Home » , » অর্থনীতি সামাল দিতে পারছে না সরকার by শওকত হোসেন ও মনজুর আহমেদ

অর্থনীতি সামাল দিতে পারছে না সরকার by শওকত হোসেন ও মনজুর আহমেদ

Written By Unknown on Wednesday, September 21, 2011 | 8:30 AM

হা দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে মূল্যস্ফীতি। পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না সরকার। বরং দাতাদের শর্ত মেনে সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির হার নিয়ে সরকার সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
এতে সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা নিয়ে তৈরি চাপ কিছু কমলেও সংকট বাড়বে সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষের। কারণ, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোয় মূল্যস্ফীতির চাপ আরেক দফা বাড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে।

অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন, ইতিমধ্যেই মূল্যস্ফীতির একটি দুষ্টচক্রে ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশ। শিগগির এখান থেকে বের হওয়া সম্ভব হবে না। এ পরিস্থিতিতে আগামী দিনে সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় সমস্যা থেকেই যাবে।
সম্পদ কোথা থেকে আসবে, তা বিবেচনা না করেই বিভিন্ন ধরনের প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় সংকট তৈরি হয়েছে। দ্রুত বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান, কম দামে সেচসুবিধা ও সার প্রদান, মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে বাঁচাতে কম মূল্যে চাল বিতরণ এবং বর্তমান মেয়াদেই পদ্মা সেতুর কাজ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সরকার। এতে ব্যয় বেড়েছে অনেক। কিন্তু এখন ব্যয় ব্যবস্থাপনা করতে পারছে না সরকার।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণ করতেই মূলত সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার। মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত দিয়েই ওই রাতেই অর্থমন্ত্রী বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বার্ষিক সভায় যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন। আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল ১৪ সেপ্টেম্বর জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোসহ কয়েক দফা সুপারিশসংবলিত একটি প্রতিবেদন সরকারকে দিয়েছে। আর সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে ১৮ সেপ্টেম্বর।
এই পরিস্থিতিতে আইএমএফ আবারও মুদ্রা সরবরাহ কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছে। আইএমএফ মনে করে, এতে মূল্যস্ফীতির চাপ কমবে। তবে অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি এখন যে পর্যায়ে চলে গেছে তাতে ব্যয় বৃদ্ধির কারণে না চাহিদা বাড়ার কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, তা আর এভাবে পৃথক করা যাবে না। কেননা, একটা পর্যায়ে উঠে গেলে এটা আর আলাদা করা যায় না। ফলে আমরা একটা দুষ্টচক্রের মধ্যে ঢুকে পড়েছি বলা যায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী অর্ধবার্ষিক ভিত্তিতে বাজেট পর্যালোচনার কথা বলেছেন। কিন্তু আমার মনে হয় পর্যালোচনার সময়টা আরও একটু এগিয়ে এনে ব্যয় সাশ্রয়ের সময় এসেছে।’
অর্থবছরের শুরুতেই সংকট: নতুন অর্থবছরের মাত্র তিন মাসের মধ্যেই সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সংকট দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন খাতে দেওয়া ভর্তুকির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় আয়-ব্যয়ে তৈরি হচ্ছিল ভারসাম্যহীনতা। রাজস্ব আদায় এবং রপ্তানি আয় বাড়লেও সে তুলনায় সরকারের ব্যয়ের পরিমাণ বেশি। এতে এক দিকে সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ কমছে, ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেওয়াও বেড়েছে। সব মিলিয়ে চাপের মধ্যে আছে সরকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম এ তসলিম বলেন, ‘আমরা অনেক দিন ধরেই বলে আসছিলাম যে, সরকারের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ঝামেলা আছে। কিন্তু সরকার এটা আমলে নেয়নি। উপরন্তু অনেকগুলো কাজ একসঙ্গে নিয়েছে। এতে একটা লেজেগোবরে অবস্থা হয়েছে।’
রাজস্ব আয়ের চেষ্টায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) অনেকখানি অগ্রসর হয়েছে। কিন্তু ঘাটতি মেটাতে তা পর্যাপ্ত নয়। ফলে সম্পদের জোগান পেতে ঋণ করার বিকল্প নেই। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণ আগের অর্থবছরেই ৩০ শতাংশ কম হয়েছে। পদ্মা সেতুর কাজ করার আগেই দুর্নীতির অভিযোগসহ টানাপোড়েনের কারণে এবারও পর্যাপ্ত বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে রয়েছে। ফলে ভরসা এখন অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ। এর মধ্যে সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে সরকারের ঋণ ততটা সফল হয়নি। ফলে সরকার ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিচ্ছে। এতে বেসরকারি খাতের সঙ্গে সরকারের প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। সরকার বেশি ঋণ করায় বেসরকারি খাতের ঋণের জোগান কমে সুদের হার বেড়ে যাচ্ছে।
অধ্যাপক এম এ তসলিম বলেন, ‘অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথা উঠলেই সরকার খালি বলে প্রবৃদ্ধি তো ভালো হচ্ছে। কিন্তু জিডিপির প্রবৃদ্ধি একটা উপাদান মাত্র। আর এই প্রবৃদ্ধিকে টেকসই করতে হবে। এ জন্য পরিকল্পনা করে বছর ভিত্তিতে অর্জন ধরে রাখতে হবে। ঋণের টাকায় এই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা কতটা সম্ভব, তা সামনের দিনগুলোতে বোঝা যাবে।’
শুরুতেই ব্যাংকঋণ: বড় অঙ্কের ধার দিয়েই বছরটি শুরু হয়েছে সরকারের। সূত্র জানায়, গত ২১ আগস্ট পর্যন্ত সরকার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ করেছে পাঁচ হাজার ২২৪ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকার নিয়েছে দুই হাজার ৮৬৬ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। আর তফসিলি ব্যাংকগুলো থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ড বিক্রি করে তুলে দিয়েছে দুই হাজার ৩৫৮ কোটি ২৩ লাখ টাকা।
বলা হয়, তফসিলি ব্যাংক থেকে সরকার বেশি ঋণ করলে বেসরকারি খাতের ঋণ পাওয়ার সুযোগ কমে আসে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ করলে, যদি বাংলাদেশ ব্যাংক পরবর্তী সময়ে তফসিলি ব্যাংকের কাছ থেকে তা তুলে নিতে না পারে তবে বাজারে নতুন টাকার সরবরাহ বেড়ে যায়। আর এতে বাড়ে দ্রব্যমূল্য, চাপ বাড়ে মূল্যস্ফীতিতে।
২০১০-১১ অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে সরকার ঋণ করেছিল প্রায় ২০ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, যা একটি নতুন রেকর্ড। এই ঋণের প্রায় অর্ধেকটা নেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন টাকা ছেপে সরকারের এই চাহিদা মিটিয়েছে।
সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি: নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ছিল দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। অথচ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবমতে, গত আগস্ট মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১১ দশমিক ২৯ শতাংশ। গত ৪৩ মাসের মধ্যে এটাই সর্বোচ্চ। এর আগে ২০০৮ সালের জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৪৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। অর্থাৎ বর্তমান সরকারের সময়ে এটাই সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি।
দুই বছর ধরেই মূল্যস্ফীতির চাপ রয়ে গেছে। সরকারও মূল্যস্ফীতির হার কমাতে ব্যর্থ হয়ে মূল্যস্ফীতিকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অধ্যাপক এম এ তসলিম বলেন, এর ক্ষতিকারক দিকও আছে। ব্যবসায়ীরা যখন বুঝে নেবেন যে বছর বছর এটা চলবে, তখন তাঁরা তাঁদের পণ্যমূল্যের মধ্যে আগেভাগেই নতুন মূল্যস্ফীতিকে হিসাব করে নেবেন। এতে মূল্য পরিস্থিতিতে নতুন মাত্রা যোগ হবে।
এদিকে, ভর্তুকি সমন্বয়ে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রভাবে আরেক দফা বাড়বে মূল্যস্ফীতি। মূল্যবৃদ্ধি ইতিমধ্যেই ভোক্তা মূল্যসূচকে গিয়ে যুক্ত হচ্ছে। আবার এর প্রভাব পড়বে উৎপাদনে। পরিবহন ব্যয় বেড়ে চাপ আরও বাড়াবে।
এম এ তসলিম বলেন, ‘এই অবস্থা কারও জন্যই ভালো হবে না। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের যে অবস্থা তাতে রাজনৈতিক বিবেচনা উপেক্ষা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শক্ত হাতে মুদ্রা ব্যবস্থাপনা করে মূল্যস্তরকে সামাল দিতে পারবে, আমি তা মনে করি না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আগামী এক-দুই বছরের মধ্যে এ পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসার কোনো পথ আমি দেখছি না। ফলে আগামী দিনে সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় সমস্যা থেকেই যাবে।’
লেনদেনের ভারসাম্যেও চাপ: চলতি অর্থবছরে এরই মধ্যে ৯০ কোটি ডলারের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এটা আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ কমা শুরু হয়েছে। বর্তমান মজুদ দিয়ে মাত্র দুই মাসের কিছুদিন বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। এবার রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ৩০ থেকে ৩২ শতাংশ এবং আমদানি ব্যয়ে প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশের কাছাকাছি হলে বাণিজ্য ঘাটতি থাকবেই। এর মধ্যে বৈদেশিক সাহায্য ও প্রবাসী-আয়ে ভালো প্রবৃদ্ধি হবে বলে অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন না। এ রকম বাস্তবতায় বিনিময় হারও বাড়বে। এক বছর আগে, অর্থাৎ ২০১০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর টাকা-ডলারের গড় বিনিময়মূল্য ছিল ৬৯ টাকা ৫৮ পয়সা। আর এখন তা ৭৪ টাকা ৫৫ পয়সা। অর্থাৎ এবারও বেশি দাম দিয়েই পণ্য আমদানি করতে হবে। আর এর চাপ পড়বে আবারও মূল্যস্ফীতিতে।

0 comments:

Post a Comment

 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. XNews2X - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু