না। কিন্তু বর্তমানে সেখানে স্রোতের গতি সাড়ে চার নটিক্যাল হলেও খননকাজ করা হচ্ছে। এ অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার সকাল সোয়া আটটায় দৌলতদিয়ায় শাহ আলী নামের একটি ফেরি সেখানে আটকে যায়।
এ ছাড়া গত বছর বেশি স্রোত থাকা সত্ত্বেও বিআইডব্লিউটিএ মাওয়ায় হাজরা শোলে দুই কোটি টাকা খরচ করে খননকাজ করেছিল। বিআইডব্লিউটিএ দাবি করেছে, ওই কাজ একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর আগ্রহে করা হয়েছিল। কিন্তু মাওয়ায় পদ্মা নদীতে, ঢাকায় বুড়িগঙ্গায় ও আরিচায় খননকাজ করার পর নাব্যতা প্রায় আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। আংশিক খননকাজ করে পুরো বিল তুলে নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। চলতি অর্থবছরের জন্য শুধু খননকাজে ৩৭ কোটি টাকা বাজেট রাখা হয়েছে।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য: বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান আবদুল মালেক মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘ সময়জুড়ে দেশের নদ-নদীকে অবহেলা করে একরকম হত্যাই করা হয়েছে। ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্র নদ শুকিয়ে গেছে। বাগেরহাটের রামপালে নদীর এমন অবস্থা হয়েছে যে এখন উন্নয়নও করা যাচ্ছে না। আড়িয়াল খাঁ নদের নাব্যতা ফেরানোর চেষ্টা হচ্ছে। অল্প সামর্থ্যের মধ্যে বিআইডব্লিউটিএকে কাজ করতে হচ্ছে। তার পরও পাটুরিয়া-দৌলতদিয়াসহ যেসব চ্যানেলে এই মুহূর্তে সমস্যা হচ্ছে, সেগুলোতে বিআইডব্লিউটিএর খননকাজ অব্যাহত রয়েছে।
নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে বিআইডব্লিউটিএ কোনো মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে কি না—এ প্রসঙ্গে চেয়ারম্যান বলেন, বিআইডব্লিউটিএ ৫৩টি নদীর উন্নয়নে ১১ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকার প্রকল্প উপস্থাপনের পর ২৪টির বিষয়ে আশ্বাস পেয়েছে। সে ক্ষেত্রে খরচ হবে পাঁচ হাজার ২৭২ কোটি টাকা।
নাব্যতার অভাবে বন্ধ নৌপথ
১৯৭৬ সালের দিকে বিভিন্ন নদীর নাব্যতা কমতে শুরু করে। ১৯৭৭ সালের মধ্যে ২১৬ মাইল নৌপথ বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭৮ সালে বন্ধ হয় আরও ২১ কিলোমিটার। কুতুবদিয়া ও মহেশখালী হয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ইনার চ্যানেলে পানির গভীরতা ছিল ছয় ফুট। ১৯৮৪ সাল থেকে এই রুটে গভীরতা দু-তিন ফুটে নেমে একরকম বন্ধই হয়ে যায়। ১৯৯৯ সালে মেঘনা নদীর উত্তর দিকে লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতিতে চট্টগ্রাম-চাঁদপুর-বরিশালে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ রুট বন্ধ হয়ে যায়, যা আর চালু হয়নি। কক্সবাজার রুটে বাঁকখালী নদীর নাব্যতা কমতে কমতে এখন ১০ কিলোমিটার অংশ শুকিয়ে গেছে। সিরাজগঞ্জ থেকে জামালপুরের সরিষাবাড়ী পর্যন্ত নৌপথটি শুকিয়ে যাওয়ায় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আরিচা-নগরবাড়ী রুটটি ১৯৯৫ সালে নাব্যতা কমে শুকিয়ে গেলে পাঁচটি স্থানে ঘাট পরিবর্তন করতে হয়।
বিআইডব্লিউটিএর নদী সংরক্ষণ বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, মধুমতী নদী ও আড়িয়াল খাঁ নদের নাব্যতা ভয়াবহভাবে কমে গেছে। আরিচা-রাজশাহী-গোদাগাড়ীতে পদ্মা নদীর নাব্যতাও অর্ধেকের মতো কমে গেছে।
এ ছাড়া বর্তমানে মোহনগঞ্জ-ঠাকুরকোনায় কংস নদের ৪৬ কিলোমিটার অংশ বন্ধ আছে। বড়দিয়া-তালবাড়িয়ায় গড়াই ও মধুমতী নদীর ১৭০ কিলোমিটার, বাঘাবাড়ী-বাদলগাছিতে হুরাসাগর ও বড়াল নদের ১৬৩, বাঘাবাড়ী-উল্লাপাড়ায় করতোয়া নদীর ৩২, সৈয়দপুর-শ্রীনগরে ইছামতী নদীর ১৮, ভৈরববাজার-হোসেনপুর-ময়মনসিংহ-বাহাদুরাবাদে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের ২৪০, আরিচা-পাকশী-রাজশাহী-গোদাগাড়ী-ভোলাহাটে ৩০৭ কিলোমিটার নৌপথ বন্ধ। আরও অনেক স্থানে স্থানীয় নদীগুলোর শত শত কিলোমিটার অংশ বন্ধ হয়ে গেছে। যেমন নরসিংদী-কটিয়াদীতে ৮৪, বৈঠাবাড়িয়া-গাজীপুরে ৯, ছাতক-আটগ্রামে ১৪১, সাভার-নয়ারহাট-ধামরাইয়ে ১০, রোস্তমপুর-কালিয়াকৈরে ১০, মনুমুখ-মৌলভীবাজারে ২০ এবং ইচলী-ফরিদগঞ্জ-চরপাগলায় ৯৩ কিলোমিটার নদীপথ বন্ধ আছে।

ফুটপাত থেকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল পর্যন্ত মাদকের থাবা by পারভেজ খান

Saturday, September 17, 2011

রাজধানীর হাজারীবাগের গৃহবধূ জোবায়দা সোলায়মান বলছিলেন, তাঁর চার ছেলে আগে গাঁজা সেবন করত। এরপর হেরোইন, ফেনসিডিল হয়ে ধরে ইয়াবা। আর এখন তো তারা সেসব নেশার সঙ্গে যুক্ত করেছে আরো নানা আজব নেশা; যেগুলো দেখলেই গা ঘিনঘিন করে। জোবায়দার স্বামী ট্যানারি ব্যবসায়ী আবু সোলায়মান ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, 'আমার মতো অনেক বাবা-মা সন্তানদের মাধ্যমে ঘরে বসেই টের পাচ্ছেন, মাদক কতটা ভয়াবহতার পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে।' আবু সোলায়মান মনে করেন, সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হচ্ছে জাতিকে মাদকের থাবা থেকে মুক্তি দিতে না পারা।
রাজধানীর এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে মাদক অবাধে বেচাকেনা বা সেবন চলছে না। মাদকদ্রব্য ছড়িয়ে পড়েছে ফুটপাত থেকে স্কুল পর্যন্ত। নেশা এবং নেশার কারণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন ঢাকার ব্রেইন অ্যান্ড লাইফ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফখরুল হোসেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁর এখানে আসা রোগীদের সঙ্গে কথা বলে তিনি জেনেছেন, মূলত হতাশা থেকেই তাদের বেশির ভাগ নেশায় আসক্ত হয়েছে। এই হতাশার সৃষ্টি হয়েছে পারিবারিক থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক কারণে। আবার নেশায় আসক্তদের একটি বড় অংশ কোনো না কোনোভাবে নানা অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত। নেশা যারা গ্রহণ করে তারা শুধু শারীরিক নয় মানসিকভাবেও অসুস্থ। ফলে তাদের কাছে অপরাধ কোনো ব্যাপার নয়। আর নেশার অর্থ জোগাতেও তারা ছিনতাই, চুরি, ডাকাতিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। ইদানীং নারী ও শিশুদের মধ্যেও এই ইয়াবা সেবনের হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। বিশেষ করে তাঁর প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নিতে কিছু নামিদামি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ছাত্রছাত্রী আসছে, যা দেখে তিনি নিজেও বিস্মিত। একটি সুসংগঠিত চক্রই বিশেষ করে বিত্তবান পরিবারের শিশুদের টার্গেট করেছে।
বিভিন্ন সূত্র মতে, এখন রাজধানীতে খুচরা মাদক বেচাকেনা বেশি হয় কোতোয়ালি, শাহবাগ, লালবাগ, চকবাজার, কামরাঙ্গীরচর, বংশাল, মোহাম্মদপুর, নিউ মার্কেট ও হাজারীবাগ থানা এলাকায়। আর তা নিয়ন্ত্রণ করে মাত্র কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ী। এরা হচ্ছে হাজারীবাগ, লালবাগ ও চকবাজার থানার পুলিশের সোর্স এবং কমপক্ষে ১৫টি করে মামলার আসামি আজমল ও তার ভাই অসিম, হাজারীবাগের নাটকু সোহেল, সোর্স আজমলের স্ত্রী পপী, হেরোইন সম্রাজ্ঞী হিসেবে পুলিশের নথিতে চিহ্নিত জমিলা ওরফে জামিলা, বেড়িবাঁধের নোনা চোরা, বিজু ও তার ভাই সেলিম, মুসলিম ও ভাগলপুর লেনের লতিফ। কামরাঙ্গীরচরের আনন্দ ওরফে মুহুরী আনন্দ ওরফে দাদা আনন্দ, জেলখানা ঢালের বেগম, আম্বিয়া, ফুলবাড়িয়া নিমতলী এলাকার আনন্দবাজার বস্তির রিপন ও লাভলু। এই চক্রের নেতা হচ্ছে হাজারীবাগ পার্ক এলাকার কালা বাবু। সে মাদক সর্দার হিসেবে চিহ্নিত। কয়েক মাস আগেও সে আগ্নেয়াস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হয়েছিল। এখন জামিনে বের হয়ে এসেছে। এই চক্রের হয়ে পুলিশ নিয়ন্ত্রণ করে পলাশ, আরিফ ও চপল নামের হাজারীবাগ এলাকার তিন ব্যক্তি। এরা এলাকায় রাজনৈতিকভাবেও প্রভাবশালী এবং পুলিশের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে চিহ্নিত। ফলে এই চক্র এখন রাজধানীতে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। এসব এলাকায় রয়েছে ৫৫টির মতো মাদক ও নেশাজাত দ্রব্যের আড়ত। এসব আড়তে নেশাজাত দ্রব্য সরবরাহ করে আমিনবাজারের সবচেয়ে বড় মাদক ব্যবসায়ী টিক্কার স্ত্রী কল্পনা। কল্পনা ও টিক্কা এখন নগরীর বাড্ডা এলাকায়ও মাদক ব্যবসা জমিয়ে তুলেছে।
সূত্র মতে, রাজধানীর পাইকারি মাদক বেচাকেনা সবচেয়ে বেশি হয় মিরপুরের গাবতলী, ১ নম্বর গুদারাঘাট, মতিঝিলের কলোনি এলাকা, পুরানা পল্টন, শান্তিনগর বাজার, বিজয়নগর, ফকিরাপুল, ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ড. বাসাবো, কমলাপুর রেলস্টেশনের পাশের মেথরপট্টি, মুগদাপাড়া, সবুজবাগ, মাদারটেক, নন্দীপাড়া, সায়েদাবাদ, শনির আখড়া, মাতুয়াইল, নয়াবাজার, ধলপুর, দনিয়া, নারিন্দা, সিদ্দিকবাজার, মহাখালী, প্রগতি সরণি, কুড়িল, জোয়ারসাহারা, আশকোনা ও বাড্ডা এলাকায়।
সূত্র মতে, প্রকাশ্যে বা খোলা রাজপথে মাদক সেবন সবচেয়ে বেশি চলে চানখাঁরপুল, নয়াবাজার আর কারওয়ান বাজার এলাকায়। কোনো গোপনীয়তা বা রাখঢাক নেই এই এলাকার মাদকসেবীদের। তবে এসব এলাকার মাদকসেবীদের বেশির ভাগই বেকার, টোকাই, রিকশাচালক, পরিবহন শ্রমিক ও ছিঁচকে অপরাধীসহ সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষ। অভিজাত এলাকায় প্রকাশ্যে নেশাদ্রব্য বেচাকেনা বা গ্রহণ খুব কম হয়। তবে ইদানীং 'সিসা' বা হুক্কা নামে এক ধরনের নেশা অভিজাত এলাকায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এই হুক্কা বা সিসার আসর বসে মূলত অভিজাত পাড়ার কয়েকটি রেস্টুরেন্টে। এই নেশায় আসক্তদের বেশির ভাগই নগরীর বিভিন্ন নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী এবং অভিজাত পাড়ার ধনী পরিবারের ছেলেমেয়ে। তবে পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারের স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের মধ্যেও সাম্প্রতিক সময়ে এই নেশা গ্রহণের প্রবণতা দেখা দিয়েছে।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) খন্দকার হাসান মাহমুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, অস্ত্র, ডাকাতি, খুন, ছিনতাইসহ দেশে প্রতিনিয়ত যেসব অপরাধ ঘটে চলছে সেগুলোর বেশির ভাগের পেছনেই রয়েছে মাদক। তিনি বলেন, মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের পৃথক একটি সংস্থা আছে। পাশাপাশি পুলিশ ও র‌্যাব তাদের মতো করে কাজ করে যাচ্ছে। মাদকের বিরুদ্ধে তাদের বিশেষ অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলেও তিনি জানান।
বেশ কয়েকজন নেশাগ্রস্ত তরুণ-তরুণী এবং ঢাকার ব্রেইন অ্যান্ড লাইফ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফখরুল ইসলামের সঙ্গে আলাপকালে বের হয়ে এসেছে নেশার নানা উপকরণের বিষয়। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে অনুসন্ধান চালিয়েও এই নেশা গ্রহণের নানা দৃশ্য চোখে পড়েছে। এর মধ্যে কিছু এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে।
ককটেল : এটিকে ফেনসিডিলের সহজ সংস্করণ বা লোকাল ফেনসিডিলও বলে অনেকে। আর্থিক কারণে যারা ফেনসিডিল কিনে খেতে পারে না, তারাই ঝুঁকছে এর প্রতি। নগরীর বিভিন্ন অলিগলির ছোটখাটো ওষুধের দোকানে অবাধে বিক্রি হচ্ছে এই ককটেল তৈরির উপাদান। ককটেলের উপকরণ নেশায় আসক্তরা আলাদাভাবে কিনে নিয়ে যায়। এর দাম পড়ে বোতলপ্রতি বড়জোর ৩০ টাকা। বিক্রেতারা পরিচিত এবং নির্দিষ্ট কিছু ক্রেতা ছাড়া অন্য কারো কাছে এগুলো বিক্রি করে না।
সাত রাস্তার মোড় : পুরান ঢাকায় এর প্রচলন কিছুটা বেশি। প্যাথিডিন, মরফিন বা ফ্যানারগান-জাতীয় তরল ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরের জঙ্ঘার (কুঁচকি) কাছে রগে নেওয়া হয়। রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকার ওষুধের মার্কেটের সামনে দেখা গেল একটি ট্রাকের আড়ালে দুজন এই ইনজেকশন নিচ্ছে। তাদের ভাষ্য, কুঁচকি সাতটি রগের মিলনকেন্দ্র। তাই নাম দেওয়া হয়েছে সাত রাস্তার মোড়। ইনজেকশনগুলো তারা হাসপাতালের কর্মচারীদের কাছ থেকে জোগাড় করে বলেও জানায়।
টাইটানিক : জিহ্বা বা তালুতে ইনজেকশনের মাধ্যমে প্যাথিডিন-জাতীয় ওষুধ গ্রহণ করা। এর প্রবণতা পুরান ঢাকাতেই বেশি। নয়াবাজার ইউসুফ মার্কেটের পেছনে গিয়ে এই নেশায় আসক্তদের কয়েকজনকে পাওয়া যায়। তাদের মতে, সদরঘাটের কিছু নৌযান শ্রমিকের মাধ্যমে এ নেশাটি ঢাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। নদীপথের শ্রমিকরা এ নেশায় আসক্ত বেশি। তাই এর নাম হয়েছে টাইটানিক।
পুলিশ ভাজা বা টিকটিকি ফ্রাই : টিকটিকির শরীরের উপকরণ নিয়ে বানানো হয় বলেই এমন নাম। সায়েদাবাদ টার্মিনাল এলাকার পরিবহন শ্রমিক রাজু ও কামাল এই প্রতিবেদককে জানায়, তারা নিছক মজা করতে করতেই এ নেশায় জড়িয়ে গেছে। মোবারক নামের তাদেরই আরেক বন্ধু জানায়, এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে সে এই নেশা নিতে শিখেছে। পুলিশকে তাদের অনেকে টিকটিকি বলে। আর এ কারণেই তারা মজা করে এই নেশাকে পুলিশ ভাজাও বলে। রাজধানীতে এ ধরনের নেশাখোরের সংখ্যা হাতে গোনা। সায়েদাবাদ, নিমতলী, ফুলবাড়িয়া ও গাবতলী এলাকায় কয়েকজন পরিবহন হেলপার আছে, তারা প্রতি সপ্তাহে তিন থেকে চারবার এই নেশা নিয়ে থাকে।
জিনের বাদশা : কারওয়ান বাজার এলাকার এক বালক। বয়স খুব বেশি হলে ১২ বছর। কাঁচামালের বোঝা টানার কাজ করে। রাত সাড়ে ১০টার দিকে তাকেও দেখা গেল মসজিদ গলিতে বসে নেশা করছে। তবে একা। পাশে গোল হয়ে বসে আরো দুই বালক তার এই নেশা গ্রহণের দৃশ্য দেখছে। জটলা দেখে এগিয়ে যাওয়ার পর ওই বালকেরই এক বন্ধু জানাল, 'স্যার, ওরে জিনের বাদশা ধরছে।' নেশা গ্রহণকারী ওই বালক জানায়, তার নাম সামসু। গত এক বছর ধরে সে এই নেশা গ্রহণ করে। পলিথিনের ভেতর পানির সঙ্গে এক ধরনের আঠা মিশিয়ে ঝাঁকিয়ে এই নেশাদ্রব্য তৈরি করা হয়। ছেলেগুলো বলে, এই নেশা নিলে শরীরটা অনেক হালকা হয়-মনে হয় আকাশে জিন-পরীর মতো উড়ছে। তাই নাম জিনের বাদশা। রাজধানীর বস্তি বা টার্মিনাল এলাকায় পলিথিনে ঢুকিয়ে এই নেশা শ্বাসের সঙ্গে নিতে দেখা যায়।
স্যান্ডউইচ : জেলির সঙ্গে এক ধরনের মলম ও বিশেষ কালি মিশিয়ে এক ধরনের পেস্ট তৈরি করা হয়। এরপর পাউরুটিতে মাখিয়ে স্যান্ডউইচের মতো গ্রহণ করা হয়। তিন-চার বছর হলো গণকটুলী সুইপার কলোনির মাদক বিক্রেতারা স্যান্ডউইচ নাম দিয়ে এই নেশা চালু করেছে। এগুলো সাধারণত কিনতে পাওয়া যায় না। সেবনকেন্দ্রে গিয়ে অর্ডার দিলে পরিবেশন করা হয়। গণকটুলী সুইপার কলোনি এবং ধলপুর সিটি পল্লীতে এ ধরনের কয়েকজন নেশায় আসক্তকে পাওয়া গেছে।
এ ছাড়া ধনাঢ্য পরিবারের অনেক সন্তান এখনো ইয়াবা গ্রহণ করছে। বাবা, লাল জবা, লাল গোলাপ, চামেলী, ক্রেজি, ক্যান্ডি, চকোলেট_নানা নামে নেশাটি প্রচলিত। যথারীতি আছে ফেনসিডিল। ফেনসি, ডাইল, ফেন্টুস, মধু বা ইঞ্চিসহ নানা নামে এটি পরিচিত। আরো আছে হেরোইন ও গাঁজা। দুটিই মূলত পুরিয়া নামে প্রচলিত।

সড়ক নিরাপত্তা উপেক্ষিত by আনোয়ার হোসেন

Tuesday, August 16, 2011

দেশে সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল রয়েছে। আছে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধবিষয়ক সেলও। এগুলো যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীন। কিন্তু একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটলেও এই প্রতিষ্ঠানগুলো নিষ্ক্রিয়। সরকারও নির্বিকার।

সরকারি হিসাবে বছরে গড়ে তিন হাজারের বেশি লোক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা ১২ থেকে ২০ হাজার। বিশেষজ্ঞরা সড়ক দুর্ঘটনার জন্য ভাঙাচোরা ও ত্রুটিপূর্ণ সড়ক, ভুয়া লাইসেন্সধারী চালক এবং জনসচেতনতার অভাবকে দায়ী করছেন।
সারা দেশে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) অধীন জাতীয় ও আঞ্চলিক সড়ক ১৮ হাজার কিলোমিটার। এর মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ সড়কের দশা বেহাল ও ত্রুটিপূর্ণ। তা ছাড়া পেশাদার চালকের লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে মন্ত্রীর সুপারিশে ও পরীক্ষা ছাড়াই। আর সচেতনতা সৃষ্টির কার্যক্রমও চোখে পড়ে না।
সড়ক দুর্ঘটনাকে নরহত্যা হিসেবে গণ্য করে দায়ী চালকদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ার আইন করা হয়েছিল ১৯৮৫ সালে। শ্রমিক সংগঠনগুলোর চাপে সরকার পরে আইন সংশোধন করে। এখন চালকের ভুলে দুর্ঘটনা হলে এক থেকে তিন বছর কারাদণ্ডের বিধান আছে। আইনটি যুগোপযোগী করতে ২০০৭ সালে একটি কমিটি করেছিল যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। কমিটি আইনের খসড়া তৈরি করেছে। খসড়াটি চার বছর ধরে এ-টেবিল ও-টেবিল ঘুরছে, আইনে পরিণত হয়নি। ফলে একটি দুর্ঘটনার পর কয়েক দিন হইচই হলেও বাস্তব কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।
সরকারি হিসাবে ১৯৯৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত এক যুগে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৩৮ হাজার লোক। আহত হয়েছে ৩৫ হাজার। এ সময় দুর্ঘটনা ঘটেছে প্রায় ৫০ হাজার।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই) মনে করে, পুলিশ দুর্ঘটনা ও হতাহতের যে হিসাব দেয়, প্রকৃত সংখ্যা এর তিন গুণ। অবশ্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ২০০৭ সালের হিসাবে বলা হয়েছে, এ বছর বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২০ হাজার ৩৪ জন মারা যায়। বাংলাদেশের প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে ১২ দশমিক ৬ জন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় বলে ডব্লিউএইচও উল্লেখ করে।
যুক্তরাজ্য সরকারের বৈদেশিক উন্নয়ন সংস্থার (ডিএফআইডি) ২০০৪ সালের এক জরিপে বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশের মোট দেশীয় উৎপাদনের (জিডিপি) ১ দশমিক ৬ শতাংশ ক্ষতি হয়। তবে এআরআইয়ের সাবেক পরিচালক মাজহারুল ইসলাম বলেন, এখন সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জিডিপির ২ শতাংশেরও বেশি।
নিষ্ক্রিয় কাউন্সিল: সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের তিন মাস পর পর বৈঠক করার কথা। কিন্তু এই সরকারের পৌনে তিন বছরে বৈঠক হয়েছে মাত্র তিনটি। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এই তিনটি বৈঠকের একটি করা হয়েছে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের অনুরোধে। গত ২৭ জুলাই বৈঠকটি হয়। এখানে সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি। উল্টো সাড়ে ২৪ হাজার পেশাদার চালককে পরীক্ষা ছাড়াই লাইসেন্স দেওয়া এবং পরিবহন খাতে চাঁদা নির্ধারণ নিয়ে আলোচনা হয়।
নৌমন্ত্রীর চাপে ২০০৯ সালে ১০ হাজার লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল পরীক্ষা ছাড়া। এবার তাঁর শ্রমিক সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন ফেডারেশন সাড়ে ২৪ হাজার লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছে।
সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলে সরকারি কর্মকর্তা, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধি আছেন। একাধিক সদস্য জানান, সর্বশেষ বৈঠকে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের ডাকাই হয়নি। কাউন্সিলের সদস্য ও নিরাপদ সড়ক চাই-এর চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এভাবে মানুষ মরছে, কিন্তু সরকারিভাবে কোনো গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যেও কোনো সমন্বয় নেই।’
একইভাবে সওজ ও বিআরটিএর একটি সেল আছে। বিআরটিএর সেলটি শুধু পুলিশের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে একটি বই প্রকাশ ও চালকদের জন্য কয়েকটি সেমিনার করে। আর সওজের সেলটির কাজ কী, তা কেউ বলতে পারে না।
জানতে চাইলে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন বলেন, ভাঙাচোরা সড়ক ও সড়কের ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনা হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে সওজকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও বসবেন তিনি। সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠক সম্পর্কে মন্ত্রী বলেন, খুব শিগগির সবাইকে নিয়ে বৈঠক হবে। পরীক্ষা ছাড়া পেশাদার লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘একেবারে পরীক্ষা ছাড়া নয়। ন্যূনতম পরীক্ষা নিয়ে যারা যানবাহন চালাতে পারে, তাদের লাইসেন্স দেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে।’
দুর্ঘটনা হলেই সরকার একটু তৎপর হয়, তারপর ভুলে যায়, কেন? জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘এবার আমরা খুব সিরিয়াস। সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ করতেই হবে।’
কাজ হয় না: যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বুয়েটের এআরআই গত বছর জুনে সারা দেশের ২১৬টি স্থানকে অতি দুর্ঘটনাপ্রবণ (ব্ল্যাক স্পট) হিসেবে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সওজের কাছে পাঠায়। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কেও বিষয়টি জানানো হয়। কিন্তু এক বছরেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এআরআই সূত্র বলছে, একটি নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে বছরে তিনবার বা তারও বেশি দুর্ঘটনা ঘটলে এটাকে ব্ল্যাক স্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ব্ল্যাক স্পটগুলোতে সড়কের অস্বাভাবিক বাঁক থাকে, সড়কের পাশে হাটবাজার গড়ে ওঠে এবং সড়ক সংকেত থাকে না। শনিবার মানিকগঞ্জের যে স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় মিশুক মুনীর ও তারেক মাসুদ মারা গেছেন, সেটিও একটি ব্ল্যাক স্পট।
গতকাল দুর্ঘটনাস্থলটি পরিদর্শনে গিয়েছিলেন এআরআইয়ের পরিচালক ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক হাসিব মোহাম্মদ আহসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দুর্ঘটনাস্থলে সড়ক সংকেত (ওভারটেক করা যাবে, যাবে না; গতিসীমা কত) নেই। অত্যধিক বাঁক ও সড়কের পাশের গাছপালাও দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।
এআরআই পরিচালক বলেন, সরকার কলেরা ও পোলিওকে মহামারি হিসেবে ঘোষণা দিয়ে সে অনুযায়ী পরিকল্পনা ও কর্মসূচি নিয়ে সফল হয়েছে। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা একটি মহামারি হলেও এ নিয়ে কোনো পরিকল্পনা ও কর্মসূচি নেই। আগামী এক বছরে কী পরিমাণ সড়ক দুর্ঘটনা কমবে, সে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে কর্মসূচি ঠিক করে এগোতে হবে।
এআরআই পরিচালক বলেন, এবার দুর্ঘটনার হার বেশি এবং হতাহতের সংখ্যাও বেড়েছে। এর কারণ সম্পর্কে তিনি সড়কের দুরবস্থা, যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি, বেপরোয়া যান চলাচলের কথা উল্লেখ করেন।
সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, কোনো রকম অর্থ খরচ না করে শুধু সচেতনতা বৃদ্ধি, চালকের প্রশিক্ষণ, মোটরযান আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব। আর পরিকল্পিতভাবে সড়ক নির্মাণ, ত্রুটিমুক্ত যানবাহন নিশ্চিত করা এবং এই খাতে গবেষণা-পরিকল্পনার মাধ্যমে দুর্ঘটনা একেবারে কমিয়ে আনা যায়। কিন্তু বাংলাদেশে এর কোনোটাই হচ্ছে না।
ঢাকা-আরিচা মরণফাঁদ: আরিচা হয়ে ঢাকা-বাংলাবান্ধা মহাসড়কের দূরত্ব ৫০৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে ঢাকা-আরিচা অংশের দূরত্ব ৮৮ কিলোমিটার। এই ৮৮ কিলোমিটার পথে প্রতিবছর গড়ে ১৪৫ জন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে। আরিচা পার হয়ে বাংলাবান্ধা পর্যন্ত এত মানুষের প্রাণহানি হয় না বলে বিআরটিএ ও এআরআই সূত্র জানায়। ঢাকা-আরিচা পথে প্রতিবছর গড়ে ১৩১টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এই অংশটুকুতে ২২টি স্থান রয়েছে, যেখানে প্রতিবছরে গড়ে তিনটি দুর্ঘটনা ঘটে।
আরও ঝুঁকিপূর্ণ সড়ক: সওজ ও সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণাকেন্দ্রের হিসাবে, সারা দেশে অন্তত ১০০ কিলোমিটার মহাসড়ক খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এই ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে অন্তত ২১৬টি স্থান আছে (ব্ল্যাক স্পট), যেখানে বছরে অন্তত তিনটি করে দুর্ঘটনা ঘটে।
দেশে নয়টি জাতীয় মহাসড়ক আছে। দূরত্ব সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার। এই মহাসড়কের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলো হচ্ছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাঁচপুর সেতুর পূর্ব প্রান্ত, গজারিয়া, দাউদকান্দি, সোনারগাঁ ও মধ্যবাউশিয়া। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের টেপারা বাসস্ট্যান্ড, জয়পাড়া বাসস্ট্যান্ড, পুখুরিয়া বাসস্ট্যান্ড, সাভার বাজার ও বাথুলী উল্লেখযোগ্য।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মধ্যে কাঁচপুর সেতুর পূর্ব প্রান্তে ৬০০ মিটার জায়গার মধ্যে ১৯৯৮ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ৪৯ জন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়।
দেশের সড়ক দুর্ঘটনার প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে বিআরটিএ জানায়, ৩৭ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে জাতীয় মহাসড়কে, ১২ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে এবং ১৫ শতাংশ শাখা সড়কে (ফিডার রোড)।
বাংলাদেশে দুর্ঘটনা বেশি: ২০০৯ সালে এআরআই এশিয়া, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের ১৫টি দেশের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর একটি তুলনামূলক চিত্র প্রকাশ করে। এতে দেখা গেছে, ১৫টি দেশের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর দিক থেকে বাংলাদেশ দ্বিতীয়। এ তালিকায় নেপাল প্রথম।

পুলিশ বেপরোয়া রুখবে কে by শরীফুল ইসলাম ও সাহাদাত হোসেন

Wednesday, August 10, 2011

বেপরোয়া হয়ে উঠছে পুলিশ। একের পর এক লোমহর্ষক ও বিতর্কিত ঘটনার জন্ম দিয়ে চলেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত এ সংস্থাটি। জানমাল রক্ষার পরিবর্তে পুলিশ এখন ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে বলে ধারণা অনেকের মধ্যে বদ্ধমূল হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও পুলিশকে যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। গণমাধ্যমে এ নিয়ে বেশ সমালোচনাও হচ্ছে। সরকারের ভাবমূর্তিও নষ্ট হচ্ছে ব্যাপকভাবে। জনমনে প্রশ্ন, বেপরোয়া এ পুলিশকে রুখবে কে? বিশিষ্টজনরা এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে সমকালকে বলেছেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় পুলিশে লোক নেওয়া বন্ধ করতে হবে। পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের প্রথাও বন্ধ করার কথা বলেছেন তারা। এসব ঘটনায় সারাদেশ তোলপাড়। নিরুদ্বিগ্ন শুধু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
গত ২৭ জুলাই সকালে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে পুলিশ এক ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটায়। ১৬ বছরের এক কিশোরকে পুলিশের গাড়ি থেকে নামিয়ে জনতার হাতে তুলে দেওয়া হয়। তারপর গণপিটুনিতে সে মারা
যায়। এ নির্মম হত্যাকা পুলিশের সামনেই ঘটে। মোবাইল ফোনে ধারণ করা এ ঘটনার ভিডিও টেপ প্রচার করা হয়েছে গণমাধ্যমে। ঘটনাটি বিবেকমান মানুষকে হতবাক, অশ্রুসিক্ত করেছে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল কাদেরকে নিয়ে পুলিশের 'প্যাকেজ' নাটক আরেকটি অবিশ্বাস্য ঘটনা। এর আগে সাভারের আমিনবাজারের বড়দেশী গ্রামে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পুলিশ ওই ছাত্রদের ডাকাত বানানোর অপচেষ্টা চালায়। এর আগে ঝালকাঠিতে লিমনকে গুলিতে আহত করে র‌্যাব। তাকেও সন্ত্রাসী বানানোর নানা অপচেষ্টা চালানো হয়।
কখনও কখনও স্বতঃপ্রণোদিত উচ্চ আদালত নির্যাতিতদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। পুলিশকে ভর্ৎসনাও করেছেন। এতেও তেমন সুফল আসছে না।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুর্বলতা, পুলিশ প্রশাসনে দলীয়করণের মাত্রা বেড়ে যাওয়া, পুলিশের অভ্যন্তরীণ গ্রুপিং এবং চেইন অব কমান্ড দুর্বল হয়ে যাওয়ার কারণে পুলিশে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। এসব অপরাধ কমাতে হলে পুলিশকে দলীয়করণমুক্ত করতে হবে। অপরাধী পুলিশের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এটি না করলে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলে তারা আশঙ্কা করছেন।
তবে পুলিশের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ মানতে নারাজ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু। এগুলোকে তিনি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে দাবি করেছেন। তিনি সমকালকে বলেন, পুলিশ প্রশাসন বিগত সময়ের চেয়ে অনেক ভালোভাবেই চলছে। পুলিশ প্রশাসনের ভালো কাজের কারণেই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে। নির্বিঘ্নে সাধারণ মানুষ চলাচল করছে। কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার তদন্ত হচ্ছে। এতে কারও জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এসব প্রথাসিদ্ধ বক্তব্য।
প্রতিমন্ত্রীর এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এসএম শাহজাহান সমকালকে বলেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি তেমন ভালো নয়। দলীয়করণ বেড়ে যাওয়ার কারণে বেশ কিছু ঘটনা ঘটছে, যা পুলিশের কাছ থেকে কেউ আশা করে না। এতে সরকার ও পুলিশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। পুলিশকে বিরোধী দল দমনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
ঘটনা এক : ২৭ জুলাই সকালে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে ঘটে এক অকল্পনীয় ঘটনা। মিলন নামে ১৬ বছরের এক কিশোরকে পুলিশের গাড়ি থেকে নামিয়ে জনতার হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। তারপর গণপিটুনিতে সে মারা যায়। অবিশ্বাস্য এ হত্যাকা ঘটে পুলিশের উপস্থিতিতে। কোম্পানীগঞ্জে ওইদিন ডাকাত সন্দেহে পৃথক স্থানে ছয়জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বলে পুলিশ দাবি করেছিল। এর মধ্যে টেকেরবাজার মোড়ে মারা হয় তিনজনকে। তাদেরই একজন কিশোর শামছুদ্দিন মিলন। মিলনকে মারা হয় সকাল সাড়ে ১০টায়। আর বাকি দু'জনকে মারা হয় ভোরবেলায়। মিলনকে হত্যার অভিযোগ এনে তার মা বাদী হয়ে আদালতে মামলা করেন। এ ঘটনায় 'দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে' শনিবার রাতে কোম্পানীগঞ্জ থানার তিন পুলিশ সদস্যকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। পুলিশ এখানেই তার দায়িত্ব শেষ করেছে। এ ঘটনায় দেশব্যাপী আলোচনার ঝড় উঠেছে।
ঘটনা দুই : সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাদেরকে ডাকাত প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে পুলিশ। তাকে তিনটি মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা করে। পুলিশের দাবি, ১৫ জুলাই রাতে ঢাবি ছাত্র আবদুল কাদের ও মামুন হোসেন নামে অপর একজনকে গ্রেফতার করা হয়। গাড়িযোগে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের প্রস্তুতিকালে খিলগাঁও বিশ্বরোড এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের সঙ্গে থাকা চারজন পালিয়ে যায়। পুলিশের দাবি, স্থানীয় জনতা কাদের ও মামুনকে গণপিটুনি দেয়। তবে গণপিটুনির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কাদেরকে গ্রেফতার করে খিলগাঁও থানা পুলিশ নির্মম নির্যাতন চালায়। খিলগাঁও থানার অফিসার ইনচার্জ কাদেরকে কুপিয়ে জখম করেন। সংবাদপত্রে এমন মর্মন্তুদ খবর প্রকাশিত হলে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত দায়ী পুলিশ কর্মকর্তাদের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। জামিনে মুক্তি পান কাদের। অনেকের অভিযোগ, কাদেরের মতো অনেককেই পুলিশ ফাঁসিয়ে দিচ্ছে। কাদেরের বিষয়টি আলোর মুখ দেখলেও অনেক ঘটনাই থাকে আড়ালে।
ঘটনা তিন : চলতি বছরের ১৮ জুলাই আমিনবাজারে ডাকাত সন্দেহে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করে গ্রামবাসী। চাঞ্চল্যকর ওই ঘটনার পরও পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। আমিনবাজারের ঘটনায় বেঁচে যাওয়া কিশোর আল আমিন জানায়, স্থানীয় জনগণ যখন তাদের বেধড়ক পেটাতে থাকে তখন সেখানে পুলিশ উপস্থিত ছিল। পুলিশের এক সদস্যকে পা জড়িয়ে ধরে তারা বলতে থাকে, 'ভাই আমরা ডাকাত নই। আমরা ঘুরতে এসেছি।' এরপর এক পুলিশ সদস্য তাকে বলে, 'যদি বাঁচতে চাস, তাহলে ডাকাতির পক্ষে সাক্ষী দিতে হবে। না হলে তোকে গ্রামবাসীর হাতে ছেড়ে দেওয়া হবে।' আমিনবাজারের ঘটনার পর পুলিশের ভূমিকাকে কেন অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করা হবে না তা সরকারের কাছে জানতে চান হাইকোর্ট।
ঘটনা চার : ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা লিমনকে ২৩ মার্চ বিকেলে র‌্যাব-৮-এর একটি দল আটক করে। এ সময় লিমন নিজেকে কাঁঠালিয়া পিজিএস কারিগরি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী বলে পরিচয় দেন; কিন্তু র‌্যাবের এক সদস্য লিমনের কথা না শুনেই তার বাঁ পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় লিমনের একটি পা কেটে ফেলতে হয়। লিমনের এ ঘটনা জানাজানি হলে দেশব্যাপী ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সোচ্চার হয়ে ওঠে দেশি-বিদেশি একাধিক মানবাধিকার সংগঠন। আদালত লিমনের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে সরকারকে নির্দেশ দেন। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তে সরকারের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত টিমও গঠন করা হয়। এরই মধ্যে তদন্ত দল তাদের রিপোর্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে; কিন্তু রিপোর্টটি ফ্রিজে চলে গেছে। আজ পর্যন্ত রিপোর্টটি প্রকাশ করেনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো লিমনকে দোষী বানাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একাধিক বক্তব্য দেন।
সমন্বয়হীনতা : আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে সাম্প্রতিককালে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাওয়ার পেছনের কারণ অনুসন্ধান করেছে সমকাল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ে আলাপ করা হয়। তাদের মতে, পুলিশে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। চেইন অব কমান্ডও পুরোপুরি মানা হচ্ছে না। ফলে এসব ঘটনা ঘটছে।
অভিযোগ রয়েছে, খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন পুলিশকে কোনো নির্দেশ দিলেও তারা শুনছে না। তারা দোহাই দিচ্ছে কোনো উপদেষ্টা বা দলীয় কোনো উচ্চ পর্যায়ের নেতার। গত জুনে পুলিশের এক কর্মকর্তার ব্যর্থতার কারণে তার কর্মস্থল থেকে অন্য কর্মস্থলে বদলি করতে পুলিশ হেডকোয়ার্টারকে নির্র্দেশ দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। হেডকোয়ার্টার থেকে বলা হয়, সরকারের একজন উপদেষ্টার নির্দেশ রয়েছে তাকে ওই কর্মস্থলে বহাল রাখার। এ ব্যাপারে তারা লিখিত একটি চিঠিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে পাঠান। পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ প্রসঙ্গটি চেপে যান। এভাবে পুলিশের কিছু কিছু অপরাধের দায়ভার নিতে হচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সভায় পুলিশের যে পদমর্যাদার কর্মকর্তার উপস্থিত থাকার কথা তারা উপস্থিত না থেকে প্রতিনিধি হিসেবে জুনিয়র কর্মকর্তাদের পাঠাচ্ছেন। এতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব হচ্ছে। বারবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বৈঠকের জন্য নির্ধারিত কর্মকর্তাকে উপস্থিত থাকার নির্দেশ দেওয়া হলেও তারা তা মানছেন না। বিশেষ করে পুলিশের পদোন্নতির জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডিপিসির বৈঠকে আইজিপির উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও তিনি উপস্থিত থাকছেন না। আইজিপির প্রতিনিধি দিয়ে মিটিং চালাতে হচ্ছে। ফলে সঠিক মূল্যায়ন করে অনেক ক্ষেত্রে নীতিমালা অনুযায়ী পদোন্নতি দেওয়া যাচ্ছে না। পুলিশের পক্ষ থেকে যে তালিকা পাঠানো হচ্ছে তাদেরই যাচাই-বাছাই না করে পদোন্নতি দিচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পদায়নের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটছে। এর প্রভাব পুলিশ প্রশাসনের উচ্চ থেকে তৃণমূল পর্যায়ে পড়ছে।
মাঠ পর্যায়ে পুলিশ : তৃণমূলে ওসি শুনছেন না এসপির কথা, আবার এসপি শুনছেন না ডিআইজির কথা। তারা কথায় কথায় এমপি-মন্ত্রীদের দোহাই দিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন। এতে বেড়ে যাচ্ছে পুলিশের অপরাধপ্রবণতা। অপরাধ করলেও শাস্তি দেওয়ার মতো কেউ থাকছেন না। এসব অপরাধ তদন্তে পুলিশের কর্মকর্তা দিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও তা কোনো কাজে আসছে না। নানা ফাঁক-ফোকর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে পুলিশের এসব অপরাধী। এমনকি অপরাধে জড়িয়ে পড়া এসব পুলিশ কর্মকর্তাকে শাস্তি না দিয়ে প্রাইজ পোস্টিংও দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি এমন কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় জড়িত পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাৎক্ষণিক এসব কর্মকর্তাকে লঘু শাস্তি দেওয়া হলেও পরে এ শাস্তি প্রত্যাহার করা হচ্ছে। আর অপরাধে জড়িয়ে পড়া পুলিশকে গুরুদণ্ড না দেওয়ায় তারা বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। এ বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট হওয়ায় ওসিসহ কর্মকর্তা নিয়োগ হচ্ছে স্থানীয় এমপিদের ইচ্ছায়। বিনা বাক্যব্যয়ে এমপির হুকুম তালিম করা না হলে তাকে শাস্তিমূলকভাবে বদলি করা হয়। এ ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অসহায়।
পুলিশ মহাপরিদর্শকের বক্তব্য : পুলিশ মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার সমকালকে বলেন, পুলিশ সদস্যরা সততা, নিষ্ঠা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে। তবে মুষ্টিমেয় কিছু সদস্য ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম ও অপরাধে জড়াচ্ছে_ এটা অস্বীকার করছি না। যাদের বিরুদ্ধে অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পুলিশ কোনো ধরনের অপরাধের সঙ্গে আপস করে না, যার প্রমাণ পুলিশের বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থার নজির। বাংলাদেশ পুলিশের যে সংখ্যক সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় তা জনপ্রশাসনে নজিরবিহীন।
এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশ মহাপরিদর্শক বলেন, সাভারের বড়দেশী গ্রামে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাদেরের ঘটনায় পুলিশের বিভাগীয় পর্যায়ে তদন্ত চলছে। কাদেরের ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাকে তার দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এসব ঘটনায় তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পরই প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে।
পুলিশ প্রায়ই নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছে_ এটা এড়ানো সম্ভব কি-না, এমন প্রশ্নের জবাবে হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, পুলিশের প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়ার মধ্যেই রয়েছে তারা কী ভাবে জনগণের বন্ধু হিসেবে কাজ করবে। পুলিশের প্রশিক্ষণ একটি চলমান প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ার মধ্যে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বিষয় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। পুলিশ বাহিনীতে মানবাধিকার, নারীর অধিকার, সমঅধিকার, লিঙ্গ ইত্যাদি অনেক বিষয়েই আগের চেয়ে বেশি গুরুত্বসহকারে ধারণা দেওয়া হচ্ছে। কাদের ও সাভারের বড়দেশী গ্রামের ঘটনায় তদন্ত কমিটির সুপারিশেই থাকবে কী ভাবে পরে এ ধরনের পরিস্থিতি এড়ানো যায়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পুলিশের দূরত্ব রয়েছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশ মহাপরিদর্শক বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমাদের ভালো সমঝোতা রয়েছে। আমরা বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই কাজ করছি।
এমন অভিযোগ পাওয়া যায় ওসিদের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের 'মধুর' সম্পর্কের কারণে পুলিশের কাজে ব্যাঘাত ঘটছে_ এ প্রশ্নের উত্তরে হাসান মাহমুদ খন্দকার সমকালকে বলেন, আমাদের কাছে এ ধরনের কোনো অভিযোগ নেই। পুলিশের প্রত্যেক সদস্য তার কাজের বিষয়ে অবগত। রাজনৈতিক প্রভাব ব্যক্তিগত বিষয়।
সাবেক দুই মহাপরিদর্শকের বক্তব্য : সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক এম আজিজুল হক সমকালকে বলেন, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় আমাদের গোটা ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমের ওপর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। মানুষ পুলিশের ওপর আস্থা হারিয়ে নিজের হাতে আইন তুলে নিচ্ছে। নোয়াখালীতে পুলিশের সামনে গণপিটুনিতে এক কিশোরের মৃত্যুর ঘটনাটি দুঃখজনক ও নিষ্ঠুর ।
এক প্রশ্নের জবাবে আজিজুল হক আরও বলেন, বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক দলগুলো পুলিশকে তাদের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করেছে। এতে পুলিশের চেইন অব কমান্ড কিছুটা হলেও বিঘ্ন হয়। সব কিছুর পরও বিপদে পড়লে মানুষ শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে পুলিশের কাছেই যায়। সেখানে ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা জরুরি। এটা ঠিক, যে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাদেরের ঘটনায় ওসির শাস্তি হয়েছে। নোয়াখালীর ঘটনায়ও সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সাভারের আমিনবাজারের ঘটনায় তদন্ত হচ্ছে।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা সমকালকে বলেন, পুলিশের বর্তমান কিছু কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে, তাদের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণে কোথাও যেন একটা গলদ রয়েছে। নোয়াখালী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাদেরের ঘটনায় মনে হয় পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্যের আইন-কানুন সম্পর্কে জানা নেই। সব পুলিশ সদস্যকেই তাদের দায়িত্ব ও আইন-কানুন সম্পর্কে বিস্তারিত শিক্ষা দেওয়া হয়।
 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. XNews2X - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু