Home » , , , , » ‘ভেবেছিলাম আর বাঁচব না’ -অপহূত স্বর্ণ ব্যবসায়ী মৃদুল চৌধুরী

‘ভেবেছিলাম আর বাঁচব না’ -অপহূত স্বর্ণ ব্যবসায়ী মৃদুল চৌধুরী

Written By Unknown on Tuesday, February 18, 2014 | 2:16 AM

‘হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ওরা আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। পড়ে গেলাম ধানখেতের কাদাপানিতে। মনে হচ্ছিল, আমাকে গুলি করে মেরে ফেলা হবে। এরপর জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান ফিরে দেখি সামনে রাস্তা, গাড়ি চলছে। এরপর উঠে দাঁড়াই।’

চট্টগ্রাম থেকে অপহূত স্বর্ণ ব্যবসায়ী মৃদুল চৌধুরী এভাবেই বলতে শুরু করেন মৃত্যুর দুয়ার থেকে বেঁচে আসার কাহিনি। ছয় দিন নিখোঁজ থাকার পর গতকাল ভোরে কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার কংস নগর এলাকায় তাঁকে ফেলে দিয়ে যায় অপহরণকারীরা। এরপর এক নৈশপ্রহরী তাঁকে বুড়িচং থানার দেবপুর পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে যান।
মৃদুলের ছয় দিন কেটেছে বিভীষিকাময়। প্রতিদিনই মনে করতেন, হয়তো এক দিনের জন্য বেঁচে গেলেন। নিজের মুখে বললেন, ‘ভেবেছিলাম আর বাঁচব না। কিন্তু ভগবান আমাকে বাঁচিয়ে এনেছেন।’ ফাঁড়ির বেঞ্চে বসা মৃদুল চৌধুরীর শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন। তবু সে ব্যথায় কাতর নন তিনি। বারবার চোখ মুছছিলেন। বলছিলেন, ‘আমার একমাত্র ছেলেটার এসএসসি পরীক্ষা চলছে। এর মধ্যেও সে পরীক্ষা দিচ্ছে। জানি না কেমন হচ্ছে। পরিবারের সবাই আমাকে নিয়ে উৎকণ্ঠায় আছে।’
কী হয়েছিল সেদিন? প্রশ্ন করতেই মৃদুল চৌধুরী একটু দম নিলেন। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘১১ ফেব্রুয়ারি সকালবেলা, সাড়ে ১০টা হবে। বাসা থেকে (চট্টগ্রামের পুরোনো টেলিগ্রাফ রোড) দোকানে যাচ্ছি। একটি মাইক্রোবাস এসে কিছু লোক নামল। এরপর ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে আমাকে কালো রঙের একটি গাড়িতে তোলে। ওরা আমাকে ধমক দিল, যেন চিৎকার না করি। আধঘণ্টা পর আরেকটি গাড়িতে তুলে মুখোশ পরিয়ে দেয়। আমাকে তুলে নেওয়ার কারণ জানতে চাইলাম। ওরা বলে, কোনো ধরনের শব্দ করবি না। আমাকে নিয়ে রাখে একটি কক্ষে, মুখোশ পরিয়ে। হাত-পা বাঁধা। শুধু খাবার ও বাথরুমে যাওয়ার সময় মুখোশ ও বাঁধন খুলে দেয়। দু-তিন দিন এভাবে চলল। এরপর একজন লোক এসে আমাকে লাঠি দিয়ে পেটাতে থাকে। আমার দুই পা, কোমর ও সারা শরীরে পেটায়, আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। একেক দিন আমাকে একেক স্থানে নিয়ে যায়। কিন্তু স্থানগুলো সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। কাল রাতে (রোববার) আমাকে একটি গাড়িতে তোলা হয়। মুখোশের নিচের অংশ ফাঁকা থাকায় দেখতে পেলাম, এটি একটি মিটসুবিসি ব্র্যান্ডের কালো জিপ। আমি পেছনের সিটে, দুই পাশে দুজন লোক বসা। সামনের সিটে আরও দুজন। অনেকক্ষণ আসার পর পাশে থাকা দুজন পরস্পরকে বলে, সামনে পুলিশের গাড়ি আছে। নামিয়ে দে। তখনো আমার মুখোশ পরা ছিল। হাত বাঁধা। ওরা আমার মুখে কী একটা লাগিয়ে ধাক্কা দিয়ে গাড়ি থেকে ফেলে দেয়। ধানি জমির কাদাপানিতে পড়ি। বৃষ্টি পড়ছে। মনে করেছি, গুলি করে মেরে ফেলবে। এ সময় অজ্ঞান হয়ে পড়ি। জ্ঞান ফিরে দেখি, রাস্তা দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে। তখন ধানখেত থেকে উঠে দাঁড়াই। সামনে এগিয়ে আসেন একটি লোক। নাম-পরিচয় জানতে চাইলে বলেন, তিনি কংস নগর বাজারের নৈশপ্রহরী, নাম হারুনুর রশিদ ভূঁইয়া। এটা কংস নগর বাজার পশ্চিমছিং এলাকা। আমি তাঁকে ঘটনা খুলে বলি। কিন্তু তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করছিলেন না। তাঁর মোবাইল ফোন থেকে আমার স্ত্রীকে ফোন করি। স্ত্রীর সঙ্গে কথা শুনে তিনি আমাকে কংস নগর বাজার পর্যন্ত নিয়ে আসেন। এরপর পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে আসেন।’
ওরা কোনো টাকাপয়সা চেয়েছিল? মৃদুল চৌধুরী বলেন, ‘না, কিছুই বলেনি। আমি জীবনে কারও ক্ষতি করিনি। রাজনীতি করি না। যারা আমাকে তুলে নিয়েছে, নির্যাতন করেছে, তাদের কাছে আমার অপরাধের বিষয়ে জানতে চেয়েছি। তারা কিছুই বলতে পারেনি।’
র‌্যাবের বিরুদ্ধে মামলা করায় আপনাকে অপহরণ করা হয়েছিল কি না, এমন প্রশ্ন করা হলে নিরুত্তর থাকেন এই ব্যবসায়ী।
মৃদুল চৌধুরীকে পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে আসা নৈশপ্রহরী বুড়িচং উপজেলার ভারেল্লা ইউনিয়নের পশ্চিমছিং গ্রামের হারুনুর রশিদ বলেন, ‘কাদা মাখা লোকটিকে উদ্ধার করে পুলিশকে খবর দিই। পুলিশ এসে তাঁকে উদ্ধার করে ফাঁড়িতে নিয়ে যায়।’
দেবপুর পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) দেবাশীষ দত্ত জানান, কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার কংস নগর বাজার থেকে মৃদুল চৌধুরীকে উদ্ধার করেন দেবপুর পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা। গতকাল বেলা ১১টা পর্যন্ত তিনি দেবপুর পুলিশ ফাঁড়িতে অবস্থান করছিলেন। এখানেই তাঁর সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর প্রতিবেদকের। এ সময় চট্টগ্রাম কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. কামরুজ্জামান ও স্বজনদের কাছে মৃদুল চৌধুরীকে হস্তান্তর করা হয়।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মৃদুল চৌধুরীর ছোট ভাই শিমুল চৌধুরী ও পিশতুতো ভাই টিটু বণিক এবং চট্টগ্রাম মহানগর কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) কামরুজ্জামানের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের পুলিশ দল দেবপুর পুলিশ ফাঁড়িতে পৌঁছান। সেখান থেকে পুলিশি পাহারায় মৃদুল চৌধুরীকে চট্টগ্রামে নেওয়া হয়।
সন্ধ্যায় চট্টগ্রামে পৌঁছেই মৃদুল চৌধুরীকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। এ সময় স্ত্রীসহ স্বজনেরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাঁরা অপহরণ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চান।
কিন্তু কারা এবং কেন তাঁকে অপহরণ করে ছয় দিন আটকে রাখল, এ প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। পুলিশ কমিশনারসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা হাসপাতালেই প্রায় দুই ঘণ্টা তাঁর সঙ্গে কথা বলেন।
মৃদুলের ভাই শিমুল চৌধুরী বলেন, ‘ভাইকে খুঁজে পেয়েছি, এটাই বড় পাওয়া।’
১১ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রাম শহরের পুরোনো টেলিগ্রাফ রোডের বাসা থেকে দোকানে যাওয়ার সময় র‌্যাব ও ডিবি পুলিশ পরিচয়ে মৃদুল চৌধুরীকে অপহরণ করা হয় বলে অভিযোগ পরিবারের। এর পর থেকে তাঁর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। এ ঘটনায় শিমুল চৌধুরী ওই দিন রাতে কোতোয়ালি থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে অপহরণ মামলা করেন। অপহরণের সঙ্গে র‌্যাব-পুলিশ জড়িত বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে। তবে র‌্যাব ও পুলিশ এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।

মামলার এক আসামি নিখোঁজ: অপহূত হওয়ার আগে স্বর্ণ ব্যবসায়ী মৃদুল চৌধুরী ৮০ ভরি স্বর্ণ ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগে র‌্যাব-২-এর মেজর রকিবুল আমীনসহ তিনজনকে আসামি করে আদালতে মামলা করেন। এই মামলার অপর দুই আসামি হলেন র‌্যাবের সোর্স ফাহাদ চৌধুরী ওরফে দীপু এবং মৃদুলের কর্মচারী বাবুল দাস। স্বর্ণ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে গত বছরের ৩ অক্টোবর ঢাকায়।
এদিকে এই ফাহাদ চৌধুরীকে তাঁর পরিবার খুঁজে পাচ্ছে না। তাঁর ভাই মো. কামরুজ্জামান ১৬ জানুয়ারি রাজধানীর মতিঝিল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি নং-৯৯৬) করেন। এতে উল্লেখ করা হয়, ফাহাদ চৌধুরী একজন পাথর ব্যবসায়ী। তিনি ব্যবসার কাজে ঢাকা ও চট্টগ্রামে অবস্থান করেন। গত ১৫ জানুয়ারি বেলা ১১টা থেকে তাঁর মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তাঁর গাড়িচালক জাহাঙ্গীর জানিয়েছেন, কমলাপুর ভাঙা মসজিদের সামনে থেকে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা তাঁকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়।

0 comments:

Post a Comment

 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. XNews2X - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু