বিমানের ধ্বংসাবশেষ অনুসন্ধানে নতুন আশা

Wednesday, April 9, 2014

মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসের নিখোঁজ উড়োজাহাজের সম্ভাব্য ধ্বংসাবশেষ থেকে সাগরতলে আরও দুটি নতুন সংকেত পাওয়া গেছে। এতে নতুন আশা সঞ্চারিত হয়েছে। দিন কয়েকের মধ্যেই কিছু একটা খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী অনুসন্ধানকারীরা। অস্ট্রেলীয় অনুসন্ধান দলের প্রধান অ্যাংগাস হিউস্টন আজ বুধবার অনেকটা আশাবাদী কণ্ঠে এ-সংক্রান্ত ঘোষণা দেন।

এ নিয়ে শব্দতরঙ্গের মাধ্যমে সাগরতল থেকে প্রবাহিত চারটি সংকেত পাওয়ার কথা দাবি করেছে অনুসন্ধানকারী দল। এর আগে মার্কিন নৌবাহিনী দুটি সংকেত পাওয়ার দাবি করে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেল ও রাতে আরও দুটি সংকেত পাওয়ার দাবি করেছে অস্ট্রেলীয় নৌবাহিনীর জাহাজ ওশেন শিল্ড।

ধারণা করা হচ্ছে, উড়োজাহাজটির ককপিটের তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণে ব্যবহূত ‘ব্ল্যাক বক্স’ থেকে শব্দগুলো ভেসে আসছিল। ব্ল্যাক বক্সের ব্যাটারির মেয়াদকাল এক মাস। দুর্ঘটনার পর ইতিমধ্যে এক মাস পেরিয়ে গেছে।

আজ সাংবাদিকদের হিউস্টন বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, আমরা সঠিক এলাকায় অনুসন্ধান চালাচ্ছি। আমি এখন আশাবাদী যে, আমরা ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাব। কয়েক দিনের মধ্যেই ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে আমরা আশাবাদী।’

বার্তা সংস্থা রয়টার্সে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানানো হয়, নতুন পাওয়া ওই সংকেতের সূত্র ধরে ভারত মহাসাগরের দূরবর্তী অংশে বিমানের ধ্বংসাবশেষ শনাক্তের কাজটি সহজ হবে না বলেও সতর্ক করেছেন অস্ট্রেলিয়ার ওই কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্ট এলাকায় আজ ১১টি সামরিক বিমান, চারটি বেসামরিক বিমান ও ১৪টি জাহাজ অনুসন্ধানের কাজে অংশ নিচ্ছে। কুয়ালালামপুর থেকে ২৩৯ জন আরোহী নিয়ে গত ৮ মার্চ রাতে বেইজিংয়ের পথে রওনা হওয়ার পর নিখোঁজ হয় উড়োজাহাজটি।

কৃত্রিম উপগ্রহের (স্যাটেলাইট) মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে মালয়েশিয়ার সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, উড়োজাহাজটি ভারত মহাসাগরের দক্ষিণ অংশে ধ্বংস হয়েছে। দুর্ঘটনাস্থল অস্ট্রেলিয়ার পার্থ শহর থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার পশ্চিমে।

গিনেস বুকে ‘আমার সোনার বাংলা’

লাখো কণ্ঠে গাওয়া বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের রেকর্ডকে স্বীকৃতি দিয়েছে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস কর্তৃপক্ষ।  গতকাল মঙ্গলবার গিনেস বুক কর্তৃপক্ষ তাদের ওয়েবসাইটে এক বিবৃতিতে এ কথা জানায়।

‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি...’ গত ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে রাজধানীর জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে এই গান পাওয়া হয়। সেই দিন সমবেত হয়েছিল লাখো বাঙালি। তাদের সঙ্গে সারা দেশে অসংখ্য বাঙালি কণ্ঠ ছেড়ে গেয়েছে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি...।’ ১৩ দিন পর তারই স্বীকৃতি পেল বাংলাদেশ।

লাখো লোকের মিলিত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গেয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়ার এই উদ্যোগটি ছিল সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের। বাস্তবায়নে সহায়তা করেছে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ। ওই দিন জাতীয় প্যারেড ময়দানে ঢোকার সময় স্বয়ংক্রিয় যান্ত্রিক গণনা অনুসারে লোক হয়েছিল দুই লাখ ৫৪ হাজার ৬৮১ জন। এতেই গত বছরের ৬ মে সাহারা গ্রুপের আয়োজনে এক লাখ ২২ হাজার লোকের একসঙ্গে জাতীয় সংগীত গাওয়ার ভারতের রেকর্ডটি ভেঙে নতুন বিশ্বরেকর্ড হয়। গতকাল সেটির চূড়ান্ত ফল জানিয়ে দেয় গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস।

এই চেতনা অমর হোক- লাখো কণ্ঠে জাতীয় সংগীত

Thursday, March 27, 2014

বাংলাদেশের ৪৩তম স্বাধীনতাবার্ষিকীতে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে প্রায় তিন লাখ মানুষের সমবেত হয়ে সম্মিলিত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের ঘটনাটি নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। নিছক আনুষ্ঠানিকতা নয়, এতে দেশবাসীর আবেগময় অনুভূতিরও প্রকাশ ঘটেছে। ছাত্র-তরুণ-শ্রমিকসহ সর্বস্তরের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমাবেশস্থলটি হয়ে উঠেছিল নান্দনিক সৌন্দর্যের প্রতীক।
সবার হাতে ছিল বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা আর মুখে সেই জাতীয় সংগীতের অমর সুরলহরি। তাই মহতী এই আয়োজনের উদ্যোক্তা, বিশেষ করে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং সশস্ত্র বাহিনী বিভাগকে আমরা অভিনন্দন জানাই। সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গাওয়ার এই ঘটনা জাতি হিসেবে আমাদের অবস্থানকে আরও অনেক উঁচুতে নিয়ে গেছে। এর মাধ্যমে লাখো প্রাণের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের প্রতি দেশবাসীর গভীর আবেগ ও ভালোবাসার প্রকাশ ঘটেছে। মূর্ত হয়ে উঠেছে আবহমান বাঙালি সংস্কৃতি তথা জাতীয় সংগীতের প্রতি আমাদের গাঢ় শ্রদ্ধাবোধ। উল্লেখ্য, কেবল জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডেই নয়, দেশের সর্বত্র, যে যেখানে ছিলেন, সেখান থেকেই জাতীয় সংগীত গেয়ে তাঁরা নিজের দেশের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতির সবচেয়ে শক্তিশালী উপাদান যে সংগীত, তার প্রমাণ আমরা পাই ইতিহাসের পরতে পরতে।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে ক্ষুদিরামেরা গান গাইতে গাইতে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলেছেন। ষাটের দশকে পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রসংগীতের প্রচারণা নিষিদ্ধ করলে রাজপথে গান গেয়েই এ দেশের শিল্পী, কবিসহ সব শ্রেণী-পেশার মানুষ সেই অন্যায় আদেশ রুখে দিয়েছেন।
স্বাধীনতা দিবসে সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে আমাদের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে যে মেলবন্ধন তৈরি হলো, তাকে আরও এগিয়ে নিতে হবে প্রতিদিনের চিন্তা-কর্মে ও দেশপ্রেমের অবিচল প্রত্যয়ে। আনুষ্ঠানিকতার বৃত্ত থেকে বের হয়ে এই কালজয়ী সংগীতের মর্মবাণীকে ছড়িয়ে দিতে হবে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে। দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি যে আমাদের গভীর ভালোবাসা আছে, প্রতিটি দিবসে ও ক্ষণে আমরা তা নিজেরা যেমন তার বাস্তবায়ন করতে সচেষ্ট থাকব, তেমনি অন্যদেরও করব উজ্জীবিত। এই গানে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশকে মায়ের সঙ্গে তুলনা করে তার অঘ্রানের ভরা খেত দেখে যেমন মুখে হাসি ফোটানোর কথা বলেছেন, তেমনি তার বদনখানি মলিন হলে নয়ন জলে ভাসার বেদনাও প্রকাশ করেছেন।
জাতীয় সংগীতের মর্মবাণী হূদয়ে ধারণ করে মা-রূপ দেশের মুখে যেন সর্বদা হাসি ফুটে থাকে, যেন কখনো তার মুখ মলিন না হয়, সেই লক্ষ্যেই আমাদের সবাইকে কাজ করতে হবে। দেশের স্বার্থকে দল ও মতের ঊর্ধ্বে রাখতে হবে। বিভেদ ও বৈরিতার বদলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন সুদৃঢ় করতে হবে, সমাজে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যা ছিল একাত্তরের প্রত্যয়।

নির্বাচন কমিশনকে জবাবদিহি করতে হবে- পুরোনো নির্বাচনী সংস্কৃতি

যেমন আশঙ্কা করা হয়েছিল, তেমনটিই হয়েছে উপজেলা নির্বাচনের চতুর্থ দফায়। প্রথম দফা নির্বাচনের তুলনায় সংঘাত-সহিংসতা, কারচুপির অভিযোগ ও ভোটকেন্দ্র দখল—সবই ধারাবাহিকভাবে বেড়ে চলেছে পরবর্তী প্রতি দফায়। চতুর্থ দফায় তো তা রীতিমতো ‘কেন্দ্র দখলের’ নির্বাচনে পরিণত হয়েছে। অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের যে ধারা বাংলাদেশে সূচনা হয়েছিল, তা সম্ভবত এবারের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আরও মুমূর্ষু হয়ে পড়ল।

চতুর্থ দফার নির্বাচনে ভোট হয়েছে ৯১টি উপজেলায়। এর মধ্যে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ৪০টি উপজেলায়। মারা গেছেন চারজন। সিল মেরে ভোটের বাক্স ভরা, নির্বাচনী সরঞ্জাম ছিনতাই ও আগুন দেওয়া, এজেন্টদের বের করে দেওয়া, ভোটকেন্দ্র দখল—যে বিষয়গুলো আমাদের নির্বাচনী সংস্কৃতি থেকে বিদায় নিয়েছে বলে আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছিলাম, তার সবকিছুরই পুনরাবির্ভাব ঘটল চতুর্থ দফা নির্বাচনে। এবারের উপজেলা নির্বাচনের এটাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি (?)! এর কৃতিত্ব (?) নির্বাচন কমিশনকে দিতেই হচ্ছে!
কোনো ধরনের নির্বাচনী সহিংসতা, প্রাণহানি, ভোটকেন্দ্র দখল বা কারচুপির অভিযোগ ছাড়াই অসংখ্য নির্বাচনের অভিজ্ঞতা দেশে রয়েছে। গত নির্বাচন কমিশন এর সূচনা করে নির্বাচনী সংস্কৃতিতে এই মৌলিক পরিবর্তনটি আনতে সক্ষম হয়েছিল। বর্তমান নির্বাচন কমিশনও শুরুতে তা বজায় রাখতে পেরেছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, ২০০৬ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এ ধরনের নির্বাচন সম্ভব হলে বর্তমানে তা সম্ভব হচ্ছে না কেন? এই সময়কালে নির্দলীয় বা তত্ত্বাবধায়ক ধরনের সরকার যেমন ক্ষমতায় ছিল, তেমনি দলীয় সরকারও ক্ষমতায় ছিল। এখন পরিস্থিতি পাল্টাল কেন?
বাংলাদেশে নির্বাচনে পুরোনো সংস্কৃতি ফিরে আসার দায় প্রথমত নির্বাচন কমিশনের। প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা আগের চেয়ে শান্তিপূর্ণ ভোট হয়েছে বলে দাবি করেছেন। তাঁর এই দাবির সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই। ভোট যদি শান্তিপূর্ণই হবে প্রাণঘাতী সংঘর্ষ ও ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটল কেন? এ রকম ‘শান্তিপূর্ণ’ ভোট কারোরই কাম্য নয়। নির্বাচনের সময় প্রশাসন নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী চলতে বাধ্য। তারা যদি প্রশাসনকে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের কাজে ব্যবহার করতে না পারে, সেটা তাদেরই ব্যর্থতা।
এটা ঠিক যে এবারের উপজেলা নির্বাচনে সরকারি দল ও তাদের সমর্থকদের শক্তি প্রয়োগের বিষয়টি ক্রমাগত স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কিন্তু আমরা মনে করি যে একটি স্বাধীন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশন দৃঢ় অবস্থান নিতে পারলে সরকার বা সরকারি দল বড় বাধা হয়ে উঠতে পারে না। নির্বাচনে কেন সহিংসতা ও কারচুপি ফিরে আসছে, কেন আগাম আশঙ্কা সত্ত্বেও এসব ঠেকানো যাচ্ছে না, তার ব্যাখ্যা নির্বাচন কমিশনকে দিতে হবে। যদি সরকারের অসহযোগিতার কারণে তা হয়ে থাকে, তবে সেটাও নির্বাচন কমিশনকে স্পষ্ট করে বলতে হবে। এটা না করতে পারলে ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন’ বর্তমানে যে মুমূর্ষু দশার মধ্যে রয়েছে, সেটিকে আর বাঁচানো যাবে না।

ভারত- হায়দরাবাদ থেকে তেলেঙ্গানা by আলী ইমাম মজুমদার

Saturday, March 1, 2014

প্রতিবেশী ভারতে শাসনকাজ সুচারুভাবে পরিচালনার জন্য মাঝেমধ্যে বিভিন্ন রাজ্য ভাঙাগড়া হয়। এ ধরনের ভাঙাগড়ায় বিপরীতমুখী স্বার্থের সংঘাত থাকে বলে ব্যাপারটি কিন্তু সহজ নয়।
অতীতের ভাঙাগড়াগুলোও সহজে হয়নি। ক্ষেত্রবিশেষে ঘটেছে সংঘাত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জনপ্রতিনিধিদের সুবিবেচনাপ্রসূত মতামতের ভিত্তিতে নিষ্পত্তি হয়েছে। ঠিক তেমনি দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্য অন্ধ্র প্রদেশকে ভেঙে তেলেঙ্গানা নামের একটি রাজ্য গড়ার জোর দাবি ছিল দীর্ঘদিনের। এটা নিয়ে দফায় দফায় আন্দোলন হয়েছে। প্রাণহানিও ঘটেছে বেশ কিছু মানুষের। ১৯৬৯ আর ১৯৭২-এ আন্দোলনের তীব্রতা ছিল প্রকট। কিন্তু তখন আলোর মুখ দেখেনি দাবিটি। তা দেখল ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ভারতের ২৯তম রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রায় সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়েছে তেলেঙ্গানার। সম্প্রতি লোকসভা ও রাজ্যসভায়ও জনপ্রতিনিধিরা যখন এটা নিষ্পত্তি করেন, তখনো কিন্তু বিষয়টি সহজসাধ্য ছিল না। তবে প্রধান দুটো দল একমত হওয়ায় অন্যদের আপত্তি ধোপে টেকেনি।

ফেডারেল সরকারব্যবস্থায় এ ধরনের রাজ্য বিভক্তির পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি থাকে। উভয় পক্ষ প্রায় ক্ষেত্রে অনড় অবস্থান নেয়। তা সত্ত্বেও জনগণের বৃহত্তর কল্যাণ বিবেচনায় রেখে একপর্যায়ে একটা সমাধান করতে হয়। আর এটাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য। আবার এ ধরনের দাবি একটি মেনে নিলে সমধর্মী দাবিও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আর কেন্দ্রীয় সরকার ও সংশ্লিষ্ট রাজ্যও এ ধরনের দাবির পক্ষে ঢালাওভাবে অবস্থান নিতে পারে না। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর পর্যালোচনার পরই একেকটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তবু নিজ নিজ অবস্থানে থেকে অনেকে আন্দোলন চালায়। ভারতে গত বিজেপি সরকারের সময়ে তিনটি নতুন রাজ্য গঠিত হয়েছিল। সেগুলো হচ্ছে উত্তর প্রদেশ, ওডিশা আর বিহার ভেঙে যথাক্রমে উত্তরাঞ্চল, ছত্তিশগড় আর ঝাড়খন্ড। এখনো জোর দাবি চলছে মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ, আসামের বোড়োল্যান্ড আর পশ্চিমবঙ্গের গুর্খাল্যান্ডসহ আরও কিছু অঞ্চলে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারকে একটি রাজ্য গঠনের সময়ে তার ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিকসহ সব দিক বিবেচনা করতে হয়। পার হতে হয় জটিল সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।
কতগুলো দিক বিবেচনায় তেলেঙ্গানাকে প্রকৃত অর্থে সম্পূর্ণ নতুন একটি রাজ্য বলা যাবে না। এ অঞ্চল মূলত ব্রিটিশ-ভারতে হায়দরাবাদ রাজ্যের অংশবিশেষ। ১৯৪৮ সালে এর ভারতভুক্তি হয়। এর আগে ইংরেজ শাসকেরা রাজ্যটির বেড়ার নামক একটি অংশ মধ্যপ্রদেশের সঙ্গে জুড়ে দেয়। ভারতভুক্তির পরও মারাঠাভাষীর কিছু অংশ মহারাষ্ট্র আর কানাড়াভাষী কিছু অংশ কর্ণাটকের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। তেলেগুভাষী অংশটিকে ১৯৫৬ সালের রাজ্য পুনর্গঠন প্রক্রিয়াকালে অন্ধ্র প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। সেই হায়দরাবাদ নগরই হয় অন্ধ্র প্রদেশের রাজধানী।
ভাষার সাযুজ্য থাকলেও এর একটি ঐতিহাসিক পৃথক সত্তা ছিল। ১৭২৪ সাল থেকে পৃথক দেশীয় রাজ্য হিসেবে এর শাসনভার ছিল নিজাম পরিবারের হাতে। সীমানার কিছু পরিবর্তন হলেও ব্রিটিশরা এ সত্তা বহাল রাখে। ব্রিটিশ-ভারতের ৫৫৬টি দেশীয় রাজ্যের মধ্যে এটি ছিল সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে সমৃদ্ধ। মূল হায়দরাবাদ রাজ্যের আয়তন ছিল দুই লাখ ১৫ হাজার বর্গকিলোমিটার। কেটে নিয়ে অন্ধ্রের সঙ্গে যেটুকু দেওয়া হয়েছে, তার আয়তন এক লাখ ১৫ হাজার বর্গকিলোমিটার। আর বর্তমান লোকসংখ্যা সাড়ে তিন কোটি। অবিভক্ত অন্ধ্র প্রদেশের আয়তন দুই লাখ ৭০ হাজার বর্গকিলোমিটার। আর লোকসংখ্যা সাড়ে আট কোটি। এর সরকারি ভাষা তেলেগু ও উর্দু। সুজলা-সুফলা এ রাজ্যকে ভারতের খাদ্যভান্ডার বলা হয়। চাল ছাড়াও চিনিসহ অন্যান্য কৃষিপণ্য ও মৎস্য উৎপাদনে অগ্রণী এ অন্ধ্র প্রদেশ।
পাশাপাশি শিল্পায়নেও অনেক অগ্রসর। মাথাপিছু গড় আয়ের দিক দিয়ে ভারতে দ্বিতীয়। অন্ধ্রের রাজধানী হায়দরাবাদের আয়তন ৬৫০ বর্গকিলোমিটার। আর জনসংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ। ভারতের চতুর্থ জনবহুল শহর। এ নগর রাজ্যের জিডিপি আর কর প্রদানে শীর্ষে রয়েছে। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া তথ্যানুসারে ভারতের নগরওয়ারি বিবেচনায় হায়দরাবাদ ব্যাংক আমানতে ষষ্ঠ আর ঋণ প্রদানে চতুর্থ স্থানে রয়েছে। এখানে রয়েছে প্রায় এক হাজার ৩০০টি উঁচু মানের আইটি ফার্ম। এর মধ্যে মাইক্রোসফটসহ বেশ কিছু নামজাদা বহুজাতিক কোম্পানিও আছে। অর্থাৎ ব্যাপক বিনিয়োগ হয়েছে এ নগরে। বিশ্বব্যাংকের গবেষণা অনুসারে, এটি ভারতের দ্বিতীয় ব্যবসাবান্ধব শহর। এর অর্থ ব্যাপক বিনিয়োগ, কর্মসংস্থানের পাশাপাশি এখানে সুশাসনও স্বাভাবিক মাত্রায় রয়েছে। আগামী ১০ বছর নগরটি উভয় রাজ্যের যৌথ রাজধানী থাকবে বটে। এরপর চলে যাবে তেলেঙ্গানার ভাগে।
হায়দরাবাদ তেলেঙ্গানার রাজধানী হিসেবে পাবে। তবে উল্লেখ করা যথার্থ যে তেলেঙ্গানা নামক অঞ্চলটি অন্ধ্র প্রদেশের অন্য অঞ্চল থেকে বেশ কিছুটা পিছিয়ে আছে। তাদের অভিযোগ রয়েছে সুষম উন্নয়ন না হওয়ার। যেকোনো কারণেই হোক এ অভিযোগের বাস্তবতা লক্ষণীয় হয়। যেমন গোটা অন্ধ্র প্রদেশের শাসনব্যবস্থায় তেলেঙ্গানাবাসীর সংখ্যা শতকরা ২০ জন। আর শীর্ষস্তরে এর অনুপাত শতকরা পাঁচজন। সুতরাং সূচনায় রাজ্য পরিচালনা করতে গিয়ে তারা কিছু হোঁচট খাবে। তবে রাজনৈতিক দূরদর্শিতাসম্পন্ন নেতৃত্ব থাকলে নতুনভাবে গঠনের পর্যায়ে অঞ্চলনির্বিশেষে সবার সহযোগিতা নিতে নতুন সরকার সচেষ্ট থাকবে। নিজামের শাসনকাল থেকেই এ রাজ্যের অবকাঠামো উন্নত ছিল। ব্রিটিশের সাধারণ নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এর নিজস্ব সেনাবাহিনী, বিমান পরিবহন, টেলিযোগাযোগ, রেলওয়ে, ডাক যোগাযোগব্যবস্থা, মুদ্রা ও বেতার সম্প্রচারব্যবস্থা ছিল। অর্থনীতিও পেছনে ছিল না। এখন মাঝখানে যেটুকু পিছিয়েছে, তা থেকে বিদ্যমান অবস্থায় দ্রুত উত্তরণ সম্ভব।
নতুন রাজ্য হিসেবে তেলেঙ্গানার এ অভ্যুদয়কে ভারতের রাজনৈতিক এমনকি সিভিল সমাজ নিরঙ্কুশভাবে স্বাগত জানাচ্ছে না। এখানে একটা তীব্র দ্বিধাবিভক্তি লক্ষণীয়। একটি অংশ এ ধরনের পুনর্গঠনের পক্ষে থাকলেও অপর অংশটি সক্রিয়ভাবে বিরুদ্ধে। যারা পক্ষে তারা বলছে একটি ভূখণ্ড তার পূর্ব সত্তা ফিরে পেলে নিজদের ভাগ্য পরিবর্তনের সুযোগ পাবে। সমৃদ্ধির গতি আরও বাড়বে। পশ্চাৎপদ অঞ্চলগুলো নজরে আসবে। ক্রমান্বয়ে অবসান ঘটবে তাদের পশ্চাৎপদতার। অপর অংশটির মতে, এ সিদ্ধান্ত ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন ভাষাভাষী ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়াবে। একের পর এক নতুন রাজ্য গঠনের দাবি আসতে থাকবে। তাঁরা আরও বলছেন, এ প্রবণতা ভারতকে ক্রমান্বয়ে ‘বলকানাইজেশন’-এর পথে নিতে পারে। এ ধরনের মতামত পোষণকারীদের মধ্যে কুলদীপ নায়ারের মতো প্রথিতযশা সাংবাদিকও রয়েছেন। উল্লেখ্য, ‘বলকানাইজেশন’ একটি ভূরাজনৈতিক শব্দ। একটি দেশ বা অঞ্চল পরস্পরের প্রতি বৈরীভাবাপন্ন ছোট ছোট অঞ্চলে বিভক্ত হওয়াকে ‘বলকানাইজেশন’ বলে অভিহিত করা হয়। এ শব্দটি মূলত ১৮১৭ থেকে ১৯১২ সময়কালে অটোমান সাম্রাজ্যের বলকান উপদ্বীপের অঙ্গরাজ্যগুলো বিভিন্ন রাজ্যের বিভক্তি থেকে নেওয়া হয়। ভারতের ক্ষেত্রে এ যুক্তি গ্রহণযোগ্য বলে অনেকে মনে করেন না। তাঁদের বিবেচনায় এখানে ফেডারেল সরকারব্যবস্থা থাকলেও শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার, সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল, সুসংগঠিত সামরিক বাহিনী ও দক্ষ আমলাতন্ত্র রয়েছে। ব্যাপকভাবে না হলেও এ ধরনের দু-একটি ক্ষেত্রে নতুন রাজ্য গঠনকে প্রয়োজনীয় বিকেন্দ্রীকরণ বলে ইতিবাচক রূপে চিহ্নিত করছেন তাঁরা।
কেবল কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা কোনো দেশের জন্য সুফল আনে না। শুরু থেকেই ভারত এ সত্য উপলব্ধি করে শক্তিশালী কেন্দ্রের অধীনেই কার্যকর রাজ্য প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করেছে। আর সময়ের প্রয়োজনে এসব রাজ্য নিয়ে কিছু ভাঙাগড়া চলতেই পারে। অন্ধ্র প্রদেশ ভাঙা নিয়ে দাবি দীর্ঘদিনের। কয়েক যুগ পর দাবিটি পূরণ হতে চলছে। কতিপয় ক্ষেত্রে সাময়িক অসুবিধা হলেও শেষাবধি তা কেটে যাবে বলে ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয়। অন্য রাজ্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। আর একে নজির রেখে নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠার দাবিও আসতে পারে। আসলেই সথেষ্ট যৌক্তিকতা না থাকলেও তা দেওয়া হবে এরূপ মনে করার কোনো কারণ নেই। সব আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণিত করে ভারতের ২৯তম রাজ্য তেলেঙ্গানা সুষম উন্নয়ন ও সংহতির পথে এগিয়ে যাবে—এটিই প্রত্যাশা।

