তাঁর রূপের যেমন তুলনা নেই, তেমন নেই  রহস্যের অন্ত। কি তাঁর আসল নামধাম পরিচয়- কিছুই বলা যায় না নিশ্চিত করে।  নিজেকে নিজেই বদলে, আড়াল করে চলেছেন জীবনভর। আর কি বিচিত্র সে জীবন!
কত  ঘটনায়, কত কীর্তিতে যে ধাঁধানো সে বিস্ময়। কেউ বলেন, এই রূপসী রহস্যময়ীর  নাম এডিথ অথবা ইথেল মড শিরান। পরে কোন কারণে এ নাম বদলে রাখেন  এলিসা-মারিয়া। নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে কখনও বলেছেন তাঁর জন্ম ১৯০৪ সালে  বালটিক অঞ্চলে, কখনও বলেছেন বেলজিয়ামে, আবার বলেছেন স্কটল্যান্ডে।  ফিনল্যান্ডের জেনারেল মানারহাইম-এর অবৈধ কন্যা বলেও পরিচয় দিয়েছেন তিনি।  উত্তরসূরি দাবিদার দু’জন জানিয়েছেন, তাঁর জন্ম স্কটল্যান্ডের পার্থশায়ারের  ডুনুন-এ। তবে তিনি বড় হয়েছেন এডিনবার্গে। সেখানকার স্কেরি’স সিভিল সারভিস  কলেজ থেকে স্নাতক হয়েছেন ১৯২২ সালে। ইথেল দাবি করেছিলেন, এডিনবার্গ  বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছেন তিনি; তবে তাঁর বংশধরেরা  সেখানে খুঁজে কোন প্রমাণ পান নি এ দাবির পক্ষে। দুই মহাদেশের বিচিত্র সব  অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছেন ইথেল। প্যারিস থেকে আঙ্কারা, কলকাতা থেকে  ইয়াঙ্গুন... আরও কত সব শহরে-জনপদে। এলিসা-মারিয়া নাম ধারণ করে সাংবাদিকতা  করেছেন ফরাসি পত্রিকায়, ওই সূত্রে পরিচিত হয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট  মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক (১৮৮১-১৯৩৮)-এর সঙ্গে, থেকেছেন রাজধানী আঙ্কারায়  তাঁর প্রাসাদে। গিয়েছেন মিয়ানমারের রাজধানী ইয়াঙ্গুনে, নিকটবর্তী ইনসেইন-এ  বাস করেছেন ইংরেজ ঔপন্যাসিক জর্জ অরওয়েল (এরিক আরথার ব্লেয়ার,  ১৯০৩-১৯৫০)-এর সঙ্গে। সম্ভবত ছদ্মনাম ধারণে অভ্যস্ত ইথেলের প্রভাবেই ছদ্ম  লেখক-নাম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন এরিক। অনেক পরিক্রমার এক পর্যায়ে ইথেল  পৌঁছেছেন কলকাতায়, পুলিশ কর্মকর্তা বারট্রাম ল্যাংফোর্ড-রি’র পত্নী হিসেবে।  দু’বার হয়েছে তাঁদের বিয়ে। একবার এডিনবার্গে ১৯২৩ সালে, আরেকবার  মিয়ানমারের মান্দালয়ে ১৯২৪ সালে। পরে থেরবাদী বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন  এলিসা-মারিয়া ল্যাংফোর্ড-রি। দীক্ষা নেন ত্রিরত্ন বুড্ডিস্ট কমিউনিটি’র  প্রতিষ্ঠাতা সংঘরক্ষিত (ডেনিস ফিলিপ এডওয়ার্ড লিংউড)-এর কাছে। ইথেল বা  এলিসা’র তৃতীয় বিয়ে সিকিমের রাজনীতিক কাজি লেনদুপ দোরজি খাংসর্প  (১৯০৪-২০০৭)-এর সঙ্গে। বিয়ের পর তিনি পরিচিতি পান ‘কাজিনি সাহিবা’ নামে।  তাঁর পুরো নাম হয় ‘কাজিনি এলিসা-মারিয়া ল্যাংফোর্ড-রি দোরজি খাংসর্প অভ  চাকুং’। বিয়ের পর স্বামীকে তিনি সহজেই নিয়েছিলেন হাতের মুঠোয়। তাঁর বুদ্ধি  পরামর্শ উপদেশ মেনেই চলতে হতো দোরজিকে। সিকিমের লোক দোরজিকে জানতো ধূর্ত  রাজনীতিক হিসেবে, কিন্তু কাজিনি ছিলেন তাঁর চেয়ে শত গুণ ধূর্ত। কিছু দিন  আগে বেগম খালেদা জিয়া এই লেনদুপ দোরজির নামই উল্লেখ করেছিলেন এক বক্তৃতায়।  স্বাধীন রাজ্য সিকিমের সার্বভৌমত্ব হারিয়ে ভারতের অঙ্গীভূত হওয়ার কলকাঠি  নেড়েছিলেন এই দোরজি দম্পতিই। এই ঘটনা ‘সিকিমাইজেশন’ নামে পরিচিত রাজনৈতিক  ইতিহাসে। বর্তমানে নেপালের রাজনীতিতে কথাটি বহুল উচ্চারিত। ১৯৪৭ সালে ভারতে  যোগ দেয়ার পক্ষে-বিপক্ষে গণভোট হয় সিকিমে। তখন বেশি ভোট পড়ে যোগ দেয়ার  বিপক্ষে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু সম্মত হন সিকিমকে আশ্রিত  রাজ্যের মর্যাদা দিতে। এ অবস্থায় সিকিম আসে ভারতের অধিরাজত্বের নিয়ন্ত্রণে।  সিকিমের প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসন বজায় থাকলেও বৈদেশিক সম্পর্ক, প্রতিরক্ষা,  কূটনীতি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা যায় ভারতের অধীনে। ১৯৫৩ সালে সাংবিধানিক সরকার  প্রতিষ্ঠার পক্ষে গঠিত হয় রাজ্য পর্ষদ। কিন্তু সিকিম জাতীয় কংগ্রেস দল  দাবি করে নতুন নির্বাচন, সেই সঙ্গে সিকিমে নেপালি জনগোষ্ঠীর অধিকতর  প্রতিনিধিত্ব। ১৯৭৩ সালে সিকিমের চোগিয়াল (রাজা) পালদেন থোনদুপ নামগিয়াল  (১৯২৩-১৯৮২)-এর প্রাসাদের সামনেই শুরু হয় ভয়াবহ জাতিগত দাঙ্গা। তখন  আনুষ্ঠানিক ভাবে চোগিয়াল সাহায্য প্রার্থনা করেন ভারতের। ১৯৭৫ সালে  প্রধানমন্ত্রী কাজি লেনদুপ দোরজি খাংসর্প ভারতীয় পারলিয়ামেন্টে আবেদন  জানান, সিকিমকে ভারতের রাজ্য করা হোক। ওই বছরের এপ্রিল মাসে ভারতীয়  সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ নেয় রাজধানী গ্যাংটকের, নিরস্ত্র করে চোগিয়ালের  প্রাসাদরক্ষীদের। এরপর গণভোটের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটানো হয় সিকিমে,  আর অনুমোদিত হয় ভারতে যোগদান। ভারত সরকার এ যোগদানকে জনগণের ইচ্ছার  প্রতিফলন হিসেবে তুলে ধরলেও দেশে-বিদেশে এর বিরূপ সমালোচনা হয়েছে  ব্যাপকভাবে। অভিযোগ করা হয়েছে, সিকিমে জাতিগত বিভাজনের সুযোগ নিয়েছে ভারত,  গণভোটেও করেছে ব্যাপক জালিয়াতি। সিকিমাইজেশনের প্রত্যক্ষ বিবরণ রয়েছে  প্রখ্যাত সাংবাদিক সুনন্দ কে. দত্ত-রায়ের ‘স্ম্যাশ অ্যান্ড গ্র্যাব: দি  এনেক্সেশন অভ সিকিম’ (বিকাশ, নয়া দিল্লি, ১৯৮৪) বইটিতে। সেখানে রয়েছে রূপসী  রহস্যময়ী রমণী কাজিনি সাহিবারও অন্তরঙ্গ বৃত্তান্ত। বইটির নতুন  ট্রাঙ্কিউবার সংস্করণ প্রকাশের পথে বলে জানা গেছে।  


 
 
 
0 comments:
Post a Comment