আলী ইমাম মজুমদার
: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

সরল গরল- ছয় থেকে আট সপ্তাহের স্বাধীনতা by মিজানুর রহমান খান

২৫ ফেব্রুয়ারির দুপুর। সুপ্রিম কোর্টের অ্যানেক্স ভবনের ১৬ নম্বর বিচারকক্ষের লাগোয়া বারান্দায় উপচে পড়া ভিড়। তাঁরা এসেছেন দূরদূরান্ত থেকে।
এক জায়গায় দেখলাম, পুরো একটি পরিবার বসে আছেন। জমি নিয়ে মারামারি। ঠাকুরগাঁও থেকে আগাম জামিন নিতে এসেছেন। প্রশ্ন হলো, তাঁরা গ্রাম থেকে কেন রাজধানীতে ছুটে এসেছেন? অধিকাংশ জামিনাদেশে লেখা আছে, ছয় থেকে আট সপ্তাহ পরে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নিতে হবে এবং তখন জামিন দেওয়ার ক্ষেত্রে আদালত স্বাধীন থাকবেন।
তার মানে সুপ্রিম কোর্ট স্বীকার করছেন এবং সুপ্রিম কোর্টের বাঘা বাঘা আইনজীবী, যাঁরা মুহূর্তে মক্কেলদের আগাম জামিনাদেশ পাইয়ে দিতে সক্ষম হচ্ছেন, তাঁরাও স্বীকার করবেন, এখানে শুভংকরের ফাঁকি আছে। এক-এগারোর পর লাখ টাকা এমনকি কোটি টাকা ফিয়ের জামিনের গল্পও বাতাসে ভেসেছে। অত টাকা তো সাধারণ মানুষের নেই। গ্রামের মানুষেরা কি ঠকছেন? কতটা? আইনজীবীরা তাঁদের ত্রাতা?
সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ হাসান আরিফের সঙ্গে কথা হলো। তাঁকে মিনিটে জামিনের সমর্থক আঁচ করি। বলি, সরকারে নেই তাই! বললেন, না আমি অ্যাটর্নি জেনারেল থাকতেও কখনো জামিনের বিরোধিতা করিনি। তবে কেন মানুষ হাইকোর্টে আসছেন, সেটা অনুসন্ধানযোগ্য বলে মনে করেন তিনি। মওদুদ আহমদ মিনিটে জামিনের বিষয়ে মন্তব্য করতে নারাজ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আদালতের স্বাধীনতা দেখেন। বললেন, বঙ্গবন্ধুর আমলে আদালতের ওপর চাপ ছিল না। রক্ষীবাহিনীর কর্মকাণ্ডকে বেআইনি ঘোষণা করে বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্যের দেওয়া মাইলফলক রায় স্মরণ করলেন। জামিনপ্রার্থীদের ভিড় প্রশ্নে, বিশেষ করে নিম্ন আদালতের ওপর সরকারের প্রচণ্ড চাপের ওপরই জোর দিলেন তিনি।
সরকার নিয়ন্ত্রণ করে তাই নিম্ন আদালতে মানুষ যদি জামিন নিতে না-ই যান, তাহলে সেই একই আদালত কী কারণে ছয় থেকে আট সপ্তাহ সময়ের পর স্বাধীনভাবে জামিন দিতে পারবেন? আট সপ্তাহের ব্যবধানে অভিযুক্তকে আবার নতুন করে ছোট আদালতের আইনজীবী ধরতে হবে। জামিনের দরখাস্ত করতে হবে। তাহলে লাভটা কী? এটাই ফাঁকি।
আমরা জানলাম, বড় আদালতের ছোঁয়াই কাফি। হাইকোর্ট যেহেতু জামিন দিয়েছেন, তাই নিম্ন আদালত ভরসা করতে পারেন। তাহলে কিন্তু আমজনতা বুঝবেন, ওটা আইনের শাসন নয়, মৃতসঞ্জীবনী সালসা। নিম্ন আদালতের বিচারকের বুকের ছাতি ফোলানোর বটিকা।
সুতরাং আইনবিদ ও আইনজীবীরা একে আগাম জামিন বলবেন। কিন্তু আমি বলব না। আসলে হাইকোর্টের অব্যাহত গণজামিন প্রমাণ করছে যে, বিচার বিভাগ পৃথক্করণ মুখ থুবড়ে পড়েছে। নিম্ন আদালত সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের মুঠোবন্দী থাকতেও জামিনের এমন হিড়িক দেখা যায়নি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৯ সালে দুই দিনে এক হাজার ২০০ জামিন নিয়ে মন্তব্য করে আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। তাঁর সেই উক্তি অসতর্ক ছিল মানি। কিন্তু ১৫ বছরের ব্যবধানে সেই রায়টি পড়ে মনে হলো, বড় মুখ নিয়ে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগ সেদিন যেভাবে শেখ হাসিনার প্রতি উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন, সেই বড় মুখ আজ অবশিষ্ট নেই। ওই রায়টি সুপ্রিম কোর্টের দ্বারা পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম।
১৯৯৮ সালের ২৫ ও ২৬ আগস্ট দুই দিনে ১৫৫টি জামিন দিয়েছিলেন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ। শেখ হাসিনা তা ভুল করে এক হাজার ২০০ বলেছিলেন। সেদিন সংখ্যাগত ভ্রান্তিকেই বড় করে দেখা হয়েছিল, আদালত নিজেদের ওজস্বিতায় সংবেদনশীল ছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনার বক্তব্যের চেতনা আজও প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছিলেন, ‘ওই ঘটনা প্রধান বিচারপতিকে জানালে কেবল বেঞ্চ পরিবর্তন করেন, অন্য ব্যবস্থা নেননি, ব্যবস্থা নিলে জুডিশিয়ারি অনেক দায়দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেত এবং জুডিশিয়ারি সম্পর্কে মানুষের মনে কোনো সন্দেহ দেখা দিত না।’ আজও প্রাসঙ্গিক বলছি এ কারণে যে, ‘ওই ধরনের ঘটনা’ অব্যাহত আছে বরং আরও গুরুতরভাবে চলছে। শেখ হাসিনা ১৯৯৯ সালে প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে বলেছিলেন, যদি তদন্ত করা হতো, ব্যবস্থা নেওয়া হতো, তবে জুডিশিয়ারি অনেক দায়দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেত। ২০০৯ সালে তদন্ত হলো। ব্যবস্থা নেওয়া হলো না। জনমনের সন্দেহ ঘুচল না।
মিনিটে একটি আগাম জামিন প্রশ্নে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বললেন, ‘আমি গভীরভাবে হতাশ। কয়েকটি বেঞ্চে আইন কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালনে অনাগ্রহী। কারণ, তাঁরা রাষ্ট্রপক্ষে কথা বলার সুযোগ পান না।’
২০০৯ সালে যখন দুজন বিচারক ৩৮ সেকেন্ডে একটি আগাম জামিন দিলেন, তখনো কেবল সংশ্লিষ্ট বিচারকদের এখতিয়ার রহিত করা হয়েছিল। অ্যাটর্নি জেনারেল নিশ্চিত জানালেন, জামিনাদেশের অনিয়ম খতিয়ে দেখতে সুপ্রিম কোর্টের গঠিত তদন্ত প্রতিবেদন হারিয়ে গেছে।
তাই বলছিলাম, শেখ হাসিনার ‘অতিরঞ্জিত’ উক্তি অপ্রাসঙ্গিক হয়নি। অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে আগের সরকারকে দায়ী করার বিষয়টি। ২০০৯ সালে ওই তদন্ত কমিটি দেখেছিল, এক দিনে কার্যতালিকায় এক হাজার ১৪২টি মামলা আদেশের জন্য ছাপা হয়েছিল। ১৩টি কার্যদিবসে এক হাজার ৩৭২টি আগাম জামিন এবং ৬৮৯টি অন্যান্য আদেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে ওই বেঞ্চ এক দিনে সর্বোচ্চ ২৪৮টি আগাম জামিন দেন। আর এখন এক দিনে ৩০৭টি আগাম জামিনের আদেশ মিলেছে। তাহলে এটিও তদন্তের দাবি রাখে।
১৯৯৯ সালে আপিল বিভাগ বেশ গর্বের সঙ্গে যুক্তি দিয়েছিলেন যে, ‘হাইকোর্ট ব্যবস্থা সম্পর্কে যাঁদের জ্ঞান আছে, তাঁরাই জানেন দুই দিনে একটি বেঞ্চের এক হাজার ২০০ জামিন দেওয়া অবাস্তব। বিচারকেরা যদি ওই হারে মামলা নিষ্পত্তি করতেন, তাহলে তো মামলা জটই থাকত না।’ কিন্তু ১৯৯৯ সালে যা তাদের কথায় ‘ফিজিক্যালি ইম্পসিবল’ ছিল। তা ‘ফিজিক্যালি পসিবল’ হচ্ছে। তাই প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে বিবৃতি দাবি করি। কারণ, আপিল বিভাগ বলেছিলেন, সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে আগাম জামিন সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর অসন্তোষ ব্যক্ত করার অধিকার আছে। আমরা মনে করি, এই অধিকার প্রয়োগের এখন উত্তম সময়। কারণ, একাধিক বেঞ্চে ‘বাছবিচারহীন আগাম জামিন’ চলছে।
আগাম জামিন নিয়ে আমাদের উচ্চ আদালতের দুটি টেস্টামেন্ট আছে। ওল্ড টেস্টামেন্ট লেখা হয়েছিল ১৯৯৯ সালের ২৫ মে। আগাম জামিন নিয়ে শেখ হাসিনাকে ভর্ৎসনা করার ৮১ দিন পর। তখন প্রধান বিচারপতি এ টি এম আফজাল লিখেছিলেন, ‘আগাম জামিন দেবেন হাইকোর্ট। জেলা জজ ও দায়রা আদালত নন।’ রাষ্ট্র ঠিক উল্টো বলেছিল। সে কারণেও কি আগাম জামিন পেতে আজ জনস্রোত আছড়ে পড়ছে উচ্চ আদালতে? আপিল বিভাগ যদি রাষ্ট্রের সঙ্গে একমত হতেন, তাহলে শেখ হাসিনাকে তিরস্কার করে দেওয়া মার্চের রায় টেকে না। কারণ, শেখ হাসিনার উল্লিখিত হাইকোর্ট যে ৩৬৭ জন অভিযুক্তকে আগাম জামিন দিয়েছিলেন, তাঁরাও নিম্ন আদালত এড়িয়েছিলেন।
ওল্ড টেস্টামেন্টের সবই ভালো। এটুকু ছাড়া। আইন কিন্তু বলছে, আগাম জামিন ছোট-বড় উভয় কোর্ট দিতে পারেন।
মাহমুদুল ইসলাম ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, ‘আগাম জামিন নিতে সরাসরি হাইকোর্টে আসা যাবে না। আগে জেলা ও দায়রা জজের কাছে যেতে হবে।’ অবশ্য এটাও শতভাগ গ্রহণযোগ্য নয়। তবে ওল্ড টেস্টামেন্টের একটা সংশোধনী লাগবে। কারণ, এতে নিম্ন আদালতকে খাটো করা আছে। বলা হয়েছে, আগাম জামিন দিতে তারা সাহস পাবেন না।
তবে ওল্ড টেস্টামেন্ট কিন্তু বাছবিচারহীন জামিনদানকে জুডিশিয়াল এক্সট্রাভ্যাগাঞ্জ বলেছিলেন। বাংলা একাডেমির অভিধানমতে এটা অসংযত বিচারিক আচরণ। হাইকোর্ট নিম্ন আদালতকে নিজের শরীরের অংশ ভাবেনই না। আবার হাইকোর্টের স্বাধীনতাও যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ। নিম্ন আদালতে সরকারের হস্তক্ষেপ বিবেচনায় মিনিটে মিনিটে জামিনদান এবং ৫৬১(ক) ধারার আওতায় নিম্ন আদালতের বিচার-প্রক্রিয়া বাছবিচারহীনভাবে স্থগিত করে দেওয়ার অনুশীলনকে আমরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা জ্ঞান করতে পারব না। নিম্ন আদালত, তুমি কার শরীরের অংশ—সরকারের, না সুপ্রিম কোর্টের? জামিন ও স্থগিতাদেশ (স্টে) প্রদানের চেতনা যে তেলে (সংবিধানগত) দাউ দাউ করে জ্বলে, সেই তেলে নিম্ন আদালতকে নির্বাহী বিভাগের রাহুমুক্ত করার সাংবিধানিক, আইনগত, সংবিধিবদ্ধ ও এমনকি আপিল বিভাগের রায়গত কর্তব্যবোধ টিম টিম করেও জ্বলে না।
একশ্রেণীর বেঞ্চ অফিসার দুর্নীতিগ্রস্ত। অ্যাটর্নি জেনারেল আমাকে আদালত প্রশাসনে ‘রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি’র কথা বলেছিলেন। তদুপরি অবাক হলাম। ২৭ ফেব্রুয়ারি একটি বিচারকক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এক তরুণ আইনজীবী এক জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর সঙ্গে কথায় কথায় ২০ হাজার টাকার একটি বান্ডেল বের করলেন। ঈষৎ মলিন নোটগুলো ৫০০ টাকার। এই অর্থ খরচ করে আগাম জামিনের দুটি আবেদন তিনি কার্যতালিকায় ছাপাতে চান।
জামিনপ্রতি আইনজীবীরা মাথাপিছু ১০ হাজার টাকা ফি নিলে সাড়ে ৫০০ আবেদনে এক হাজার লোক জামিন পেলে তাঁদের কেবল ফি খরচা দাঁড়ায় এক কোটি টাকা। এক হাজার মানুষের অনধিক আট সপ্তাহের স্বাধীনতার দাম এক কোটি টাকা। একে কি বলব না ঘোর অমাবস্যার ‘জামিনার্থনীতি’।
৬ জুন ২০১০ নিউ টেস্টামেন্ট লেখেন বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। আগে হাইকোর্ট নিম্ন আদালতকে জামিনবান্ধব নির্দেশনা দিতেন। এরপর সেটা বন্ধ হয়েছে। তবে উভয় টেস্টামেন্ট সংশোধনের দরকার আছে। নিউ টেস্টামেন্টে রুল দেওয়া বন্ধের নির্দেশনাটি গ্রহণযোগ্য নয়। বিধিবদ্ধ আইন করতে ওল্ড টেস্টামেন্টের নির্দেশনা আইন কমিশন এখনই বিবেচনায় নিতে পারে। বাছবিচারহীন আগাম জামিনের বিরুদ্ধে উভয় টেস্টামেন্টে অবশ্য কঠোর হুঁশিয়ারি আছে। হাইকোর্টের তা না মানা সংবিধান লঙ্ঘন। ২০০৯ সালের তদন্তের আলোকে ব্যবস্থা চাই। না পারলে অন্তত প্রতিবেদনের প্রকাশনা চাই। যেকোনো বাছবিচারহীন আগাম জামিনের তদন্তপূর্বক আশু প্রতিকার দাবি করি। (শেষ)


মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

মিসর- কে হবেন প্রেসিডেন্ট, সিসি না সাবাহি by কামাল গাবালা

Wednesday, February 26, 2014

মিসরীয়রা এখন পড়েছে নতুন দোলাচলে। বিশেষ করে ঝানু বামপন্থী হামদিন সাবাহি নিজেকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার পর। ২০১২ সালে যে নির্বাচনে মোহাম্মদ মুরসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাতে সাবাহি অধিকার করেছিলেন তৃতীয় স্থান।
সাবাহির এই ঘোষণা এল আরেক দফা প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রাক্কালে, যে নির্বাচনে সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আবদেল ফাতাহ আল-সিসির প্রার্থী হওয়ার জোর সম্ভাবনা রয়েছে।

গত বছরের জুন মাসে মিসরজুড়ে বিক্ষোভের মুখে ইসলামপন্থী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে উচ্ছেদ করে সিসি আরবের সবচেয়ে জনবহুল দেশে বিপুল জনপ্রিয় হন।
মিসরীয়রা এখন যার যার রাজনৈতিক পক্ষ, মতামত ও আদর্শিক অবস্থান থেকে তর্ক ও আলোচনা চালাচ্ছে। সেসব আলোচনা প্রকাশ্যে উঠেও আসছে। এরই একটা উদাহরণ হলো ন্যাশনাল সালভেশন ফ্রন্ট আর তামারোদ মুভমেন্টের এক সারিতে চলে আসা। প্রথমটি গঠিত হয়েছিল ২০১২ সালের শেষে মুরসি প্রশাসনের বিরোধিতা করার জন্য আর গত বছরজুড়ে বিক্ষোভ সংঘটিত করে যাচ্ছিল তামারোদ, যার পরিণতি হলো মুরসির অপসারণ। এমনকি তাদের নামকরণও বোঝায় যে একই উদ্দেশ্যে তারা গঠিত। এবং অবশ্যই তাদের সঙ্গে ছিল নাসেরপন্থীসহ বিভিন্ন বামপন্থী গোষ্ঠী। এই বামপন্থীদের থেকেই এসেছেন সাবাহি।
মিসরের এখন প্রতিটি বাড়িতেই কান পাতলে শোনা যাবে সিসি আর সাবাহিকে নিয়ে আলোচনা। সব পরিবারই যেন একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে: এই দুজনের কে হবেন মিসরের যোগ্যতম প্রেসিডেন্ট?
এ বছরের গোড়াতেই প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের তৈরি করা সংবিধান স্থগিত করে আধুনিক, নাগরিক ও গণতান্ত্রিক মিসরের লক্ষ্যে নতুন সংবিধান পাস হয়েছে। তা ছাড়া ইসলামপন্থী আমলের অভিজ্ঞতা ফিরে আসার যে ভয় সবকিছু আচ্ছন্ন করে ছিল, তা কাটিয়ে মিসরীয়রা এখন এমন একজন সেনানায়ক চায়, যিনি তাদের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষা করবেন। এই সেনানায়ক ‘ধর্মের’ লেবাসের আড়ালে ভেসে ওঠা পুনর্জীবিত সন্ত্রাসবাদকে মোকাবিলা করছেন। ২০১১ সালে হোসনি মোবারকের বিতাড়নের পর থেকে মিসরের অর্থনীতি যে নাটকীয় দুর্দশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তা থেকেও উঠে আসার লক্ষণমিলছে।
এখনকার মিসরে সাবাহি ও সিসির (যিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য উর্দি খুলে নামবেন বলে ভাবা হচ্ছে) মধ্যে কে ভালো হবেন তা নিয়ে দোলাচলের সঙ্গে অতীতের দোলাচলের কোনো তুলনা চলে না। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতো করে সাবাহিও একে বর্ণনা করেছেন ‘ভালো’ আর ‘উত্তমের’ মধ্যকার লড়াই বলে। গত বছরের ২৫ জানুয়ারির গণ-অভ্যুত্থান এবং তার সংশোধনে আসা ৩০ জুনের ঘটনার সমর্থক বিপ্লবীদের দৃষ্টিতে ব্যাপারটা এ রকমই। আজকের পরিস্থিতি ২০১২ সালের থেকে এখানেই আলাদা যে তখন মিসরীয়দের বেছে নিতে হচ্ছিল মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রার্থী মোহাম্মদ মুরসি বনাম মোবারকের শাসনের প্রতিনিধি আহমেদ শফিকের মধ্যে। সে রকম অবস্থায় পরিস্থিতিটা ছিল ‘খারাপ’ আর ‘নিকৃষ্টের’ মধ্যকার প্রতিযোগিতার মতো। অথবা ব্যাপারটা ছিল যেন কলেরায় মরব নাকি প্লেগে মরব; তা বাছাই করে নেওয়ার প্রশ্ন।
মিসরে চলমান বিতর্কের বিষয় দুই প্রার্থীর মধ্যকার মিল ও ভিন্নতা নিয়ে। দুজনই জনপ্রিয় হওয়ায় বেছে নেওয়াও কঠিন হয়ে গেছে ভোটারদের পক্ষে। এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে সাবাহি বিনয়ের সঙ্গে বলেছেন যে আমি সব মিসরীয় ও সিসিকে বলছি, তিনি একজন উত্তম প্রার্থী, তবে আমিও ‘উত্তম’ প্রার্থী হতে পারি।
প্রখ্যাত মিসরীয় রাজনীতিবিদ মোহামেদ সালমাওয়ি এককথায় এভাবে বলেছেন, সাবাহি ও সিসি এই অর্থে মিসরীয়দের চোখে সম্পর্কিত যে উভয়ই তাঁদের মনে করিয়ে দিচ্ছে সাবেক জাতীয়তাবাদী প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসেরের কথা। সিসি যেভাবে জনগণের ইচ্ছাকে তুলে ধরেছেন, যেভাবে তিনি আন্তর্জাতিক শক্তি ও ইসলামপন্থী গোষ্ঠীর বিপরীতে জনগণের স্বার্থকে গ্রহণ করেছেন, তাতে অনেক মিসরীয়র মনেই তাঁকে নাসেরের প্রতীক বলে মনে হয়।
অন্যদিকে সাবাহি হলেন নাসেরের সরাসরি অনুসারীদের মধ্যে প্রধানতম নাসেরপন্থী নেতা। বাল্যকাল থেকেই তিনি নাসেরপন্থার সঙ্গে যুক্ত এবং তাঁরই প্রতিনিধি হিসেবে চিত্রিত হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে নাসেরপন্থী হিসেবে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১২ সালের নির্বাচনেও তিনি নাসেরপন্থী হিসেবেই তৃতীয় স্থান অর্জন করেন, যেমন এখন তিনি সংসদে নাসেরের ধারারই নেতার ভূমিকা পালন করছেন।
সালমাওয়ি আরও বলেন যে ২০১৪ সালের নির্বাচনী দৌড়ে সিসি আর সাবাহিই হবেন প্রধান প্রতিযোগী। এর অর্থ হলো, যে নাসের তাঁর পরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার আল সাদাতের আমলে ব্যাপকভাবে আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন, সেই নাসেরের প্রত্যাবর্তন ঘটছে। এখন তাহরির স্কয়ারে নাসেরের পোস্টারের পাশে শোভা পাচ্ছে সিসির পোস্টার। আর তারা স্লোগান দিচ্ছে, ‘মুক্তি, ইনসাফ ও মানবতার সম্মান’-এর জন্য।
সাবাহি বলেছেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমার বিশ্বাস, সিসি একজন দেশপ্রেমিক ব্যক্তি এবং আমি তাঁর জন্য শুভকামনা ছাড়া অন্য কিছু বোধ করি না। কারণ, তিনি এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁকে নিরাপদ রাখার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো বর্তমানের মতোই তাঁর প্রতিরক্ষামন্ত্রীর অবস্থানে থেকে যাওয়া।’
সাবাহি যুক্তি দেন, চারপাশে ঘিরে থাকা লোকজনের চাপে যদি সিসি প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে নির্বাচন
কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে শেষ হবে। এই বামপন্থী রাজনীতিবিদ মনে করেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে সিসির নির্বাচিত হওয়া তেমন অবধারিত নয়, যদিও গণমাধ্যম ও অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক তেমনটাই ভাবেন।
এরই মধ্যে প্রখ্যাত মিসরীয় সাংবাদিক মোহামেদ হাসানাইয়েন হেকেল নিজের অতীতের উক্তি সংশোধন করে বলেন যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে মিসরের দরকার অলৌকিক ঘটনা। এর আগে তিনি বলেছিলেন যে সিসিই ন্যায্য প্রার্থী। তিনি আরও বলেন, সিসি যদিও অনেক জনপ্রিয়তা উপভোগ করেন, তাহলেও অন্যান্য প্রার্থীও নিজেদের মনোনীত করতে সক্ষম হবেন। আর এটা ঘটতে হবে সত্যিকার নির্বাচনী প্রক্রিয়ায়।
হেকেল বলেন, সাবাহির মনোনীত হওয়া খুবই ন্যায়সংগত। কারণ, তাঁর রাজনৈতিক মেধা রয়েছে এবং ছাত্র আন্দোলনের কর্মী হওয়া থেকে শুরু করে পরের দিকে তিনি নিজেকে জাতীয় রাজনীতির জন্য যোগ্য হিসেবে বিকশিত করেছেন। তিনি আরও বলেন, সাবাহির তেমন আকাঙ্ক্ষা রয়েছে, রয়েছে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও জনপ্রিয় সমর্থন। এই সমর্থন দিচ্ছে তরুণ উৎসাহী জনতা। এ কথা বলে
তিনি ইঙ্গিত করেন ২০১২ সালের নির্বাচনের কথা, যেখানে সাবাহি পেয়েছিলেন ৫০ লাখ ভোট। ওই নির্বাচনে সাবাহির সাফল্য বিস্ময়কর ছিল। কারণ, অন্য প্রার্থীরা বিপুল অর্থ ও যোগাযোগ বিনিয়োগ করে তাঁর জন্য পরিস্থিতি কঠিন করে তুলেছিলেন।
সিসির প্রেসিডেন্ট হওয়ার আকাঙ্ক্ষার পথে হুমকি হলো মোবারকের স্বৈরাচারী শাসনের সমর্থকদের পুনরাবির্ভাব। এরা যদি সিসিকে সমর্থন দেয়, তাহলে মিসরের ভেতরে ও বাইরে তাঁর প্রতিপক্ষ সুবিধা পাবে। আর তাহলে গত বছরের ৩০ জুন মিসরীয় সেনাবাহিনী মুরসিকে উচ্ছেদ করে যে বাহবা কুড়িয়েছিল, তাতে চিড় ধরবে।

কামাল গাবালা: মিসরের আলআহরাম পত্রিকাগোষ্ঠীর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক।

পিলখানা ট্র্যাজেডি- আর হারাতে চাই না! by মো. ইমামুল হক

Tuesday, February 25, 2014

বাংলাদেশের ইতিহাস কখনোই ২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় ঘটে যাওয়া বিডিআর বিদ্রোহ নামের সেই ভয়াবহ ঘটনাটির কথাটি ভুলতে পারবে না, যেখানে দেশমাতৃকার সেবায় অর্পিত দায়িত্ব পালনকালে প্রাণ দিতে হয়েছিল ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জনকে।

একটি ঘটনায় মাত্র ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে এত অধিকসংখ্যক উচ্চ প্রশিক্ষিত মেধাবী সেনা কর্মকর্তার হত্যার ঘটনা সাম্প্রতিক ইতিহাসে আর একটিও নেই। আইন তার নিজের গতিতেই চলেছে। আদালত অভিযুক্ত ৮০০ জনের মধ্যে ১৫০ জনকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন। যদিও এই বিচার অনেক শহীদ পরিবারকেই সন্তুষ্ট করতে পারেনি বলেই প্রতীয়মান হয়। কারণ, সেই বীভৎস ঘটনার প্রকৃত কারণ
এখনো উদ্ঘাটিত হয়নি। তবু এই বিচার হয়তো বা কিছু শহীদ পরিবারের সদস্যদের মনের কিঞ্চিৎ সান্ত্বনা হিসেবে কাজ করবে।
এর পরও যাঁরা একসঙ্গে এত বিশালসংখ্যক দক্ষ ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার হত্যার বিষয়টি কোনোভাবেই মন থেকে মেনে নিতে পারেন না, তাঁদের সবার কাছে সব সময় একটা বড় প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, কেন এই ঘটনা ঘটল? তাঁরা নেপথ্যের কারণগুলো জানতে চান। আদালতের রায় ঘোষণার পরও সেই সব প্রশ্ন থেমে থাকেনি। এই বিদ্রোহের অনেক কিছুই দেশবাসীর কাছে অজানা। জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই এর প্রকৃত কারণ এবং নেপথ্য ব্যক্তিদের সত্যের আলোয় আনতে হবে। আমাদের আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে, একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে সামাজিক নৈতিকতার প্রতি আমাদের বাধ্যবাধকতাও আছে। আমরা যদি আইনের শাসন ও সামাজিক নৈতিকতা থেকে দূরে থাকি, তার মানে হবে আমরা আমাদের মাতৃভূমির নিরাপত্তাকেই বিপন্ন করছি।
এত বড় একটি বিদ্রোহ কি কেবল বিডিআরের কয়েকজন ডিএডি সমমানের কর্মকর্তার পরিকল্পনা হতে পারে? তাঁরা কি বাইরের কোনো শক্তি দ্বারা প্রভাবিত হননি? সরকারকে এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে এবং সেগুলোকে গ্রহণযোগ্য উপায়ে সাধারণ মানুষের কাছে উপস্থাপন করতে হবে।
চলে যাওয়ার সময় আমাদের শহীদ ভাইয়েরা আমাদের বিহ্বল মানসিক অবস্থা প্রত্যক্ষ করে গেছেন। সময়মতো তাঁদের জন্য প্রয়োজনীয় কাজটুকু আমরা করতে পারিনি। জীবদ্দশায় নানা উপলক্ষে দেশে-বিদেশে তাঁরা আমাদের দেশকে গর্বিত করে গেছেন, তাঁরা তাঁদের বিক্রম দেখিয়েছেন, মানুষের জীবন বাঁচিয়েছেন, সহকর্মীদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের প্রয়োজনের সময় আমরা তাঁদের জন্য কিছুই করতে পারলাম না। কেন এই দুঃখজনক ঘটনাগুলো ঘটল, কেন আমরা সময়মতো তাঁদের পাশে দাঁড়াতে পারলাম না, সেগুলো আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। ভুল থেকে, দুঃখজনক সেই ঘটনা থেকে আমরা কী শিক্ষাটাই নিতে পেরেছি, সেটাও আমাদের ভেবে দেখতে হবে।
এসব বীর শহীদের অনেক বন্ধু, সহকর্মী এবং পরিবারের সদস্যরা শোক আর ক্ষোভকে সঙ্গে নিয়েই সামনে এগিয়ে যেতে চান। এ রকম একটি উদ্যোগই গ্রহণ করেছে কর্নেল মুজিব ট্রাস্ট, যার মূল উদ্দেশ্য হলো কর্নেল মুজিবসহ সব শহীদ ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা। ২০০৯ সালে ভয়ানক সেই ঘটনার পরপরই ঘটনার অন্যতম শহীদ কর্নেল মুজিবুল হকের নামে শহীদ কর্নেল মুজিব ট্রাস্ট গঠিত হয়।
কর্নেল মুজিব ট্রাস্টের পক্ষ থেকে প্রতিবছর ২৫ ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবরে আমরা যে শান্তিপূর্ণ মোমবাতি প্রজ্বালন কর্মসূচির আয়োজন করি, তা আমাদের দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করতে, জাতিকে গৌরবোজ্জ্বল করতে ওই শহীদদের জীবন উৎসর্গের প্রতীকী রূপকে উপস্থাপন করে। একটি মোমবাতি নিজেকে পুড়িয়ে আমাদের আলো দেয়, একইভাবে শহীদ ভাইয়েরা আমাদের আলোকিত করার জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। ওই সব স্বর্গীয় আত্মার স্বপ্ন ছিল সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশের, যেখানে আমরা সবাই মিলেমিশে শান্তিতে বসবাস করব।
আমাদের মহান দায়িত্ব আজ তাঁদের সেই স্বপ্ন পূরণে কাজ করা। তাঁদের পরিকল্পনা ও স্বপ্ন পূরণ এবং মূল্যবোধ ধারণে আমাদের অবশ্যই অঙ্গীকার করতে হবে। সেই সঙ্গে তাঁদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, বীরত্ব এবং দায়িত্ববোধ আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায় আমাদের। ২৫ ফেব্রুয়ারি শহীদ সেনা দিবস পালনের মধ্য দিয়ে কর্নেল মুজিব ট্রাস্ট আমাদের শহীদ ভাইদের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে প্রয়োজনীয় কাজটি করতে চায়।
জাতি হিসেবে আমরা এই সত্যকে অস্বীকার করতে পারি না যে আমরা শুধু এই মূল্যবান জীবনগুলোকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছি তা নয়, বরং দেশের জন্য এই বীরদের মূল্যবান অবদানকে যথাযথ স্বীকৃতি দিতে পারিনি। যে প্রতিষ্ঠানের পক্ষে তাঁরা আত্মত্যাগ করলেন, সেই প্রতিষ্ঠানটিও যেন আজ দ্বিধান্বিত, নয়তো কেন আজও ২৫ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে ‘শহীদ সেনা দিবস’ হিসেবে পালিত হয় না। এই জাতির ইতিহাস আত্মত্যাগের ইতিহাস। এ জাতি জানে কীভাবে শহীদদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হয়। আজ শহীদ সেনা দিবসের পঞ্চম বার্ষিকী পালন কালে আসুন আমরা যথোপযুক্ত সম্মান ও শ্রদ্ধার সঙ্গে আমাদের বীরদের স্মরণ করি।


মো. ইমামুল হক: জাতিসংঘের একজন সাবেক কর্মকর্তা ও শহীদ কর্নেল মুজিবুল হকের ভাই
Emamul.haque@gmail.com

সহজিয়া কড়চা- অঙ্গীকার জরুরি—উচ্ছ্বাস নয় by সৈয়দ আবুল মকসুদ

‘মোদের গরব মোদের আশা—আ-মরি বাংলা ভাষা’ পঙিক্তটি যখন মধ্যযুগের কবি লিখেছিলেন, তখন তিনি ঠিকই লিখেছিলেন। বাংলা ভাষা তখন ছিল বাঙালির গর্বের ধন এবং তার আশা-ভারসার স্থল।
এই পঙিক্ত লেখার বহু বছর পরে বাংলার কবি—বাংলা ভাষার কবি নোবেল পুরস্কার পান। বাংলা ভাষা বিশ্বসাহিত্যে স্থান পায়। তারও ৫৮ বছর পরে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ তাদের একটি স্বশাসিত ভূখণ্ড পায়। সুতরাং বাংলা ভাষা বাঙালির গর্বের ভাষা এবং তার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আশা-ভরসার স্থল—তাতে সন্দেহ কী?

সাড়ে আট বছর সংগ্রামের পর ১৯৫৬ সালে বাংলা পাকিস্তানের অন্যতর রাষ্ট্রভাষা বা সরকারি ভাষা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেলে বাংলা ভাষার প্রশ্নে একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। একাত্তরে পাকিস্তানকে বিদায় জানানোর পর নিজেদের রাষ্ট্রে বাংলাই সর্বেসর্বা: বাংলার আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী রইল না। কোনো প্রতিপক্ষ রইল না। সুতরাং ভাষা নিয়ে আর লড়াই করার মতো কিছু থাকল না। তবে একেবারে কিছুই থাকল না, তাও নয়। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটির ঘটনাবলি নিয়ে স্মৃতিচারণা শুরু হলো। এই স্মৃতিরোমন্থন চলবে বহুকাল বংশানুক্রমে: পুত্র বা কন্যা বলবেন তাঁদের পিতার ভূমিকা সম্পর্কে, তারপর নাতি-নাতনিরা দাদা-নানার অবদান তুলে ধরবেন মিডিয়ায় ফেব্রুয়ারি এলেই। একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে ফুলের মধ্যে পলাশ ও শিমুলের কী সম্পর্ক তা বোধগম্য নয়, কিন্তু এই ফুলের দুটি প্রজাতি বাংলার মাটি থেকে বিলুপ্ত হওয়ার উপক্রম হলেও ফেব্রুয়ারি এলেই এগুলোর উল্লেখ অনিবার্য হয়ে পড়ছে। সম্ভবত ওগুলো রক্তের মতো লাল বলে।
যেখানে কোনো ত্যাগ স্বীকারের প্রয়োজন হয় না, শুধু কথা দিয়েই কিস্তিমাত করা সম্ভব, সেখানে বাঙালি তুলনাহীন এবং মালকোঁচা মেরে নেমে পড়ে। যেখানে প্রয়োজন কঠোর পরিশ্রম, অসামান্য ত্যাগ, বিপুল উদ্যম এবং নিরেট যুক্তিবাদিতা— সেখানে বাঙালি অতি দুর্বল। সে রকম কোনো বিরাট ও মহৎ আয়োজনে তাকে ধরে-বেঁধেও আনা সম্ভব নয়।
কোনো রকম ভাষা আন্দোলন ছাড়াই, মিটিং-মিছিল ছাড়াই পৃথিবীর বহু দেশে সেখানকার প্রধান ভাষা জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে স্থান করে নিয়েছে। সরকারের একটি অগণতান্ত্রিক ও অন্যায় সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে একদিন রাজপথে নেমে জীবন দিলেন রফিকউদ্দিন আহমদ, আবুল বরকত, আবদুস সালাম, আবদুল জব্বার, শফিউর রহমান, অহিউল্লাহ, আবদুল আওয়াল এবং এক নাম না-জানা কিশোর। একজন বাংলাভাষী মানুষও যত দিন এ দেশে থাকবে, তত দিন তাদের স্মৃতি থাকবে অম্লান। একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখটি নয়—রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের শহীদেরাই অমর। তাঁদের মৃত্যু নেই।
পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যেখানে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দেশপ্রেম প্রকাশের ধরনও বদলায়। প্রতি পাঁচ-দশ বছর পর পর আমাদের দেশপ্রেমের পারদও ওঠানামা করে। এক সরকারের সময় যদি শহীদ দিবসে ঘরে শুয়ে টানা ঘুম দিই বা শালীকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় যাই, তো আরেক সরকারের সময় ভোর না হতেই সেজেগুজে শহীদ মিনারে রওনা দিই। বাঙালির কোনো কিছুর বেগ একবার শুরু হলে তা রোধ করতে পারে না। তা ছাড়া দেশাত্মবোধের হুজুগে অংশগ্রহণ না করা দেশদ্রোহের শামিল।
কোনটা উৎসব আর কোনটা শোক পালন—তা যদি আমরা পার্থক্য করতে না পারি, তার চেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় আর হতে পারে না। আমরা বাংলা নববর্ষ বা ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস যে আমেজে উদ্যাপন করব, সেই রকম ধুমধাম করে আনন্দ প্রকাশ একুশের শহীদ দিবসে করতে পারি না। উদ্যাপন করা আর পালন করা এক কথা নয়। ১৯৫৩ থেকে ’৭১ পর্যন্ত শহীদ দিবস পালনের অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে, বিশেষ করে আশির দশক থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি পালনে নতুন নতুনতর মাত্রা যোগ হচ্ছে। উৎসবমুখর পরিবেশে পালন নয়, উদ্যাপিত হচ্ছে একুশে ফেব্রুয়ারি।
কেউ ছোট বাচ্চা কাঁধে নিয়ে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে রাস্তায় বেরিয়েছেন। ছোট বাচ্চা ও সুন্দরী যুবতীদের গালে অ আ ক খ লিখে ভাষার প্রতি প্রবল প্রেম প্রকাশ পৃথিবীর সবার কাছে প্রশংসাযোগ্য মনে হলেও আমার কাছে অসমর্থনযোগ্য। চ্যানেলগুলোতে সরাসরি দেখেছি এবং সংবাদপত্রেও ছবিতে দেখা যাচ্ছে, মেয়েদের মাথায় ফুলের মালা জড়ানো অথবা ফুলের মুকুট—গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে মেয়েরা যেমন যায়। টিভির সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কেউ খুব জোর দিয়ে বলছেন, বাংলা আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা না? বাংলা ভাষাকে আমরা ভালোবাসি, একুশ আমাদের মায়ের ভাষাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে। এর অর্থ দাঁড়ায় একুশের রক্তপাত না হলে আমরা বাংলাকে ভালোবাসতাম না। ধারণা করি, আলাওল, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জসীমউদ্দীন, তাঁদের মায়ের ভাষাকে খুব বেশি ভালোবাসেননি। কারণ, তাঁরা কোনো উপলক্ষ থেকে নিজের ভাষাকে ভালোবাসার শিক্ষা পাননি।
চর্যাপদের সময় থেকে বাংলা ভাষায় লেখালেখি হচ্ছে। বাংলা পৃথিবীর ১০-১১টি শ্রেষ্ঠ ভাষার একটি। বিপুল ও সমৃদ্ধ তার সাহিত্যসম্পদ। অগণিত সৃষ্টিশীল ও মননশীল প্রতিভা জন্ম দিয়েছে এই ভাষা। অতীতে কোনো শাসক আমাদের বাংলা বর্ণমালাকে মুছে দেওয়ার স্পর্ধা দেখাননি। দু-একজন নির্বোধ ও নষ্ট মানুষ আরবি বা রোমান হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব করে ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন মাত্র। বাংলা ভাষা বিলুপ্তির ষড়যন্ত্র কেউই করেনি, কিন্তু আজ আমরা বাংলা বর্ণ নিয়েই হাহাকার করছি। ব্যানারগুলো ‘দুঃখিনী বর্ণমালা’ নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করছে ফেব্রুয়ারিজুড়ে। এই বর্ণমালা যে সত্যি সত্যি দুঃখিনী, তাতেই বা সন্দেহ কী? এক সমীক্ষা করতে গিয়ে গতবার ফেব্রুয়ারিতে বইমেলায় ৪২ জন লেখককে জিজ্ঞেস করেছিলাম বাংলা স্বরবর্ণ কয়টি এবং ব্যঞ্জনবর্ণের সংখ্যা কত। সঠিক উত্তর কেউ দেননি, মাথা চুলকিয়েছেন অথবা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিলেন।
একুশে ফেব্রুয়ারিতে তোবড়ানো গালে নয়, আপেলের মতো গালে যতই বাংলা হরফ আঁকা হোক, বাংলা ভাষা আজ অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি শত্রুকবলিত। গাড়িতে বসে যখন রেডিওতে একটি নিউ সং প্লে হতে দেখি এবং সাম ইয়ং ফ্রেন্ডদের রিকোয়েস্টে যখন একটি ভাটিয়ালি সং ওয়ান উইকের মধ্যে সেকেন্ড টাইম রিপিট করতে দেখি, তখন তো বলতে ইচ্ছাই হয়: হায় বাংলা ভাষা! স্বাধীনতার পর থেকে বাংলা ভাষা ব্যবহারে যে অরাজকতা চলছে, স্বাধীনতার আগের ইসলামীকরণের গোত্রবিশেষের অপচেষ্টা তার কাছে কিছুই নয়।
জাতি রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের সৌভাগ্য যে দেশের ৯৯ শতাংশ মানুষ বাংলায় কথা বলে। বাংলা ছাড়া অন্যান্য ভাষা যাদের মাতৃভাষা, তারাও বাংলা বলতে পারে। অথচ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশই বহু ভাষাভাষী, সেখানে প্রধান ভাষা একাধিক। সেসব দেশে ভাষানীতি আছে। সেসব দেশে কোনো ভাষা আন্দোলন হয়নি, ভাষা সংস্কার নিয়ে কাজ হয়েছে। সর্বস্তরে জাতীয় ভাষা বা সরকারি ভাষা প্রয়োগে অবিচল আনুগত্য দেখায় জনগণ। খেয়াল-খুশির কোনো জায়গা নেই, তা সরকার বরদাশতও করে না। ভাষার অবমাননা বা বিকৃতি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
বহু ভাষাভাষী থাইল্যান্ডে ভাষা আন্দোলনের প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু সে দেশে থাই ভাষা জীবনের সর্বক্ষেত্রে ব্যবহূত। মালয়েশিয়ায় রাষ্ট্রভাষা নিয়ে রক্তপাত ঘটেনি। সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা মালয় ভাষাই সরকারি ভাষা। কঠোর তার প্রয়োগ। ৩৩ শতাংশ চৈনিক ভাষাভাষী মানুষ তাতে আপত্তি করেনি। যদিও চীনা ভাষাও প্রচলিত। তামিল, হিন্দিও চলে। ইন্দোনেশিয়া হাজারো দ্বীপের দেশ। জনগণ কথা বলে এক হাজার ১০০ ভাষায়। অনেক পরিবারে দু-তিনটি ভাষা প্রচলিত। সেখানে ভাষা ইন্দোনেশীয় বা মালয় সরকারি ভাষা। জাভানিজ ও অন্যান্য ভাষাও বহুল প্রচলিত, কিন্তু সংঘর্ষ নেই। মালয়েশীয় মালয় ও ইন্দোনেশীয় মালয় ভাষায় সমতা আনতে দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। চুক্তিটি হলো: দুই দেশের মালয় ভাষার শব্দের বানান হবে এক, অর্থ হবে এক, উচ্চারণ হবে এক। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় শিক্ষার মাধ্যম সরকারি ভাষা মালয়, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিও চালু আছে। ওসব দেশে ভাষার প্রশ্নে কিছুমাত্র উচ্ছ্বাস নেই। একটুখানি দেশ সিঙ্গাপুর। সেখানে চৈনিক, মালয়, তামিল ও ইংরেজি— চারটিই সরকারি ভাষা। কেউ নিজেরটাই শ্রেষ্ঠ বলে হুংকার দেয় না, কেউ কারও মাথা ফাটায় না।
যেসব দেশের জনসংখ্যা খুব কম সেসবেও তাদের সরকারি ভাষা জীবনের সব ক্ষেত্রে নিষ্ঠার সঙ্গে প্রয়োগ না করে উপায় নেই। যেমন ডেনমার্কে ডেনিশ, নরওয়েতে নরওয়েজিয়ান, সুইডেনে সুইডিশ ও ফিনিশ, ফিনল্যান্ডে ফিনিশ। ফিনল্যান্ডে মাত্র সাড়ে ৬ শতাংশ মানুষ সুইডিশ ভাষাভাষী। কিন্তু সাংবিধানিকভাবে সেটাও স্বীকৃত সরকারি ভাষা। তুরস্কে তুর্কি সরকারি ভাষা, কিন্তু কুর্দিশও চলে। প্রতিটি জাতীয়তাবাদী দেশেই সরকারি ভাষা রাষ্ট্রীয় কাজে ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে কঠোরভাবে প্রয়োগের বিধান রয়েছে।
শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলার দাবি বহুদিনের; পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই। ষাটের দশকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ইংরেজির সঙ্গে বাংলাও অনুমোদিত হয়। উঁচু শ্রেণীতে বাংলা বইয়ের অভাব। সে অভাব অনুবাদের মাধ্যমে দূর করা খুব সহজ। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সে উদ্যোগ নিতে পারত। নিয়েছে কি?
ভাষাকে মর্যাদা দেওয়ার ব্যাপারে চেতনাটাই আসল, উচ্ছ্বাস নয়। ভারতে সরকারি ভাষা হিন্দি হলেও, অতি বড় দেশ বলে ইংরেজির সেখানে প্রাধান্য থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু প্রতিটি রাজ্যের মানুষ দৈনন্দিন জীবনে নিজেদের ভাষা ব্যবহার করছে—হিন্দি নয়। তামিলনাড়ুতে তামিল, গুজরাটে গুজরাটি, কেরালায় মালয়ালম, অন্ধ্র প্রদেশে তেলেগু ও উর্দু, কর্ণাটকে কানাড়া, মহারাষ্ট্রে মারাঠি, পাঞ্জাবে পাঞ্জাবি, রাজস্থানে রাজস্থানি ভাষা যেভাবে ব্যবহূত, পশ্চিমবঙ্গে বাংলা সেভাবে নয় এবং বাংলাদেশেও বাংলার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলেও আন্তরিকতার সঙ্গে ব্যবহূত হয় না।
ভাষা নিয়ে একবার হয়েছে রক্তপাত, এখন হচ্ছে মামলা-মোকদ্দমা। ভাষাদূষণে উচ্চ আদালতের নির্দেশে কমিশনও গঠিত হয়েছে। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। কিন্তু দেশের ৫০টির বেশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যই পড়ানো হয় না। এ জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কি কোনো দায়িত্ব নেই? আমাদের এনজিওগুলো দেশের মারাত্মক উন্নয়ন চায়। তাদের প্রায় সব গবেষণাপত্রই ইংরেজিতে রচিত হয়। কারণ, ওগুলোর পাঠক দাতারা— দেশের মানুষ নয়।
বক্তৃতাবাজি, স্মৃতিচারণা ও অতীতের বীরদের হরবছর সংবর্ধনা দিয়ে জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন সম্ভব হবে না। জাতিকে গড়ে তুলতে হয়। সে জন্য সরকারি আনুকূল্যের প্রয়োজন রয়েছে, যেমন দিয়েছিলেন হোসেনশাহি রাজত্বে আলাউদ্দিন হুসেন শাহরা। কিন্তু সবচেয়ে বেশি দরকার শিক্ষিত শ্রেণীর ভাষার অনাচার রোধে ও উন্নতি সাধনে সুদৃঢ় অঙ্গীকার।

সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

দূরদেশ- ইউক্রেনে ইতিহাসের প্রত্যাবর্তন? by আলী রীয়াজ

ইউক্রেনের গণ-আন্দোলন ও সহিংসতা এবং তাকে কেন্দ্র করে রাশিয়া ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে যে টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয়েছে, তা কি ইতিহাসের প্রত্যাবর্তন?
নাকি তা বৃহৎ শক্তিশালী দেশের ক্ষুদ্র প্রতিবেশীর অনিবার্য পরিণতি? ইউক্রেন কি প্রক্সি লড়াইয়ের রণক্ষেত্র, যার একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন আর অন্যদিকে রাশিয়া? নাকি গণতন্ত্রায়ণের অসম্পূর্ণতার কারণে ভঙ্গুর গণতন্ত্রের কর্তৃত্ববাদী শাসনে রূপান্তরের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের উদাহরণ? ইউক্রেনের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এটিই কি দেশটির ভবিতব্য ছিল? রাজধানী কিয়েভে নভেম্বর থেকে সরকারবিরোধীদের অব্যাহত বিক্ষোভের ফলে অবশেষে প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচ রাজধানী থেকে পালিয়েছেন, পার্লামেন্ট তাঁকে পদচ্যুত করে স্পিকার আলেকসান্দর তুর্চিনোভকে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেছে, আগামী ২৫ মে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে এবং কারাগারে আটক সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইউলিয়া তিমোশেনকো মুক্তিলাভ করেছেন।

গত নভেম্বরে বিক্ষোভের সূচনা হয়েছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি থেকে সরে আসার ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচের সিদ্ধান্তের কারণে, কিন্তু তা পরে আর সেখানে স্থির হয়ে থাকেনি। কেননা, বিক্ষোভের সেটা ছিল উপলক্ষমাত্র। এই আন্দোলন ক্রমেই রূপান্তরিত হয়েছে ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণের বিরুদ্ধে। তা পরিণত হয়েছে সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতার কাঠামো বদলের দাবিতে এবং শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা থেকে অপসারণের সফল লড়াইয়ে। এ সবই অভ্যন্তরীণ ঘটনাপ্রবাহ কিন্তু ইউক্রেনের এই ঘটনাপ্রবাহে গোড়া থেকেই যুক্ত হয়েছে বাইরের শক্তি ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচ যে ইউরোপের সঙ্গে আলোচনা ভেঙে দিয়ে রাশিয়ার দিকে ঝুঁকেছেন, মস্কোতে গিয়ে চুক্তি করেছেন, তাতেই বোঝা যায় যে বাইরের শক্তি এই ঘটনাপ্রবাহের বাইরে নেই, আগেও ছিল না। এ প্রসঙ্গে আরেকটু পরে আসি। তার আগে এখনকার অবস্থা ইতিহাসের প্রত্যাবর্তন কি না, সেই প্রশ্নের একটা উত্তর খোঁজা দরকার।
১৯৯১ সালে ইউক্রেন স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু দেশটির মধ্যে ইতিহাসের একটা বড় দাগ থেকে গেছে। তা হলো দেশটির পূর্বাঞ্চল রুশভাষী এবং শিল্পোন্নত; অন্যদিকে পশ্চিমে আছে ক্রিমিয়া, তুলনামূলকভাবে অধিকতর জাতীয়তাবাদী। একসময় ক্রিমিয়া ছিল পোল্যান্ড ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরির অংশ। ১৯৩৯ সালে নাৎসি জার্মানির সঙ্গে অনাক্রমণ চুক্তির আওতায় স্তালিন ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অংশে পরিণত করেন। ক্রিমিয়ার জনগণের কোনো রকম ভূমিকা তাতে ছিল না। ক্রিমিয়ার স্থানীয় মানুষেরা ইউক্রেনে রুশভাষী কিংবা রাশিয়া-প্রভাবিত ক্ষমতাসীনদের মধ্যে স্তালিনের ছায়া দেখতে পান। কিন্তু রাশিয়া ১৯২১ সালের পর থেকে অভিবাসন-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রুশভাষীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ করে তুলতে পেরেছে। সাংবিধানিকভাবে ক্রিমিয়া স্বশাসিত রিপাবলিক, যা ইউক্রেনের অংশ। কিন্তু সেখানে রয়েছে রাশিয়ার নৌবাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি। ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অচলাবস্থার নিরসন না ঘটলে ক্রিমিয়া বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কা একেবারে কল্পনা নয়। অব্যাহত বিক্ষোভের মুখে রাজধানী কিয়েভ ত্যাগ করে প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচ দেশের পূর্বাঞ্চলেই আশ্রয় নিয়েছেন। ইতিহাসের এক প্রায় বিস্মৃত অধ্যায় নতুন করে সবার সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে কি না, সেটা যেমন একটা প্রশ্ন, তেমনি প্রশ্ন হলো ভবিষ্যতে সে পথেই ইউক্রেন এগোবে কি না।
আমরা যদি ইতিহাসের এই প্রত্যাবর্তন নিয়ে সন্দিহানও থাকি, এ নিয়ে আমাদের সন্দিহান হওয়ার অবকাশ নেই যে ইউক্রেনে আমরা এক অর্থে গত শতকের সত্তর বা আশির দশকের স্নায়ুযুদ্ধের অবস্থা দেখতে পাচ্ছি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যদিও বলেছেন যে এটা শীতল যুদ্ধের সময়কার দাবা খেলা নয়, যেখানে আমরা রাশিয়ার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি কিন্তু রাশিয়া এবং বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের গত কয়েক বছরের নীতি ও কৌশলের আলোকে এ কথা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে রাশিয়া সেভাবেই বিবেচনা করে। সে কারণে ইউক্রেনকে রাশিয়ার অনুকূলে রাখার জন্য পুতিন ইউক্রেনের ১৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণের দায় গ্রহণে পিছপা হননি। কম মূল্যে তেল সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে কাস্টমস ইউনিয়নে ইউক্রেনকে যোগ দিতে চাপ দেওয়ার কারণ আর কী থাকতে পারে?
দেশের ভৌগোলিক অবস্থানও একটা অন্যতম কারণ। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর সাবেক সোভিয়েত-প্রভাবিত দেশগুলো একে একে পশ্চিমের প্রভাবাধীন হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রভাবান্বিত দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার দেয়াল একার্থে ইউক্রেন। ফলে রাশিয়া চাইছে যে ইউক্রেন তার প্রভাবের মধ্যেই থাকুক। তার জন্য প্রয়োজনে রক্তপাতে তার দ্বিধা নেই, যে অর্থে পশ্চিমা দেশগুলো মনে করে যে এই দফায় রাশিয়াকে তারা আটকাতে না পারলে ভবিষ্যতে ইউক্রেনকে আর কখনোই রাশিয়ার প্রভাবমুক্ত করা যাবে না। এই ক্ষেত্রে দুই পক্ষই ২০০৮ সালে জর্জিয়ার অভিজ্ঞতাকে স্মরণে রেখেছে। তখন জর্জিয়া ন্যাটোর সদস্য হওয়ার চেষ্টা করলে রাশিয়ার সঙ্গে দক্ষিণ ওসেতিয়া ও আবখাজিয়া নিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এখন ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে আবারও এ ধরনের একটা সংকটের সূচনা হবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
এগুলো হচ্ছে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতি ও সামরিক কৌশলের হিসাব। কিন্তু দেশের ভেতরের পরিস্থিতি আমাদের আরও বেশি গভীরভাবে বিবেচনায় রাখতে হবে। এক বিবেচনায় এই সংকটের উৎস ২০০৪ সালেই। তখন সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ভিক্তর ইয়ানুকোভিচ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল নিজের অনুকূলে নেওয়ার চেষ্টা করেন; কিন্তু তখনকার প্রেসিডেন্ট লিওনিদ কুচমা বিক্ষোভকারীদের ওপরে বল প্রয়োগে অস্বীকার করেন। এতে করে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারে। কিন্তু সে সময় রাশিয়া যে নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছিল, তা অনেকেরই জানা। ওই নির্বাচনের আগে ভিক্তর ইউশচেনকোকে বিষ প্রয়োগে হত্যার চেষ্টার ঘটনাও ঘটে। কিন্তু বিজয়ী ইউশচেনকো ও তাঁর প্রধানমন্ত্রী ইউলিয়া তিমোশেনকো জড়িয়ে পড়েন ক্ষমতার বিবাদে। ২০০৭ সালে প্রেসিডেন্ট ও বিরোধী দলের নিয়ন্ত্রিত পার্লামেন্ট বিবাদে জড়িয়ে পড়লে প্রেসিডেন্ট পার্লামেন্ট ভেঙে দেন। ২০১০ সালের নির্বাচনে ভিক্তর ইয়ানুকোভিচ প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হলে ক্রমাগতভাবেই পার্লামেন্টের ক্ষমতা সংকুচিত করে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বাড়িয়ে চলেন। নিয়মিত নির্বাচন ও পার্লামেন্টে ক্ষমতার হাতবদল সত্ত্বেও ইউক্রেনের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি। তার কারণ ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি, ক্ষমতার লোভ ও ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ। ফলে ২০০৭ সালে দেখেছিলাম ইয়ানুকোভিচের সমর্থকদের বিক্ষোভ ও তাঁর ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন। এখন তাঁর বিরোধীরা ২০০৪ সালের মতো আবারও রাজপথের লড়াইয়ে সাফল্য লাভ করেছে।
কিন্তু এসবের মধ্যে যা ক্রমেই সুদূরপরাহত হয়েছে তা হলো প্রকৃত গণতন্ত্রায়ণ, স্বাধীন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব ও বিকাশ। ইউক্রেন একার্থে ব্যতিক্রম নয়। অনেক দেশেই গণতন্ত্রের বদলে একধরনের ‘সংকর শাসন’ বা হাইব্রিড রেজিম তৈরি হয়েছে। সেসব দেশের কর্তৃত্ববাদী শাসনে ফেরার আশঙ্কাই বেশি। সেটাই ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের শাসনে আমরা দেখতে পাই। ইউক্রেনের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এই ভঙ্গুর গণতন্ত্রের সমস্যা আরও জটিল আকার নিয়েছে। শক্তিশালী বড় দেশের ক্ষুদ্র প্রতিবেশী দেশে যখন গণতন্ত্র ভঙ্গুর হয় তখন শক্তিশালী বড় দেশের জন্য তা অবশ্যই অনুকূল অবস্থার সূচনা করে এবং সে তার সুবিধা নিতে মোটেই পিছপা হবে না। হওয়ার কথাও নয়। যদি কেউ এ কথা বলেন যে বড় দেশ চাইবে তার প্রতিবেশীর গণতন্ত্র দুর্বল হোক, তার সঙ্গে দ্বিমতের সুযোগ কম। আন্তর্জাতিকভাবে কর্তৃত্ববাদী শাসনের গ্রহণযোগ্যতা এখন কম বলে সে ধরনের শাসনের ভরসা হন অন্য কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা। রাশিয়া ও ইউক্রেনের সম্পর্ককে সেই বিবেচনার বাইরে রাখা যাবে না।
ফলে ইউক্রেনের বর্তমান রাজনীতি কেবল সে দেশের জন্যই নয়, কেবল আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির জন্যই নয়, গণতন্ত্রায়ণের বিষয়ে উৎসাহী সবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।

উপজেলা নির্বাচন- প্রথম ধাপ: একটি সমীক্ষা by এম সাখাওয়াত হোসেন

Monday, February 24, 2014

গত ১৯ ফেব্রুয়ারি চতুর্থ উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপের ৯৭টির মধ্যে ৯৬টির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তিনটি উপজেলায় বিএনপিসহ আওয়ামী লীগের তথাকথিত বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিভিন্ন কারণে ভোট গ্রহণের দুই ঘণ্টার মধ্যে কারচুপির অজুহাতে নির্বাচন বর্জন করা এবং কয়েকটি কেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ ছাড়া প্রথম ধাপের নির্বাচন মোটামুটি শান্তিপূর্ণ হয়েছে।
আলোচিত নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে ইতিমধ্যেই নানা তথ্য বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম ধাপের নির্বাচন ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় উপজেলা নির্বাচনে একই উপজেলার নির্বাচনী ফলাফলের সঙ্গে তুলনা করলে কয়েকটি বিষয় ধর্তব্যের মধ্যে পড়বে। প্রথমত, নানা ধরনের প্রতিকূলতা এবং পরবর্তী সময়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী দল বিএনপি এবং এর প্রধান সহযোগী দলের চমকপ্রদ উত্থান। দ্বিতীয়ত, মামলাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা, নেতাদের ব্যাপক গ্রেপ্তার, যুদ্ধাপরাধের দায়ে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়া এবং ব্যাপক নেতিবাচক প্রচার সত্ত্বেও জামায়াতে ইসলামীর আশ্চর্যজনক প্রাপ্তি। তৃতীয়ত, এযাবৎ বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম দল জাতীয় পার্টির তৃণমূল পর্যায়ে প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার উপক্রম। চতুর্থত, মহাজোটের অন্যান্য শরিক দলে জামানত হারানোর মতো পরিস্থিতি এবং আশাতীত ভোটার সমাগম না হওয়া।

প্রথম ধাপের ভোট এবং ফলাফলের পর এসব বিষয়ে কিছু বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে। তবে পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন করতে হলে ঘোষিত ৪৪৬টি উপজেলার ভোট গ্রহণের পর ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তথাপি প্রথম ধাপের নির্বাচনে যে গতিধারা দৃশ্যমান হয়েছে, তা শেষ পর্যন্ত বজায় থাকাটাই স্বাভাবিক। অন্যথায় নতুনভাবে বিশ্লেষণ হবে ব্যতিক্রম গতিধারা নিয়ে।
বিএনপি দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর থেকে তিন দশকের মধ্যে এমন সাংগঠনিক সংকটে পড়েনি। সাংগঠনিক সংকটই নয়, নেতাদের ব্যাপক ধরপাকড় ও মামলা ইত্যাদির কারণে কেন্দ্রে এবং তৃণমূল পর্যায়ে প্রায় নেতৃত্বশূন্য অবস্থায় রয়েছে। উপজেলা থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত বহু নেতা-কর্মী গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে আত্মগোপনে ছিলেন এবং রয়েছেন। তদুপরি ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায়, সূত্রমতে, তৃণমূল পর্যায়ে হতাশা রয়েছে বলে প্রচারিত। এমতাবস্থায় অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে ওই দলের উল্লেখযোগ্য হারে শীর্ষে এগিয়ে থাকার বহুবিধ কারণ রয়েছে। এর মূলে রয়েছে সরকারি দলের অব্যাহত জনসমর্থন হ্রাস। যদিও বিভিন্ন জরিপে এ ধরনের তথ্য ইতিপূর্বে প্রকাশিত হলেও ধারাবাহিকভাবে সরকারে অধিষ্ঠিত দল বা জোট এসব ফলাফল ধর্তব্যের মধ্য না নিয়ে একধরনের আত্মপ্রবঞ্চনায় লিপ্ত ছিল। মূল কারণ খতিয়ে না দেখে তাৎক্ষণিক প্রত্যাখ্যান জনমনে আস্থা ফেরাতে পারেনি। সরকারি দল বা জোট দেয়াললিখন পড়লেও তা বিশ্বাস না করার প্রবণতায় রত ছিল।
বিএনপির এগিয়ে থাকার আরেকটি কারণ, সিংহভাগ সময় অনবরত সরকারি দল এবং দলের সমর্থকদের তৎকালীন বিরোধী দলের বিরুদ্ধে কারণে-অকারণে নানা ধরনের অপ্রিয় বক্তব্য, ব্যক্তিগত আক্রমণ এবং অনেক ভিত্তিহীন অভিযোগ উত্থাপনে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে।
প্রথম ধাপের নির্বাচনে ভোটের যে প্রতিফলন ঘটেছে, তার বেশির ভাগ সরকারি জোটের নেতিবাচক ভোটের সংখ্যাই বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীদের বাক্সে জমা পড়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ৫ জানুয়ারির ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হওয়া এবং পরে সামগ্রিক নির্বাচন চিত্র, যেখানে প্রায় সাত কোটি ভোটার ভোট দিতে পারেননি, তার মর্মব্যথা। এ বিষয়টি হালকাভাবে দেখার উপায় নেই। ভোটারদের মনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করতে পারার যে হতাশা ছিল, তাও প্রতীয়মান হয়েছে প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনের মাধ্যমে। বিভিন্ন জরিপে তথ্য ছিল যে, এ দেশের সিংহভাগ ভোটার একটি নিরপেক্ষ ব্যবস্থায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পক্ষে ছিল।
প্রথম ধাপের নির্বাচনে চারটি দলের সমর্থকদের মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে, যদিও উভয় দল ঘোষিত তথাকথিত কিছু কিছু বিদ্রোহী প্রার্থীরও উপস্থিতি ছিল। চারটি দলের মধ্যে জাতীয় পার্টি না থাকার মতো, সরকারের শরিক আর কোনো দলের অস্তিত্বই ছিল না। অথচ বেশ কিছু দলের মন্ত্রীরা রয়েছেন এবং ছিলেন অতীত ও বর্তমান সরকারের মন্ত্রিসভায়। বড় দলের ছত্রচ্ছায়ায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হলেও তৃণমূল পর্যায়ে এসব দল মোটেও বিকশিত হতে পারেনি। লক্ষণীয় যে, এসব দলের বিচরণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বহু দশকের। প্রাক্-নির্বাচনী জোটবদ্ধ হওয়া এবং নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার কারণে এসব দল তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠিত হতে পারেনি বলে বিশ্বাস। বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য এমতাবস্থা কোনোভাবেই সহায়ক নয়।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো নীতিগতভাবে নির্দলীয় নির্বাচন হওয়ার কথা, তবে রাজনীতিবিবর্জিত নয়। হালে নির্বাচনগুলোকে অধিক রাজনৈতিকীকরণ করার ফলে দলের প্রত্যক্ষ মনোনয়ন প্রদান, মনোনয়নের বাইরের প্রার্থীদের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী আখ্যায়িত করার কারণে এসব নির্বাচন কার্যত দলীয় রূপ ধারণ করেছে। বিগত কয়েকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন থেকে এ ধরনের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব নির্বাচন উন্মুক্ত এবং স্থানীয় পর্যায়ের প্রার্থীকে ঘিরেই অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। ভোটারদের ধর্তব্যের মধ্যে স্থানীয় পর্যায়ের প্রার্থীর পরিচয় এবং স্থানীয় চাওয়া-পাওয়ার ওপর ভিত্তি করে প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে থাকেন। উপজেলা নির্বাচনের এই পর্যায়ে এমনটি থাকেনি। ভবিষ্যতেও এমনটি হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এ ধরনের অলিখিত ব্যবস্থার ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিক রয়েছে। এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট নেতিবাচক দিকই প্রতীয়মান হয়েছে। উপরিউক্ত বাস্তবতার আঙ্গিকে বিশ্লেষণে দেখা যায়, এবারের নির্বাচনে দলের প্রভাবের কারণে একদিকে যেমন স্থানীয়ভাবে বহু জনপ্রিয় দলীয় ব্যক্তিরা বিভিন্ন স্তরের পৃষ্ঠপোষকতা না পাওয়ার কারণে প্রার্থী হতে পারেননি, তেমনি দলের নির্দেশনাও অনেকেই ধর্তব্যের মধ্যে আনেননি। এ কারণেই স্থানীয় প্রভাবের চেয়ে জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক প্রভাবে নির্বাচন আচ্ছন্ন ছিল। তদুপরি ছিল ক্ষমতাসীনদের স্থানীয় পর্যায়ের নিজস্ব বলয় তৈরি করার অতি উৎসাহ। এসব কারণে বিএনপি বা জামায়াতে ইসলামীর চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। বাকি নির্বাচনগুলোতে হয়তো একই ধারা বজায় থাকবে।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, প্রথম ধাপের নির্বাচনে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও জামায়াতে ইসলামীর কল্পনাতীত সাফল্য। জামায়াত ১৩টি চেয়ারম্যান, ২৪টি পুরুষ এবং ১০টি মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের পদে বিজয়ী হতে সক্ষম হয়েছে। চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদগুলো যে শুধু জামায়াত প্রভাবিত অঞ্চলেই হয়েছে, তেমনটি নয়। এ সত্য ভাইস চেয়ারম্যান পদের বিশ্লেষণ করলেই দৃশ্যমান হবে। বিএনপি প্রভাবিত কয়েকটি উপজেলায় জামায়াতের প্রার্থী বিএনপির প্রার্থীদের পরাজিত করে জয়ী হয়েছেন। প্রসঙ্গত, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য থেকে পাওয়া যায়, ২০০৯ সালে বর্তমানের প্রথম ধাপের নির্বাচনের উপজেলাগুলোতে জামায়াত মাত্র ছয়টিতে চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছিল। এবার তার দ্বিগুণ স্থানে জয়ী হয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ, জামায়াত-সমর্থিত প্রার্থীদের নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে কোনো বিতর্ক ছিল না। ছিল না কোনো ধরনের সাধারণ অথবা আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ। অনেকে মনে করেন, জামায়াতের প্রার্থীরা গ্রামাঞ্চলের সাধারণ ভোটারদের সহানুভূতিও পেয়েছেন। অবশ্যই ধর্মীয় অনুভূতিও এ ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে বলে বিশ্বাস। যা হোক, জামায়াতের পুনরুজ্জীবিত হওয়ার বিষয়টি আরও গভীর বিশ্লেষণের দাবি রাখে। তবে এ ধারা ভবিষ্যতে বজায় থাকে কি না, তা হবে লক্ষণীয় বিষয়।
এই নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বর্তমানে সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। তৃতীয় বৃহৎ দল বলে পরিচিত পার্টিটি প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার পর্যায়ে। বিগত ২০০৯ সালের নির্বাচনেও এমনটি হয়নি। এই দলের ওপর অবশ্যই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের জের যে পড়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বর্তমানে জাতীয় পার্টির দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের অবস্থান পরিষ্কার নয়। সরকারেও যোগ দিয়েছে, আবার বিরোধী দল হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত থাকার প্রয়াস জনমনে আস্থার অভাব ঘটিয়েছে। তদুপরি জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা। এরশাদ জাতীয় পার্টির মূল চালিকাশক্তি থেকে বিচ্যুৎ অবস্থায় রয়েছেন। অপরদিকে রওশন এরশাদের নেতৃত্ব নিয়ে পার্টির অভ্যন্তরে রয়েছে দ্ব্যর্থকতা। জাতীয় পার্টি থেকে বহুদিনের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য বর্ষীয়ান নেতা এবং জাতীয় পার্টির শাসনকালের প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর সদলবলে এরশাদকে পরিত্যাগ করায় জাতীয় পার্টির যে ক্ষতি হয়েছে, তার নেতিবাচক প্রভাবও যোগ হয়েছে তৃণমূল পর্যায়ের সমর্থনে। সংক্ষেপে বলা যায় যে এরশাদবিহীন জাতীয় পার্টির সমর্থন এবং জাতীয় পর্যায়ে পার্টির অবস্থান আগের অবস্থানে নেই। ভবিষ্যতে জাতীয় পার্টির অস্তিত্বই সংকটের মুখে পড়তে পারে।
যেমনটা আগেই বলেছি, স্থানীয় সরকার নির্বাচন নীতিগতভাবে নির্দলীয় হওয়ার কথা থাকলেও সে আবরণ আর থাকছে না। কারণ, সব দলের এই আবরণ অপসারণের কারণে। যেহেতু জাতীয় পর্যায়ে আমাদের দেশের রাজনীতি অতিরিক্ত মাত্রায় সাংঘর্ষিক হয়ে উঠেছে, মূলত সে কারণে স্থানীয় নির্বাচনকে বিভিন্ন দল জাতীয় পর্যায়ে দলের অবস্থানের মাপকাঠি হিসেবে দেখার প্রবণতা ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়েছে। এমতাবস্থায় স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে জাতীয় পর্যায়ের নীতি এবং অবস্থানের প্রতিফলন ঘটছে। এসব কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দলের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও সংগঠন। কোন্দল মাথাচাড়া দিচ্ছে তৃণমূল পর্যায়ে। স্থানীয় সমস্যাগুলো ধামাচাপা পড়ছে। এমতাবস্থায় দল এবং প্রার্থীর অবস্থান নিয়েও ভোটাদের বিভ্রান্তির মধ্য পড়তে হচ্ছে।
ধারণা করা হয়েছিল যে ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদে সিংহভাগ ভোটার ভোট প্রয়োগে বঞ্চিত হওয়ার কারণে ভোটের হার বেশি হবে, তেমনটি হয়নি। ইডব্লিউজি-১-এর মতে, মাত্র ৫৯ শতাংশ ভোট প্রদান করা হয়েছে, যা তৃতীয় উপজেলা নির্বাচন থেকেও অনেক কম। নিম্নগামী ভোটের হারের দুটি প্রধান কারণ হতে পারে; প্রথমত, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালের রাজনৈতিক পরিস্থিতির জের এখনো কাটেনি, যার পরিপ্রেক্ষিতে জনমনে বিরূপ ভাব বিদ্যমান ছিল। হয়তো ভবিষ্যতে এই হারের বৃদ্ধি হতে পারে। দ্বিতীয়ত, বিগত সময়ে বিভিন্ন কারণে উপজেলা পরিষদ জনগণের কাছে তেমন আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারেনি। অনুমেয় যে, এই দুই প্রধান কারণেই ভোটের হার আশাতীত হয়নি।
পরিশেষে উপরিউক্ত পর্যালোচনা আংশিক নির্বাচনের ওপর ভিত্তি করে হলেও ভবিষ্যতে পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ উপজেলা নির্বাচন সমাপ্ত হওয়ার পরে আরও অর্থবহ হবে। অপেক্ষা করতে হবে পূর্ণাঙ্গ নির্বাচনের। দৃশ্যপটের পরিবর্তন হতে পারে।


এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক।
hhintlbd@yahoo.com

লাল গোলাপের দেশে by সোনিয়া ইসলাম

চারদিকে নিঝুম নিস্তব্ধতা। বসন্তের মিষ্টি রোদে ধানের সবুজ কচি শিষে আলোর ঝিকিমিকি। ধানখেতের আল ধরে হাঁটলাম দীর্ঘপথ। তারপর উঁচু রাস্তা। লাল মাটির মেঠোপথ। যেন হেঁটে চলেছি আবহমান গ্রামবাংলার ছবির ভেতর দিয়ে।
মেঠোপথ পেরোলেই গোলাপের দেশ। শুনতে বহুদূরের পথ মনে হলেও ওই গোলাপের দেশ কিন্তু রাজধানীর খুব কাছেই। বুকে লাল ফুলের বন্যা নিয়ে তুরাগ নদের কোলে এক সবুজ দ্বীপ যেন ঢাকার সাভারের বিরুলিয়া গ্রাম।

প্রিয়ার কাছে পৌঁছানোর তাড়া তো থাকেই। কিন্তু অনেক সময় পথও তো হয়ে ওঠে রোমাঞ্চকর! আর গোলাপ! সে তো ফুলের রানি। তাকে খুঁজে বের করা চাট্টিখানি কথা নয়। অনেকটা পথ হেঁটে হেঁটেও যখন তার হদিস পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন মনে হলো গোলাপদেবী বুঝি অভিমানই করেছেন। যাহোক, ১১টা নাগাদ প্রথম বাগান দেখেই মনটা আনন্দে ভরে গেল। সেই শুরু। তারপর শুধু গোলাপ আর গোলাপ। মাঠের পর মাঠের বদলে এ হলো গোলাপের বনের পর বন।

প্রথমে ভেবেছিলাম কেবল বিরুলিয়া গ্রামেই বুঝি গোলাপের চাষ হয়। কিন্তু শুধু বিরুলিয়া নয়, সারুলিয়া, ভাগ্নিবাড়ি, সাদুল্লাপুর, শ্যামপুরসহ আশপাশের সব গ্রামেই কমবেশি গোলাপের চাষ হয়। দুপুর হয়ে যাওয়ায় ফুটন্ত গোলাপ খুব একটা চোখে পড়েনি। বিকেল নাগাদ আধফোটা ফুলগুলো ফুটে যায়। তাই বিকেলেই ফুল তোলা হয়। গোছা গোছা করে বেঁধে প্রস্তুত করা হয় হাটে নিয়ে যাওয়ার।

গোলাপের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে তখন পড়ন্ত দুপুর। এমনিতেই গ্রামগুলো শান্ত। তার ওপর দুপুরের নিস্তব্ধতায় যেন নিঝুমপুরি। সুন্দর ছবির মতো গ্রামগুলোর সৌন্দর্য অপার্থিব মহিমা ছড়াচ্ছিল আদিগন্ত বিস্তৃত লাল গোলাপের সমাহারে। একে তো গ্রামের রূপ তার সঙ্গে গোলাপের মহিমা—সব মিলিয়ে বিরুলিয়া যেন রূপকথার দেশ।
নিঝুম শান্ত গ্রামগুলোর চারপাশে যতদূর চোখ যায় কেবল গোলাপের বন। ছবি: লেখক

পুরো মাঠে ফুটন্ত লাল গোলাপের চোখ ঝলসানো সৌন্দর্য দেখতে না পারার একটা কষ্ট মনে মনে অনুভব করলেও, যা দেখেছি তার সৌন্দর্যও অসাধারণ। নিঝুম শান্ত গ্রামের আনাচ-কানাচে গোলাপের বন। যতই সামনে এগোচ্ছিলাম মুগ্ধতা বেড়েই চলছিল। ঢাকা শহরের অদূরেই এমন সৌন্দর্যের উত্স দেখে বিস্ময় জাগে।

বিরুলিয়া পৌঁছানোর আরও সোজা পথ আছে। বাসে-রিকশায় চলে যাওয়া যাবে অনেক কাছাকাছিই। ঢাকা থেকে বাসে সাভার বাসস্ট্যান্ড, সেখান থেকে মিনিবাসে বিরুলিয়া বাজার। এরপর আপনি চাইলে হেঁটে বা রিকশায়ও চলে যেতে পারেন গ্রামের ভেতরে। তবে, নির্জন সকাল বা দুপুরে রিকশা খুঁজে পাওয়া একটু কঠিন বৈকি। আর যেতে পারেন ঢাকার মিরপুর-১ থেকে বেড়িবাঁধ হয়ে নদী পার হয়েও। বেড়িবাঁধে রিকশা বা বাস যাতেই থাকুন বলতে হবে বিরুলিয়া যাব। তাহলেই আপনাকে নামিয়ে দেওয়া হবে খেয়াঘাটে। নৌকায় মাত্র চার-পাঁচ মিনিটেই পার হয়ে যাবেন নদী। ওপারেই বিরুলিয়া গ্রাম।

সেখানকার শ্যামপুরে প্রতিদিনই বসে গোলাপের হাট। ফুলচাষিরা ফুল কেটে নিয়ে চলে আসেন এই হাটে। সন্ধ্যা থেকেই শুরু হয় ফুল ব্যবসায়ীদের আনাগোনা। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অসংখ্য ব্যবসায়ী এসে ভিড় জমান এখানে। রাতে জমতে থাকে বেচাকেনা। ভোর থাকতে থাকতেই সেই ফুল পৌঁছে যাওয়া চাই রাজধানী ঢাকার শাহবাগে, পৌঁছে যাওয়া চাই এমন সব পাইকারি বিক্রির কেন্দ্রে। সেখান থেকে তা যাবে পাড়া-মহল্লার দোকানে দোকানে। তাই ফুলচাষিরা রাতেই করেন ফুলের বিকিকিনি।

গোলাপের চাহিদা থাকে সব সময়। তাই চাষিরাও সারা বছরই ব্যস্ত থাকেন। বিশেষ উত্সবের দিনগুলোতে চাহিদা বেড়ে যায় বহুগুণ। চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে দামও। লম্বা ডাঁটা রেখে কেটে নেওয়া গোলাপের বড় একটা গোছায় থাকে প্রায় ৩০০ ফুল। এমন একটা গোলাপ গোছার পাইকারি দাম ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। তবে উত্সবের সময় তা বেড়ে চলে যায় হাজার টাকার কাছাকাছি।

গোলাপ চাষে লাভের পাশাপাশি খরচও কম নয়। বিরুলিয়ার গোলাপচাষি শাফিজ উদ্দিন জানান, প্রথমবার এক পাকি (৩০ শতাংশের মতো) জমিতে গোলাপ চাষ করতে খরচ হয় প্রায় দেড় লাখ টাকা। আর সারা বছর ধরে যত্নআত্তি তো আছেই। শীতে পোকা-মাকড়ের প্রকোপ কম থাকলেও গরমে খুব বেশি থাকে। তাই নিয়মিত ওষুধ দিতে হয় তখন।

ফেরার পথে গোলাপের পাশাপাশি চোখে পড়ল বেশ কিছু গ্লাডিওলাসের বাগান। লাল মেঠোপথের একদিকে লাল গোলাপ আর অন্যদিকে সাদা গ্লাডিওলাস। ছবির মতো দৃশ্য। যাঁরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভালোবাসেন, নগরের ব্যস্ততম জীবনযাপন থেকে একটু সময় বের করে ঘুরে আসতে পারেন লাল গোলাপের দেশ বিরুলিয়া ও এর আশপাশের গ্রামগুলোতে। অসাধারণ কিছু নির্মল ভালো লাগা নিয়ে ঘরে ফিরতে পারবেন।

ফেরার সময় যখন লাল গোলাপের দেশ পেছনে ফেলে ক্রমশ নাগরিক জীবনের কাছাকাছি আসছিলাম, কেবলই কবি গুরুর সেই লাইনগুলো মনে পড়ছিল— ‘বহু দিন ধ’রে বহু ক্রোশ দূরে বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা, দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু। দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশিরবিন্দু।’

কালের পুরাণ- বড় ধাক্কা খেল আওয়ামী লীগ by সোহরাব হাসান

Saturday, February 22, 2014

সব রাজনৈতিক দলেই কিছু নেতা থাকেন, কথা বলতে ভালোবাসেন। তাঁরা কাজ করেন কম। কথা দিয়েই কাজের ঘাটতিটা পূরণ করতে চান।
তবে সম্ভবত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে এই নেতা-নেত্রীর সংখ্যাই বেশি। বিরোধী দলে এ রকম কথার রাজাদের কদর বেশি। কেননা, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিরোধী দলের একমাত্র কাজ হলো সরকারের সমালোচনা করা এবং সেই কাজটি যিনি যত জ্বালাময়ী ভাষায় দিতে পারেন, তিনি বড় নেতা হন। বাংলাদেশে জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তৃতা দেওয়া নেতার অভাব নেই। অভাব আছে দক্ষ প্রশাসকের। মন্ত্রীও যে একজন প্রশাসকও, সে কথাটি তাঁরা ক্ষমতায় থাকতে ভুলে যান এবং নিজের মন্ত্রণালয় ছাড়া সব বিষয়ে পাণ্ডিত্য দেখান।

শেখ হাসিনার তৃতীয় মন্ত্রিসভার বয়স দেড় মাসেরও কম। গত মাসের ১২ তারিখে তাঁর নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রিসভা শপথ নিয়েছে। আজ ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখ। এই এক মাস ১০ দিনের মধ্যে সরকার রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে যেই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি নিয়েছে তা হলো উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। সব উপজেলার মেয়াদ এখনো শেষ হয়নি। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, মেঘ না চাইতেই জল। সরকার হয়তো ভেবেছিল, প্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে আসা জাতীয় নির্বাচনের এক-দেড় মাসের মধ্যে উপজেলা নির্বাচন হলে বিরোধীরা বেকায়দায় পড়বে। কিন্তু প্রথম দফার ৯৭টি উপজেলা নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায়, বিরোধী দল নয়, সরকারি দলই বেকায়দায় পড়েছে। বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। দ্বিতীয় যে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে তা হলো, দ্রুত বিচার আইনের মেয়াদ আরও চার বছর বাড়ানো। আগামী এপ্রিলে এই মেয়াদ শেষ হবে। আগে দুই বছর করে বাড়ানো হতো। এবার চার বছর বাড়ল।
তবে উপজেলা নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে সরকারি দলের একটি সন্তুষ্টির জায়গা আছে সেটি হলো, শেখ হাসিনার আমলে সব নির্বাচন যে অবাধ ও সুষ্ঠু হয়, এটাই তার প্রমাণ। এ কারণে বাকি উপজেলা নির্বাচনগুলো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেসব নির্বাচন যদি মোটামুটি সুষ্ঠু হয় এবং বিরোধীদের জয়ের ধারা অব্যাহত থাকে, তাহলে আওয়ামী লীগ নেতারা জোর দিয়ে বলতে পারবেন, ‘আমরা ভোট কারচুপি করি না।’ তাতে তাঁদের রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল হলেও নৈতিক অবস্থান পোক্ত হবে। আর যদি নির্বাচন সুষ্ঠু না হয় এবং ক্ষমতাসীনেরা যেকোনো উপায়ে জয়ী হতে চায়, তাহলে আরও বড় চ্যালেঞ্জ সরকারের জন্য অপেক্ষা করছে। বিরোধী দল তখন সরকারকে সময় দিতে চাইবে কি না, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সংশয় আছে।
গত দেড় মাসে মন্ত্রীরা কে কী কাজ করেছেন, হিসাব নিলে অনেকের জমা খাতার হিসাব মেলানো কঠিন। বেশির ভাগ মন্ত্রীর কথাবার্তা শুনে মনে হয়, মন্ত্রিত্ব করা তাঁদের কাছে ডাল-ভাত। তাঁদের একমাত্র কাজ হলো পরাস্ত বিএনপি-জামায়াতকে কোণঠাসা করা। বিএনপি-জামায়াত তো এখন সংসদে নেই, রাজপথেও নেই। কোনো কোনো মন্ত্রী জাতীয় নির্বাচন বর্জন করে উপজেলা নির্বাচন করার জন্য বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়াকে নাকে খত দিতে বলেছিলেন। সেই মন্ত্রীদের কাছে জিজ্ঞাসা, এখন কে নাকে খত দেবেন।
তবে আমরা নিশ্চয়ই সব মন্ত্রীকে এই বাকপটু দলে ফেলছি না। অনেক মন্ত্রীকে দায়িত্ব নিয়েই কঠিন পরিস্থিতি সামাল দিতে হচ্ছে। তাঁরা নিজেদের গুরুত্ব দেশের মানুষ ও বিদেশি বন্ধুদের কাছে ভালোভাবেই তুলে ধরতে পেরেছেন। যেসব মন্ত্রী আগের মন্ত্রণালয়ে নিজেদের ঠাঁই করে নিতে পেরেছেন, স্বভাবতই তাঁরা কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন। কিন্তু যাঁরা মন্ত্রিসভায় নতুন এসেছেন অথবা পুরোনো হলেও নতুন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন, তাঁদের কাজটি বুঝতে তো কিছুটা সময় লাগার কথা। যদিও এসব মন্ত্রীর হাবভাব দেখে মনে হয়, মন্ত্রণালয় পরিচালনা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো বিএনপি-জামায়াতকে ঘায়েল করা। তাই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই তাঁদের কণ্ঠে সেই জিগিরই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে—রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি কত খারাপ, কত গণবিচ্ছিন্ন।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপির না যাওয়া তাদের রাজনৈতিক ভুল ছিল বলে আমরাও মনে করি। এর অর্থ এই নয় যে তারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বরং উপজেলা নির্বাচনে মৌলবাদী জামায়াতে ইসলামীর আশাতীত ভালো ফল কেবল সরকারের জন্য নয়, বাংলাদেশের জন্যও অশনিসংকেত। অতীতে কোনো নির্বাচনে তারা এই ফল দেখাতে পারেনি।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে গত দেড় মাসে সরকার এমন কিছু করে দেখাতে পারেনি যে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বাড়বে। এমনকি মার্কিন গবেষণা সংস্থা আরডিআই ও ডিআইএর জরিপে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা কমারই ইঙ্গিত দিয়েছে। অনেকে এ কথাও বলাবলি করছে যে সরকার ছাত্রলীগকেই সামাল দিতে পারছে না, সেই সরকার কীভাবে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসবে। চট্টগ্রামে স্বর্ণ ব্যবসায়ী মৃদুল চৌধুরীর অপহরণ ও উদ্ধারের ঘটনাটি নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করতে চাই, কেন মৃদুল অপহরণ হলেন, কারা তাঁকে অপহরণ করলেন, কেন অপহরণ করলেন, কীভাবে তিনি ছাড়া পেলেন?
আয়মান আল-জাওয়াহিরির ভিডিও বার্তার জন্য বিরোধী দলকে দায়ী করা যায়। কিন্তু মৃদুল চৌধুরীর অপহরণকারীদের খুঁজে বের করা সত্যি কঠিন!
এত দিন সরকারি দলের নেতারা এবং সরকারের মন্ত্রীরা সব অপকর্মের দায় বিরোধী দলের ধ্বংসাত্মক রাজনীতির ওপর চাপিয়ে বাহবা নিতে চাইতেন। দেশের যা কিছু অমঙ্গল, সবকিছুর জন্য বিরোধী দল দায়ী। কিন্তু এখন তাঁরা কী বলবেন? এখন তো বিরোধী দল ধ্বংসাত্মক কোনো কর্মসূচি দিচ্ছে না।
একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে বাংলাদেশে আল-কায়েদার এজেন্ট হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সেটি যদি সত্যি হতো, তাহলে মন্ত্রীর তথ্য উদ্ঘাটনের আগেই যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিত। তাঁর পরামর্শের অপেক্ষা করতেন না। তারেক রহমানের রাজনীতির বিরোধিতা করা এবং তাঁকে আল-কায়েদা বানানো এক কথা নয়। উপজেলা নির্বাচনে তারেক রহমানের দল আওয়ামী লীগের চেয়ে বেশি পদ পেয়েছে, জামায়াতকে ধরলে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। এখন কি মন্ত্রী মহোদয় বলবেন, বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ আল-কায়েদার সমর্থক? মন্ত্রী মহোদয় হয়তো বলবেন, বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া যেহেতু আল-কায়েদা নেতা জাওয়াহিরির ভিডিও বার্তাকে প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের বানানোর বলে দাবি করেছেন, সেহেতু তার পাল্টা একটি বক্তব্য দেওয়া দরকার। কিন্তু তাঁকে মনে রাখতে হবে, দেশ চালাচ্ছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি-জামায়াত নয়। তাই দেশে যত অঘটন ঘটবে, তার দায়ও আওয়ামী লীগকেই নিতে হবে অথবা তথ্য-প্রমাণ দিয়ে বলতে হবে, ওরা অপরাধী। হাওয়ায় ছড়ি ঘোরালে হবে না।
বিরোধী দলে থাকলে নেতা-নেত্রীরা অনেক কিছু বলেন, বলতে পারেন। কিন্তু ক্ষমতায় থাকা নেতাদের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব জনগণের কাছে দেওয়া ওয়াদা পূরণ করা। অবশ্যই ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত করার বাইরে কার্যত কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি। দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। বরং বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধে ২০০৮ সালে যেই প্রতিশ্রুতি ছিল, সেটি সজ্ঞানে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এর অর্থ কি এই দাঁড়ায় না যে ২০০৮ সালে বাংলাদেশে আইনের শাসনের জন্য বিচারবহির্ভূত হত্যার প্রয়োজন ছিল না! এখন আছে। বিশ্ব দ্রুত সামনে এগোচ্ছে। আর আমরা ক্রমেই পেছনে চলে যাচ্ছি।
১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনেও আমরা শক্তিশালী বিরোধী দল পেয়েছিলাম বলে সেই সরকার ও সংসদে ভারসাম্য ছিল। অন্তত প্রথম দুই-আড়াই বছর। ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে সেই ভারসাম্য রক্ষিত হয়নি বলে দেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্রচর্চা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়ে পড়ে। আর ২০১৪ সালে নির্বাচনে বিরোধী দলের অস্তিত্ব নেই বলেই জনমনে ধারণা। ফলে এই ভারসাম্যহীন সংসদ ভারসাম্যপূর্ণ রাজনীতি উপহার দিতে পারবে কি না, সেটাই এখন ক্ষমতাসীনদের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জাতীয় ঐকমত্যের সরকার মুখে বললেই হয় না, কাজে দেখাতে হয়। নির্বাচনী বৈতরণি পার হয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা এতটাই আস্থাশীল হয়ে পড়লেন যে উপজেলায় ১৪-দলীয় শরিকদের সঙ্গেও পদ ভাগাভাগি করতে রাজি হলেন না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পথ ও পথের বিবেচনায় আওয়ামী লীগের যেমন কিছু সুবিধা আছে, তেমনি অসুবিধার দিকটি হলো, আওয়ামী লীগ বিপদে না পড়লে কখনো কারও সঙ্গে জোট বাঁধে না। বিপদে পড়লে খেলাফত মজলিসের সঙ্গেও জোট বাঁধতে পারে। অন্য সময়ে একলা চল নীতিতে চলে দলটি। ১৪ দল ও জাতীয় পার্টির সঙ্গে সমঝোতা করে প্রার্থী দিলে নিশ্চয়ই ক্ষমতার দেড় মাসেরও কম সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগকে উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের কাছে এভাবে নাকানিচুবানি খেতে হতো না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

বিশ্বায়নের কাল- বাংলাদেশের মতো ব্রিটেন by কামাল আহমেদ

বাংলাদেশের মতো ব্রিটেন। ইংরেজিতে ‘ব্রিটেন অ্যাজ বাংলাদেশ’ শিরোনামটা আমার নয়, যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় এবং রক্ষণশীল দৈনিক দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর ১৭ ফেব্রুয়ারি সংখ্যার একটি সংবাদভাষ্যের।
ব্রিটেনের সাম্প্রতিক রেকর্ড সৃষ্টিকারী বন্যা এবং তার দুর্ভোগের ফলে যে জাতীয় বিতর্ক চলছে, তার তুলনা খুঁজতে গিয়ে পত্রিকাটির শিরোনাম রচয়িতার মনে হয়েছে যে এ ক্ষেত্রে একমাত্র তুলনীয় রাষ্ট্র হচ্ছে বাংলাদেশ।

ব্রিটেনে যে বন্যা এবং জলোচ্ছ্বাস হয়ে গেল, তার ব্যাপকতা বোঝানোর জন্য কয়েকটি তথ্য এখানে তুলে ধরা প্রয়োজন। আবহাওয়ার এই বিরূপ ছোবল এক দিন বা কয়েক দিনের নয়, এটি চলেছে প্রায় দুই মাস ধরে। সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্রিটিশদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব বড়দিনের সময় শুরু হওয়ার পর তা আড়াই মাস ধরে বারবার ফিরে এসেছে। আধুনিককালের কারখানাগুলোতে কনভেয়ার বেল্টে যেভাবে উৎপাদিত পণ্যগুলো আসতে থাকে, সেভাবেই একের পর এক নিম্নচাপ এসেছে। মোট কতবার তা বলা মুশকিল। তবে লন্ডন শহরকে বন্যা বা প্লাবন থেকে রক্ষার জন্য টেমস নদীতে নির্মিত বন্যারোধক বা ফ্লাড ব্যারিয়ারকে এ সময়ে মোট ২৮ বার নামাতে হয়েছে। বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, এটি নির্মিত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত যতবার নামাতে হয়েছে তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ হয়েছে গত দুই মাসে। আটলান্টিক মহাসাগরের ওপর যে বায়ুপ্রবাহের (জেটস্টিম) প্রভাবে এসব বৃষ্টি এবং জলোচ্ছ্বাস হয়েছে, এই উপর্যুপরি আঘাতের কারণে ব্রিটিশ প্রচারমাধ্যমে একে ‘কনভেয়ার বেল্ট ওয়েদার ফেনোমেনন’ বলেও অভিহিত করা হয়েছে।
একটি হিসাবে বলা হয়েছে, ব্রিটেনে যখন থেকে বৃষ্টির হিসাব রাখা শুরু হয়েছে, সেই ১৭৭৬ সালের পর এ বছরই বৃষ্টির পরিমাণ ছিল সবচেয়ে বেশি। মাটির পানি শোষণ এবং তা ধরে রাখার ক্ষমতা অনেক আগেই শেষ হয়ে যাওয়ায় বন্যার পানি সরে যাওয়ারও কোনো জায়গা ছিল না। ফলে, আবহাওয়া কিছুটা স্বাভাবিক হলেও বন্যার পানি সরতে সময় লাগছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন কবে তাঁদের ঘরবাড়িতে ফিরতে পারবেন, তা এখনো অনিশ্চিত। ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সময় প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। মারা গেছেন অন্তত তিনজন। আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ কয়েক শ কোটি পাউন্ড ছাড়িয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কারণ থাকবে না। বিমা কোম্পানিগুলো বলছে যে শুধু ঘরবাড়ি এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ১০০ কোটি পাউন্ড ছাড়িয়ে যাবে। রেলপথ, রাস্তাঘাট এবং অন্যান্য অবকাঠামোর ক্ষতির পরিমাণ জানতে অপেক্ষা করতে হবে আরও কয়েক সপ্তাহ।
তবে দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর শিরোনামে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ আসার কারণ বন্যাপীড়িত ব্রিটিশদের দুর্ভোগের বিষয় নয়, বরং বন্যার দুর্ভোগের কারণটি। বাংলাদেশে বন্যা একটি বার্ষিক অনুষঙ্গ এবং বাংলাদেশিরা বন্যার সঙ্গে নিজেদের জীবনকে খাপ খাইয়ে নেওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন বা চেষ্টা করছেন। বন্যানিয়ন্ত্রণের জন্য যে বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন, বাংলাদেশের জন্য তার সংস্থান করা প্রায় অসম্ভব। সুতরাং, বাংলাদেশে বন্যা এবং জলোচ্ছ্বাসের সময় প্রাণ ও সম্পদহানি রোধে উঁচু স্থানে আশ্রয়শিবির নির্মাণ, সতর্কবাণী প্রচার, সম্ভাব্য বিপদের সময় বসতবাড়ি ছেড়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করা, স্বাস্থ্য খাতে প্রস্তুতি—এগুলোর ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়। কিন্তু বিশ্বের পঞ্চম ধনী রাষ্ট্র ব্রিটেনে বন্যার ঝুঁকি মোকাবিলার একটি বড় অংশ হচ্ছে বন্যানিয়ন্ত্রণ।
১৯২৮ সালের বন্যায় ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ঐতিহাসিক স্থাপনা, ওয়েস্টমিনস্টার ভবন এবং লন্ডনের পাতালরেল প্লাবিত হওয়ার পর লন্ডনকে রক্ষার বিষয়টি অগ্রাধিকার পায় এবং সত্তরের দশকে টেমসের ফ্লাড ব্যারিয়ার নির্মাণ শুরু হয়, যা সম্পন্ন হয় ১৯৮২ সালে। এই দ্বীপরাষ্ট্রের উপকূলীয় শহরগুলোর প্রায় সব কটিতেই রয়েছে উঁচু শহর রক্ষাবাঁধ। কোথাও কোথাও তা শত বছরের পুরোনো, কোথাও কোথাও কয়েক দশকের। আবার, কোথাও কোথাও উপকূল থেকে কিছুটা জায়গা ছেড়ে দিয়ে বসতি গড়া হয়েছে অনেকটা ভেতরে, যাতে মাঝখানের জায়গাটি পানি ধরে রাখতে পারে। নদীগুলোর নাব্যতা বজায় রাখার জন্যও সময়ে সময়ে ড্রেজিং বা পলি অপসারণের কাজটাও করা হয়। কিন্তু গত এক দশকের বেশি সময় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীগুলোর বিশেষ করে সমারসেট এলাকার নদীগুলোতে কোনো ড্রেজিং হয়নি। ২০০৭ সালে ওই এলাকায় যে বড় ধরনের বন্যা হয়েছিল, সেই বন্যার পর ড্রেজিংয়ের জন্য দাবি উঠলেও সরকার তার জন্য কোনো অর্থ বরাদ্দ দিতে পারেনি। ২০০৮ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা এবং পরবর্তী সময়ে টোরি পার্টির কৃচ্ছ্র কর্মসূচি তার অন্যতম কারণ। আর, বন্যানিয়ন্ত্রণে অক্ষমতার মধ্যেই বাংলাদেশের সঙ্গে ব্রিটেনের সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল।
অবশ্য বলে রাখা ভালো, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর উদ্দেশ্যটা এ ক্ষেত্রে মহৎ নয়, বরং তারা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাববিষয়ক বিতর্ককে আড়াল এবং নাকচ করার উদ্দেশ্যেই বিষয়টিকে এভাবে তুলে ধরেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে সংশয় সৃষ্টিকারী রক্ষণশীল গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করার জন্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর বিশেষ পরিচিতি রয়েছে। বৈশ্বিক পরিসরে মিডিয়া মোগল হিসেবে খ্যাত রুপার্ট মারডকের মালিকানায় থাকা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও এ বিষয়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর মতোই। ব্রিটেনের এই সাম্প্রতিক বন্যার সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের যোগসূত্র প্রতিষ্ঠার বিতর্কে প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন এবং বিরোধী নেতা এড মিলিব্যান্ডের প্রায় অভিন্ন অবস্থানকে পত্রিকাটি যেভাবে তিরস্কার করেছে, তাতে এটা আরও স্পষ্ট হয়েছে সন্দেহ নেই। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায়ও উপর্যুপরি তুষারপাতে জনজীবন অচল হয়ে যাওয়ার চিত্র ওই সব দেশের রাজনীতিকদের কিছুটা বিচলিত করে তুলেছে।
এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য আশার কথা এই যে সাম্প্রতিক ‘কনভেয়ার বেল্ট ওয়েদার ফেনোমেনন’ আটলান্টিকের উভয় তীরে যে জনভোগান্তির জন্ম দিয়েছে, তাতে জলবায়ু পরিবর্তন এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়নের হার কমানোর বিষয়টিতে এসব শিল্পোন্নত ও ধনী দেশগুলোকে এখন আন্তর্জাতিক পরিসরে কিছুটা সক্রিয় হতে হবে। গত সপ্তাহান্তে তাই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি চীন ও ইন্দোনেশিয়া সফরের সময় বৈশ্বিক উষ্ণায়নের হার কমাতে সহযোগিতার হাত বাড়ানোর জন্য ওই দুই দেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

দুই.
‘বাংলাদেশের মতো ব্রিটেন’ শিরোনামটি অবশ্য আমি অন্য আরেকটি ক্ষেত্রেও আংশিকভাবে প্রযোজ্য বলে মনে করি। আর সেই ক্ষেত্রটি হচ্ছে নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত। ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত স্বার্থ এবং রাজনৈতিক সংকীর্ণতার তাড়নায় গণতান্ত্রিক আচার-আচরণ এবং সংস্কৃতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কতিপয় বাংলাদেশি ‘যেকোনো উপায়ে পরাজয় এড়ানোর’ যেসব কৌশল ব্রিটেনে আমদানি করেছে বলে অভিযোগ উঠছে, তার পটভূমিতেই এ কথা বলা চলে (সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশির ক্ষেত্রে বিষয়টি সত্য নয়)।
ব্রিটেনের নির্বাচন কমিশন গত ৮ জানুয়ারি এক রিপোর্টে বলেছে যে দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠী—বিশেষ করে পাকিস্তানি এবং বাংলাদেশি ব্রিটিশদের মধ্যে ভোট জালিয়াতির ঝুঁকি বেশি। শুধু ইংল্যান্ডের ১৬টি পৌর এলাকাকে চিহ্নিত করে কমিশন বলেছে যে তারা এসব এলাকায় ভোট জালিয়াতির ঝুঁকির বিষয়টি বিশেষভাবে খতিয়ে দেখছে। এলাকাগুলোর মধ্যে বাংলাদেশিপ্রধান টাওয়ার হ্যামলেটস ছাড়াও বার্মিংহাম, ব্ল্যাকবার্ন, কভেন্ট্রি, ওল্ডহ্যাম, ব্রাডফোর্ড, স্পাও, পিটারবরার মতো পৌর এলাকা রয়েছে, যেসব জায়গায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশি বসবাস করে। ভোট জালিয়াতির অন্যতম প্রধান একটি উপায় হচ্ছে ডাকযোগে ভোট। অভিযোগ রয়েছে, একটি এক বা দুই শয়নকক্ষের বাসাতেও ১৫-২০ জন ভোটার রেজিস্ট্রেশন করা হয়, যাঁদের অধিকাংশই ভুয়া অথবা অন্য এলাকার বাসিন্দা। তাঁদের ভোটগুলো প্রার্থীদের পক্ষে ডাকযোগে পাঠিয়ে দিলেই ভোটের ঝুলিটা বাড়ানো যায়।
ব্রিটিশ নির্বাচন কমিশন ডাকযোগে ভোট বন্ধ করার দাবিটি গ্রহণ না করলেও আগামী মে মাসে অনুষ্ঠেয় স্থানীয় সরকার এবং ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনের আগেই ভোটার রেজিস্ট্রেশন কর্মকর্তা, রিটার্নিং কর্মকর্তা এবং পুলিশকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। কমিশন একই সঙ্গে সুপারিশ করেছে যে ভোট দেওয়ার সময় ভোটারদের পরিচয়পত্র দেখানো বাধ্যতামূলক করে আইন প্রণয়ন করা হোক। সরকার কমিশনের সুপারিশকে স্বাগত জানানোয় ধারণা করা হচ্ছে, এই সুপারিশের আলোকে সরকার হয়তো নতুন আইন তৈরি করবে, তবে তা আগামী বছরের জাতীয় নির্বাচনের আগে সম্পন্ন হবে কি না, বলা মুশকিল।
ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, ব্রিটিশ বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের (বিবিসিসি) দ্বিবার্ষিক সাধারণ সভা ও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৮ ফেব্রুয়ারি। বণিক সমিতি হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি ব্রিটেনে খুব যে প্রভাবশালী সে কথা বলা যাবে না। তবে বাংলাদেশে তাদের গুরুত্বই আলাদা। বাংলাদেশে ব্রিটিশ বিনিয়োগ বাড়ার কারণে এই প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব আরও বাড়ছে বলেই মনে হয়। কিন্তু সেখানেও কোটারি ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব এবং গণতান্ত্রিক রীতিনীতি লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। ব্রিটেনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্যবসায়ীদের মধ্যে সবচেয়ে সফল হিসেবে খ্যাত ইকবাল আহমেদ ও বিইসহ (প্রবাসী ব্যাংক-এর উদ্যোক্তা চেয়ারমান) ছয়জন পরিচালক ২ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলন করে পদত্যাগ করেছেন। তাঁদের অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানটি একটি কোটারি স্বার্থে পরিচালিত হচ্ছে এবং সংগঠনের গঠনতন্ত্র না মেনে স্বেচ্ছাচারের মাধ্যমে কয়েকজন সহযোগীর সদস্যপদ স্থগিত করেছে।
স্থানীয় বাংলা সংবাদমাধ্যমকে বিবিসিসির কর্মকর্তারা বলেছিলেন যে নির্বাচনের আগেই সমস্যা মিটে যাবে। কিন্তু সর্বশেষ খবর হচ্ছে, সমস্যা নিরসন ছাড়াই অনেকটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে।
কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন।

খোলা হাওয়া- শুধু আবেগ নয়, ভালোবাসাটাও চাই by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

Friday, February 21, 2014

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইউনুস আলী আকন্দ ১৬ ফেব্রুয়ারি উচ্চ আদালতে জনস্বার্থে বাংলায় একটি রিট করেন, যাতে তিনি ১৯৮৭ সালের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন আইনটির বাস্তবায়নে আদালতের নির্দেশনা কামনা করেন।
জনাব আকন্দ তাঁর রিটে উল্লেখ করেন, গত ২৭ বছরে সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা এ আইনটি ঢালাওভাবে অমান্য করে চলেছেন। উচ্চ আদালত রিটের প্রাথমিক শুনানি শেষে সর্বস্তরে অবিলম্বে বাংলা ভাষা ব্যবহারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে একটি রুল জারি করেন এবং এপ্রিলের মধ্যে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেন। দূতাবাস ও বিদেশি প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড, নামফলক ও গাড়ির নম্বরপ্লেট এক মাসের মধ্যে লেখার নির্দেশও দিয়েছেন উচ্চ আদালত।

এই নির্দেশকে আমরা সাধুবাদ জানাই এবং বাংলা ভাষার প্রসার ও চর্চা এবং নানাবিধ বিকৃতির হাত থেকে বাংলা ভাষাকে রক্ষার ক্ষেত্রে আদালতের আগ্রহকে আমরা একুশের চেতনার প্রতিফলন হিসেবেই দেখতে চাই। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভাষার বিকৃতি রোধ করার জন্য উচ্চ আদালত যে নির্দেশনাটি দিয়েছিলেন, তা ছিল সুচিন্তিত ও সময়োপযোগী। একটি ভাষার শরীরে বিভিন্ন ভাষার জল-হাওয়া লাগবে এবং তার বেড়ে ওঠায় এদের একটা প্রভাব থাকবে, সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু জোর করে সেই ভাষার ওপর একটি বা দুটি ভাষার ঝাপটা ক্রমাগত বইয়ে দিলে সেই ভাষাটি তার সুস্থতা হারায়। সদর দরজা দিয়ে যে মেহমান আসবেন, তাঁকে বরণ করে নিতে সবচেয়ে অসামাজিক বাঙালিও তৈরি থাকেন। কিন্তু সিঁধ কেটে যে চোর ঘরে ঢুকবে, তাকে ঘরের মানুষ হিসেবে মেনে নেওয়ার কথাটা তো কেউ কল্পনাও করবে না।
এখন বাংলা ভাষা পড়েছে হিন্দি আর ইংরেজির চোরাগোপ্তা আক্রমণের সামনে, ক্রমাগত সিঁধ কেটে ঢুকছে নানা অপ্রয়োজনীয় শব্দপদ। এই আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে আমরা বিদেশি ভাষার হাতে আমাদের ক্রিয়াপদগুলোও তুলে দিচ্ছি। দুই বছর আগে উচ্চ আদালত এই আক্রমণ ঠেকানোর জন্য কিছু নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তারপর অনেক দিন-মাস চলে গেলেও ভাষার বিকৃতি ঠেকাতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, ১৬ ফেব্রুয়ারি দেওয়া উচ্চ আদালতের নির্দেশটিকেও শেষ পর্যন্ত মান্য করা হবে না। সরকারের কর্তাব্যক্তিরা অবশ্য একটা কৈফিয়ত খাড়া করবেন, কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তারও একটা তালিকা পেশ করবেন। কিন্তু যাকে বলে আস্তিন গুটিয়ে কাজে নেমে পড়া, তা আর হবে না। ফলে আগামী ফেব্রুয়ারিতেও আমরা ভাষার ক্ষেত্রে অরাজকতার পুরোনো ছবিটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আবার দেখব।
বাংলা ভাষার জন্য তরুণেরা বুকের রক্ত দিয়েছেন। সেই রক্তের রেখা ধরে একটি দেশ স্বাধীন হলো। বাংলা ভাষা পেল রাষ্ট্রভাষার সম্মান। বিশ্বসভায় এই ভাষার প্রতিনিধিত্ব আমরাই করছি। খুব বেশি দিন আমাদের অপেক্ষা করতে হবে না, জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে এই ভাষা স্বীকৃতি পাবে। আমরা যদি ভাষার অগ্রযাত্রাকে একটি রেখা এঁকে বর্ণনা করতে চাই, তাহলে তো সেই রেখা এত দিনে উঁচু থেকে উঁচুতে উঠতে থাকার কথা। কিন্তু বাস্তব চিত্রটা কি তাই? নাকি এই রেখা চলছে ভূমির সমান্তরাল এবং কখন সেটির মাথাটা মাটির দিকে হেলে পড়ে যায়, তা নিয়ে আমরা চিরশঙ্কায় থাকি?
এটি কেন হবে যে ভাষার প্রশ্নে স্বাতন্ত্র্য-অন্বেষী একটি জাতির স্বাধীনতার এত বছর পরও এই ভাষাকে তার পথচলার জন্য আদালতের হাত ধরতে হবে? তবে কি বাংলা ভাষার পায়ে শক্তি নেই, তাকে চলতে হয় ইংরেজি ও পণ্যসংস্কৃতির ভাষার লাঠি ধার করে এবং মাঝেমধ্যে যখন সে হোঁচট খেতে যায়, তা ঠেকানোর জন্য আদালতকে একটা হাত বাড়িয়ে দিতে হয়? এ কাজটি কি আদৌ আদালতের, নাকি পরিবারের, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের, সমাজের? শুরুতে মাননীয় আদালতকে সাধুবাদ জানিয়েছি, কিন্তু একই সঙ্গে একটু কি আত্মগ্লানিতে ভুগতে হয় না আমাদের? উচ্চ আদালত যে উদ্যোগটি নিয়েছেন, সেটি তো ব্যক্তিগত এবং সামষ্টিকভাবে আমাদেরই নেওয়া উচিত ছিল, অনেক আগেই। আমরা কি তাহলে নিজেদের ভাষাটাকেই উদ্ধার করতে পারছি না বিকৃতি আর অবহেলার চোরাবালি থেকে? উচ্চ আদালতের দুই নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ হবে, তেমনটি আশা করা কঠিন কিন্তু এটুকুও যদি হতো যে আমাদের কাজটি আদালতকে করতে দেখে আমরা লজ্জায় জিব কাটলাম, তাতেও একটুখানি ফল পাওয়া যেত। কিন্তু তারও কোনো নিদর্শন তো চোখে পড়ছে না। মাতৃভাষা নিয়ে আমাদের বিশেষ কোনো ভাবনা নেই, শুধু কিছু পার্বণিক আবেগ ছাড়া।
মাতৃভাষার জন্য বুকভর্তি পার্বণিক দরদের প্রয়োজন নেই, একটুখানি সত্যিকার ভালোবাসা থাকলেই যথেষ্ট। সঙ্গে যদি থাকে অল্পখানি আত্মসম্মান এবং এক চিমটি নিষ্ঠা, তাতেই কাজ হয়, বাংলা ভাষা তার সৌন্দর্য নিয়ে বিকশিত হয়। এবং এই বিকাশের এক শটা পথ বেরিয়ে যায়। আমার অভিজ্ঞতায় পাওয়া তিনটি উদাহরণ বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করতে পারে। প্রথম উদাহরণটি নিউইয়র্কের কোরীয় জনগোষ্ঠী, দ্বিতীয়টি চীনের একটি শহরে এবং তৃতীয়টি ঘরের কাছের কলকাতা থেকে কুড়ানো। নিউইয়র্কের ফ্লাশিং অঞ্চলে প্রচুর কোরীয়র বাস, ওই এলাকায় আমি কিছুদিন ছিলাম। আমার প্রতিবেশী এক কোরীয় পরিবারের সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা ছিল। সেই পরিবারে একই ছাদের নিচে তিন প্রজন্ম বাস করত। বৃদ্ধ দাদাসাহেব ও তাঁর স্ত্রী, তাঁদের দুই ছেলে, যাঁদের বয়স ৪০ থেকে ৫০ এবং তাঁদের চার সন্তান, যাদের বয়স সাত থেকে আঠারোর মধ্যে। বুড়োবুড়ি কোরিয়া থেকে নিউইয়র্ক এসেছিলেন সেই কবে। দুই ছেলে জন্মেছেন সেই শহরে। ছেলেদের বাচ্চারাও। নিউইয়র্কে (এবং উত্তর আমেরিকা-ইউরোপের নানা শহরে) আমি এ রকম অভিবাসী বাঙালি পরিবার দেখেছি—তিন না হলেও দুই প্রজন্মের তো বটেই। এদের সবার সন্তানকে একটা গড় হিসাবে আনলে বলা যাবে, ১০টির মধ্যে নয়টি সন্তানই বাংলা পড়তে বা লিখতে পারে না, বুঝতে বা বলতে পারলেও। তবে সেই বলতে পারারও দেখা মেলে কদাচিৎ। অথচ কোরীয় পরিবারটির ঘরের ভেতরে একমাত্র ভাষা তাদের মাতৃভাষা। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এটি কী করে সম্ভব? তারা ততোধিক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছে, কেন নয়?
বটে; কেন নয়। বেশির ভাগ অভিবাসী বাঙালি বাবা-মা নিজেরাই যে বাচ্চাদের সঙ্গে ইংরেজি ছাড়া বাংলায় কথা বলেন না। ‘বাংলা শিখে কী হবে?’ তাঁরা জিজ্ঞেস করেন। কোরীয় পরিবারগুলোকেও এই প্রশ্ন করা যায়; কোরীয় শিখে কী হবে? উত্তরে আমার পরিচিত পরিবারের দাদামশাই ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে এবং ১৪ বছরের এক নাতি চোস্ত ইংরেজিতে জানায়, শিকড়টা মাটিতে থাকবে, সংস্কৃতিটা জাগ্রত থাকবে, মনটা সুন্দর থাকবে আর পূর্বপুরুষের সঙ্গে সম্পর্কটা অটুট থাকবে, সে জন্য।
আর নেহাতই যদি ‘বাংলা বিসর্জিয়া ইংরেজি শিখিয়া আরোহণ করিব সমৃদ্ধি-চূড়ায়’ জাতীয় লজিক থাকে আমাদের মাথায়, তাহলে সেখানেও কোরীয়রা আমাদের লজ্জা দেবে। তাদের কোরীয় ভাষা জানা, বাড়িতে কোরীয় ভাষা বলা, কোরীয় ভাষায় বই পড়া, সিনেমা দেখা, গান শোনা, তর্ক-বিতর্ক-মান-অভিমান-ঠাট্টা-কাজিয়া-তামাশা করা সন্তানেরা বিরাট বিরাট চাকরি করছে আমেরিকায়। সমৃদ্ধির চূড়ায় ওরাই তো উঠে বসেছে।
আমি কান পেতে শুনেছি—না, যখন তারা কোরীয় বলে, একটি ইংরেজি শব্দও তারা ব্যবহার করে না।
আমার দ্বিতীয় উদাহরণেও আছে ভাষার এই অভঙ্গুর অবয়বটির ছবি। চীনের একটি শহরে বেরিয়েছিলাম জাদুঘর দেখতে। শহরে ইংরেজি জানা মানুষের সংখ্যা কম। অনেক খুঁজে পেতে যে একজনকে পাওয়া গেল, তাঁর ইংরেজি খুবই উন্নত। বয়সে তরুণ, পেশায় আইটি বিশেষজ্ঞ, ব্যবহারে অমায়িক। আমাদের আস্ত দুই ঘণ্টা সময় দিলেন সেই তরুণ, সুন্দর ইংরেজিতে সব বোঝালেন। কিন্তু মাঝখানে কফি খেতে বসে যখন জাদুঘরের এক কর্মকর্তার সঙ্গে নিজ ভাষায় কথা জুড়ে দিলেন, আমি কান পেতে রইলাম অন্যান্য ভাষার শব্দ ইত্যাদি শোনার জন্য। হতাশ হতে হলো। পরে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি ইংরেজি বা অন্যান্য ভাষার শব্দ ব্যবহার করেন কি না তাঁর বলা ভাষায়। তরুণ হেসে জানান, তার প্রয়োজন হয় না, যেহেতু প্রায় প্রতিটি বিদেশি বস্তুকে (অর্থাৎ বিশেষ্যকে) চৈনিক ভাষায় বর্ণনা করার জন্য পর্যাপ্ত পরিভাষা তৈরি
আছে। কম্পিউটার, ইন্টারনেট, মডেম—এসব খটমট আপাত অনুবাদ-অযোগ্য শব্দেরও একটি নয়, একাধিক।
সবচেয়ে অবাক হলাম শুনে, সেই শিশুবেলাতেই তাদের শেখানো হয়, ভাষার পৃথিবীটা এত বড় যে সেখানে অস্থির পরিব্রাজক হয়ে একজীবন কাটিয়ে দিলেও এর অল্পটাই দেখা হয়। চৈনিক তরুণ আমাকে আরও জানান, ভাষার গাঁথুনি একটা গানের মতো। গানের সুরটা কেউ বেসুরো করে গাইলে যেমন সেই গান শুনতে ইচ্ছা করে না, ভাষার ভেতরের গানটাকে ধরে না রাখতে পারলে সেই ভাষার লাবণ্য চলে যায়।
গানের কথায় কলকাতায় যাওয়া যায়। কলকাতায় বাংলা খুব অসহায়। শুধু যে অবহেলা, তা নয়, ইংরেজি-হিন্দির আগ্রাসনে শিক্ষিত বাঙালির ভাষা ক্রমেই যেন অরক্ষিত হয়ে পড়ছে। লেখালেখিতে একটা সতেজ ভাব আছে, সন্দেহ নেই; কিন্তু মুখের ভাষায়, বিশেষ করে তরুণ-তরুণীর, আছে একটা জগাখিচুড়ি ভাব। অথচ কলকাতারই এক এফএম রেডিওর—নামটা ভুলে গেছি—একটা অনুষ্ঠান শুনে মনে হলো, বাংলা ভাষার ভেতরের গানটাকে তার মতো করে জাগাচ্ছে এই রেডিওটি। এই গান ওদের এক রকম, আমাদের আরেক রকম। কিন্তু দুই গানে একটা মিল তো আছে। স্মৃতিচারণার এই অনুষ্ঠানটি, দুই বছরের বেশি আগে শোনা, এখনো মনে আছে, কারণ ঝলমলে, পরিচ্ছন্ন বাংলায় ক্রমাগত কথা বলে গেলেন তিনজন অংশগ্রহণকারী এবং আরজে অথবা কথাবন্ধু। বাংলাকে যদি এভাবে আপন মহিমায় এবং স্বাস্থ্যে তুলে আনতে পারে একটি এফএম রেডিও কেন্দ্র (!), হাতে ইংরেজি স্যালাইনের নল না ঢুকিয়ে অথবা পট্টি না লাগিয়ে, হিন্দির রোজ-পাউডার না ঘষে, তাহলে আমাদের এফএম রেডিও কেন্দ্রগুলো কেন এমন ভাব করে যে বাট-সো-লাইকের পেরেক না ঠুকে দিলে বাংলার কাঠামোটা ভেঙে পড়বে? আর বাংলা ভাষার ভেতরের গান? সে না হয় তোলা থাক আরেক জন্মের জন্য।
অথচ বাংলা ভাষার অবিরাম চর্চা, উৎকর্ষের দিকে তার যাত্রা, তার ভেতরের মনোহর গানটার ক্রমাগত বেজে যাওয়া—সবই সম্ভব হয় এই ভাষার জন্য আমাদের সত্যিকার ভালোবাসাটা জাগাতে পারলে। শুধু বুকভরা ফেব্রুয়ারি-জাত আবেগ নয়, হূদয়ভরা প্রকৃত ভালোবাসা থাকতে হবে, চোখভরা স্বপ্ন থাকতে হবে ভাষাটা নিয়ে।


সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম:
কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

মার্কিন দলিলে ভাষা আন্দোলন- বাঙালির ধূমায়িত অসন্তোষ by মিজানুর রহমান খান

পাঠানেরা ভেবেছে পাঞ্জাবিরা তাদের চেয়ে খাটো। পাঞ্জাবিরা ভেবেছে সিন্ধিরা তাদের চেয়ে খাটো। আর তারা সবাই মিলে ভেবেছে বাঙালিরা সবার চেয়ে খাটো। বাঙালিরা তা বুঝল।
তাদের অসন্তোষ ধূমায়িত হলো। ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি করাচি থেকে ওয়াশিংটনে এমনই এক মূল্যায়ন প্রতিবেদন পাঠিয়েছিল পাকিস্তানের মার্কিন দূতাবাস। তবে আট পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনটিতে ফুটে উঠেছে একটি সমগ্র প্রেক্ষাপট। দ্বিতীয় সচিব চার্লস ডি উইদার্স এটি পাঠিয়েছিলেন তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত অভ্র এম ওয়ারেনের পক্ষে। অনুবাদক এই নথিটির আলোকচিত্র সংগ্রহ করেন যুক্তরাষ্ট্রের
ন্যাশনাল আর্কাইভস থেকে। এর নির্বাচিত অংশের প্রথম কিস্তি ছাপা হলো আজ।

১৯৫২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি। ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন প্রাদেশিকতাবাদের বিপজ্জনক ঝুঁকি সম্পর্কে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। তাঁর কথায়, প্রাদেশিকতাবাদ হলো বাইরে থেকে আসা যেকোনো হুমকির মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর। তাঁর এ বিবৃতি ছিল এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্যের ধারাবাহিকতামাত্র। ২৫ ডিসেম্বর লাহোরে জিন্নাহর জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠান থেকে এ হুমকির বিরুদ্ধে তিনি তাঁর ক্রুসেড (যুদ্ধ) ঘোষণা করেন এবং বলেন, ইসলাম সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধের ওপর দাঁড়ানো। ইসলামের কোনো ভৌগোলিক সীমা নেই। যেকোনো প্রদেশ থেকে যে কেউ আসুক না কেন, তাদের একটাই পরিচয়— পাকিস্তানি।
তাঁর সঙ্গে একই সুরে গলা মিলিয়েছেন গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ, কায়েদে আজমের বোন ফাতেমা জিন্নাহ্ এবং বাণিজ্য ও শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের মতো বিশিষ্ট পাকিস্তানিরা। উপরন্তু অধিকাংশ পাকিস্তানি সংবাদপত্রে এ বিপদ সম্পর্কে সম্পাদকীয় প্রকাশ করা হয়েছে। ইসলামই যে ঐক্যের ভিত্তি, তা সব উপলক্ষে ব্যবহার করা হচ্ছে।
পাকিস্তানে প্রাদেশিকতাবাদের লক্ষণসমূহ বেসামরিক, কূটনৈতিক এবং সশস্ত্র বাহিনীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রাদেশিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার প্রশ্নে সবচেয়ে ভালোভাবে ফুটে উঠেছে। এ ছাড়া প্রদেশগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা, রাজস্ব বণ্টন নিয়ে কলহ, ভাষার প্রশ্ন নিয়ে গোষ্ঠীপরতন্ত্রতা এবং পৃথক প্রতিনিধিত্বের জন্য উদ্বাস্তুদের দাবি। দুর্ভাগ্যবশত প্রায় সহজাতভাবে পাকিস্তানের জনগণ নিজেদের পাকিস্তানি ভাবার পরিবর্তে কেউ বাঙালি, পাঞ্জাবি, সিন্ধি কিংবা অন্য প্রদেশের নাগরিকের পরিচয় দিচ্ছে। নাগরিকদের মধ্যকার এ অনুভূতি প্রায় জন্মগত। এর পেছনে রয়েছে তাদের দেশভাগপূর্ব সাংবিধানিক পটভূমি এবং মুসলিম লীগের আগের নীতিগুলো।
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন দেশভাগপূর্ব সংবিধান হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। এতে ভারতীয়দের নিজেদের বিষয় নিজেদের দ্বারা নিয়ন্ত্রণে অধিকতর এখতিয়ার দেওয়া হয়েছিল। যদিও ওই আইনে একটি ফেডারেল সরকারের অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু মূল বিধানাবলি ছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে। ওই আইনটি ১৯০৯ সালের মার্লে-মিন্টো এবং ১৯১৯ সালের মন্টেগ-চেলমসফোর্ড সংস্কারের নীতির আদলে প্রণীত হয়েছিল। ওই দুটো সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যেই প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল।
১৯৪০ সালের সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনটি বিখ্যাত। এ প্রস্তাবে প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের জন্য নির্দিষ্ট প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত হয়। ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, ‘১৯৩৫ সালের আইনে ফেডারেশনের যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল, সেটা ভারতের অসাধারণ পরিস্থিতি বিবেচনায় সম্পূর্ণরূপে অনুপযুক্ত ও অকার্যকর এবং মুসলিম ভারতের জন্য তা পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য।’
ওই প্রস্তাবে মুসলিম লীগের দৃষ্টিভঙ্গি লিপিবদ্ধ করা হয় যে একটি কার্যকর সংবিধান প্রণয়ন করতে হলে তাতে অবশ্যই ‘ভৌগোলিকভাবে সন্নিহিত ইউনিটগুলোকে অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। এবং সেসব অঞ্চল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলো নিয়ে গঠিত হতে হবে...যেমনটা রয়েছে ভারতের উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্বাঞ্চলীয় এলাকাগুলোতে। এসব অঞ্চলকে “স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহে” রূপ দিতে হবে। এই রাষ্ট্রসমূহের ইউনিটগুলো হবে স্বায়ত্তশাসিত এবং সার্বভৌম...।’ ১৯৪১ সালে মুসলিম লীগের মাদ্রাজ অধিবেশনেও একই দাবি পুনর্ব্যক্ত করা হয়। ১৯৪৯ সালের শেষ দিকে ওই ধারণা আবারও সংশোধিত আকারে উল্লিখিত হয়।
দেশভাগের আগে সরকার এবং মুসলিম লীগের নীতির প্রভাবশালী বিষয়বস্তু ছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন। তাই প্রাদেশিক নেতাদের মধ্যে যাঁরা সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের মূল নেতা ছিলেন, তাঁদের পক্ষে নিজেদের একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন ধারণার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়াটা সবচেয়ে দুরূহ ছিল। দেশভাগের আগে তাঁরা ছিলেন প্রায় সার্বভৌম। অথচ এখন তাঁদের স্বার্থসমূহ ফেডারেল ইউনিয়নের অধীন হিসেবে মেনে নিতে হবে।
প্রাদেশিক স্বাতন্ত্র্যবোধ সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে পূর্ববঙ্গ প্রদেশে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে তাদের অনেক কিছুই আলাদা। খাদ্য, সংস্কৃতি, ভাষা এবং বর্ণ উল্লেখযোগ্যভাবে স্বাধীন পদক্ষেপ গ্রহণে সংবেদনশীল এবং স্বাধীনচেতা বাঙালিদের মানসিকতায় প্রভাব বিস্তার করে। এটা সত্য যে এ প্রদেশে পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৪ শতাংশ বাস করে। করাচি থেকে এর দূরত্ব প্রায় দেড় হাজার মাইল। এবং দুই অংশকে বিভক্ত করে রেখেছে ভারত। তাই কেন্দ্র থেকে একে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।
পাকিস্তানে এমনটা দেখা যায় যে পাঠানেরা ভাবে পাঞ্জাবিরা তাদের চেয়ে খাটো। পাঞ্জাবিরা ভাবে সিন্ধিরা তাদের চেয়ে খাটো। আর তারা সবাই মিলে ভাবে বাঙালিরা সবার চেয়ে খাটো। বাঙালিরা তাদের প্রতি এ অপছন্দ বুঝতে পেরেছে এবং তাই তাদের অসন্তোষ ধূমায়িত হলো। বাঙালিদের অনুভূতি হচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার তাদের স্বার্থ পুরোপুরি রক্ষা করতে পারছে না। ঐতিহাসিকভাবে বাঙালিদের এ অবিশ্বাসের কিছু ভিত্তি রয়েছে। বিখ্যাত উর্দু কবি আল্লামা ইকবাল দ্বিজাতি তত্ত্বের গোড়ার দিককার অন্যতম প্রবক্তা। ১৯৩০ সালে তিনি যখন মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন, তখন তিনি পাকিস্তানের রূপরেখা দিয়েছিলেন। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি রাষ্ট্রে মিলিত হবে আফগানিস্তান, সিন্ধু, পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মানুষ। তাঁর ওই রূপরেখায় বাংলার ঠাঁই হয়নি। যদিও বাংলা ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। এমনকি খোদ মুসলিম লীগের জন্ম হয়েছিল ঢাকায়।
যখন দেশভাগ ঘটল তখন দেখা গেল, ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে বাঙালি মুসলিম সদস্যসংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য। অধিকাংশ জ্যেষ্ঠ হিন্দু বেসামরিক কর্মকর্তা ভারতে যোগ দিলেন। ইংরেজ সদস্যদের অনেকেই অবসর নিলেন, ভারত ছাড়লেন। এবং বাঙালিরা লক্ষ করলেন যে প্রদেশের বাইরে থেকে বেসামরিক কর্মকর্তাদের আমদানি করা হয়েছে। সেই থেকে বাঙালিরা নিষ্ঠাভরে নিজেদের ওই কর্মকর্তাদের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছেন। কারণ, বাঙালির প্রতি ওই কর্মকর্তাদের মনোভাব তাঁদের জানা ছিল। নতুন প্রদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে একই পরিস্থিতি বিরাজ করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাঙালি মুসলিম অধ্যাপকদের অভাব দেখা দেয়। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের (তখন বাঙালি ভিসি ছিলেন সৈয়দ মাহমুদ হোসেন) নেতৃত্বে বাঙালি শিক্ষক এবং প্রদেশের পাঞ্জাবি গভর্নর মালিক ফিরোজ খান নুনের নেতৃত্বাধীন অবাঙালি শিক্ষকদের মধ্যে তিক্ত লড়াই চলছে। বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তানিদের চেয়ে ইউরোপীয় অধ্যাপকদের নিয়োগ করার পক্ষে। এর কারণ স্বল্পমেয়াদি চুক্তিতে ইউরোপীয়দের নিয়োগ দেওয়া যায় এবং তাত্ত্বিকভাবে, প্রশিক্ষিত বাঙালিদের দিয়ে তাঁদের শূন্যস্থান পূরণ করা যায়। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানি অধ্যাপকদের সহজে সরানো যায় না।
পূর্ব বাংলায় প্রাদেশিকতাবাদের বিকাশের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক কালের বেশ কিছু অসামান্য ঘটনা উল্লেখ করার মতো। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রীদের এক সম্মেলনে এমন একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়, যাতে বিক্ষোভ দানা বাঁধে এবং তাকে পাশে সরিয়ে রাখতে সচেষ্ট হন খোদ জিন্নাহ। কিন্তু সেটি আবার সামনে চলে আসে এবং কেন্দ্রীয় নীতির সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত ভবিষ্যতেও সেটা সামনে আসতেই থাকবে এবং এখন এটি আবার সামনে এসেও গেছে। ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হিসেবে পর্যায়ক্রমে উর্দুর প্রচলন করা
হবে। এটা ছিল পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাভাষীদের জন্য একটি অশুভ বিষয়।
ছাত্রদের সামনে রেখে প্রাদেশিকতাবাদীদের জন্য বিষয়টি একটি মোক্ষম পরিস্থিতি তৈরি করে। এ নিয়ে বিক্ষোভ ১৯৪৮ সালের গোড়া অবধি চলতে থাকে। জিন্নাহ ঢাকায় ছাত্রদের শান্ত রাখার চেষ্টা করেছিলেন। জিন্নাহ ব্যক্তিগত আবেদন রেখেছিলেন যে উর্দুই হবে কালক্রমে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। তিনি এ ছাড় অবশ্য দিয়েছিলেন যে বাংলা হতে পারে প্রাদেশিক ভাষা। জিন্নাহ বাঙালিদের হুঁশিয়ার করে দেন যে প্রাদেশিকতাবাদ হচ্ছে ‘রাষ্ট্রদেহে বিষ সমতুল্য’ এবং এটা পাকিস্তানের জন্য অভিশাপ হতে পারে।

মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

অভিনব প্রতিবাদে খারাপ ছবির তালিকা শীর্ষে গুন্ডে

যশরাজ ফিল্মসের ‘গুন্ডে’ ছবিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননা করার পাশাপাশি ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগে সমালোচনার ঝড় উঠেছে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ও ব্লগে। পাশাপাশি আইএমডিবি সাইটে কড়া মন্তব্য করে রিভিউ লিখেছেন অসংখ্য মানুষ।
শুধু তা-ই নয়, এই মুহূর্তে আইএমডিবি রেটিংয়ে সর্বনিম্ন পয়েন্ট ‘গুন্ডে’ ছবির দখলে। মাত্র ১.৪ পয়েন্ট পেয়ে আইএমডিবি বটম হান্ড্রেড চার্টের এক নম্বরে অবস্থান করছে ‘গুন্ডে’ ছবিটি। ২ ও ৩ নম্বরে রয়েছে হলিউডের দুই ছবি ‘ফাইনাল জাস্টিস’ (১৯৮৫) ও ‘দ্য হটি অ্যান্ড দ্য নটি’ (২০০৮)।

আইএমডিবি সাইটে ঢাকা থেকে অনীক তাঁর ‘বাংলাদেশের ইতিহাস পরিবর্তনের পাঁয়তারা’ শিরোনামের রিভিউয়ে লিখেছেন, ‘এটা খুবই নিম্নমানের একটি চলচ্চিত্র যেখানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ভুলভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ হয়নি। পাকিস্তান থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য স্বাধীনতাযুদ্ধ করেছিল বাংলাদেশের আপামর জনগণ। এই যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী সাহায্য করেছিল। কিন্তু মূল যুদ্ধটা করেছিল বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধারা। আমি ভেবে পাই না, বলিউডে কীভাবে এমন জঘন্য একটি ছবি নির্মিত হলো! এমন বাজে একটি ছবি দেখে সবাইকে সময় নষ্ট না করার পরামর্শ রইল আমার পক্ষ থেকে।’

কানাডা থেকে তানভীর লিখেছেন, ‘ছবিটির মাধ্যমে মিথ্যা ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে দর্শককে ভুল পথে পরিচালনা করবে। এমন বড় বাজেটের একটি ছবিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে যেভাবে বিকৃত করা হয়েছে, তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। ছবিটির পরিচালকের প্রতি আমার অনুরোধ, ভবিষ্যতে কোনো ছবি নির্মাণের আগে সতর্কতার সঙ্গে ইতিহাস পড়ে নেবেন। আর তা সম্ভব না হলে কমেডি ঘরানার ছবি তৈরি করবেন।’

নিউইয়র্ক থেকে ভিকি লিখেছেন, ‘ছবিটির গল্প খুবই অশোভনভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষদের এক অর্থে আক্রমণই করা হয়েছে। ১৯৭১ সালে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল। কোনোভাবেই সেটাকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বলা যাবে না। যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী সহায়তা করেছিল মাত্র। এর বাইরে আর কিছুই না। নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছিল এদেশের মুক্তিযোদ্ধারা। স্বাধীন দেশের অভ্যুদয়ের পুরো কৃতিত্বটাই তাদের। অথচ ‘গুন্ডে’ ছবির মাধ্যমে ভারতীয় সেনাবাহিনীকেই পুরো কৃতিত্ব দেওয়ার হীন চেষ্টা চালিয়েছে যশরাজ ফিল্মস। এমন অসত্য তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ছবি তৈরির বিষয়টি খুবই অপ্রত্যাশিত। ছবির নির্মাতাদের ধিক্কার জানানোর ভাষাও হারিয়ে ফেলেছি আমি।’

যুক্তরাজ্য থেকে আকাশ শ্রীবাস্তব লিখেছেন, ‘রোম্যান্স, ব্রোম্যান্স, আর চটুল গানের মিশেলে এক জগাখিচুড়ি তৈরি করেছেন ‘‘গুন্ডে’’ ছবির পরিচালক। ছবিটির প্রথম আধা ঘণ্টা দেখার পর যেকোনো দর্শকই ধরতে পারবেন যে এর চিত্রনাট্য খুবই দুর্বল। সংলাপগুলোও জঘন্য। প্রিয়াঙ্কা চোপড়া ছাড়া ছবিটিতে দেখার মতো আর কিছুই নেই। ছবিটি দেখার মানে সময় এবং অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছুই না।’

এমন আরও অসংখ্য নেতিবাচক রিভিউ লিখেছেন ক্ষুব্ধ দর্শকেরা। বলা যায়, এর মধ্য দিয়ে অসত্যের বিরুদ্ধে এক অভিনব প্রতিবাদের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তাঁরা।  

প্রসঙ্গত, যশরাজ ফিল্মসের ‘গুন্ডে’ ছবিটি বলিউডে মুক্তি পেয়েছে ১৪ ফেব্রুয়ারি। একই দিন কলকাতায়ও বাংলা ভাষায় ছবিটি মুক্তি দেওয়া হয়েছে। আলী আব্বাস জাফর পরিচালিত ছবিটির বাজেট ছিল ৫০ কোটি রুপি। এর বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, রণবীর সিং, অর্জুন কাপুর, ইরফান খান প্রমুখ।

মুক্তির পরপরই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননা করার পাশাপাশি ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ ওঠে ছবিটির বিরুদ্ধে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি ক্ষমাও চাওয়া হয়েছে যশরাজ ফিল্মসের পক্ষ থেকে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশি নাগরিকদের উদ্দেশে যশরাজ ফিল্মসের অফিসিয়াল ফেবসুক পাতায় লেখা এক বার্তায় বলা হয়েছে, ‘প্রিয় বন্ধুরা, আমাদের ছবিতে যেভাবে গল্প তুলে ধরা হয়েছে তাতে বাংলাদেশের অনেক ভাই তাঁদের আপত্তির কথা জানিয়েছেন। ছবিটির কাহিনি ও গল্প পুরোপুরি কাল্পনিক। কোনো জাতি, সমাজের বিশেষ কোনো গোত্র কিংবা কোনো ব্যক্তির প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শনের অভিপ্রায় আমাদের ছিল না। তার পরও বাংলাদেশি ভাইরা যদি আমাদের কাজ দেখে আহত হন কিংবা অশ্রদ্ধা প্রকাশ করা হয়েছে বলে মনে করেন, তাহলে আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করছি আমরা।’

‘গুন্ডে’ ছবিটির শুরুর দিকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ভিডিও চিত্র দেখানোর পাশাপাশি হিন্দি ভাষায় বলা হয়, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ হিন্দুস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে তৃতীয় যুদ্ধ শেষ হয়। ৯০ হাজার পাকিস্তানি সেনা হিন্দুস্তানের সেনাদের সামনে আত্মসমর্পণ করেন। জন্ম হয় এক নতুন দেশ, বাংলাদেশ। ছবিটির শুরুর দৃশ্যে দেখানো হয়, ভারতীয় যোদ্ধাদের সামনে আত্মসমর্পণ করছেন পাকিস্তানি সেনারা।  আর জন্ম হচ্ছে বাংলাদেশের। পেছনে দেখা যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর পোস্টার।

‘গুন্ডে’ ছবিতে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ফুটেজ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখানো হলেও কোথাও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা হয়নি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ও ব্লগে সমালোচনার ঝড় ওঠে। অনেকেই অভিযোগ করেন, ছবিটির মাধ্যমে বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল মহান মুক্তিযুদ্ধকে হেয় করা হয়েছে।

 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. XNews2X - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু