Home » , , » মোহনা by হরিশংকর জলদাস

মোহনা by হরিশংকর জলদাস

Written By Unknown on Saturday, February 5, 2011 | 12:44 AM

কালিন্দীর যে-তীরে ডমরনগর, সে-তীরে বারাঙ্গনাপল্লী। এই পল্লী নগরীর বাইরে, বাজারের পাশে। ও-পাড়ের মাঝিরা যে-ঘাটে নৌকা ভিড়ায়, তার থেকে সামান্য পশ্চিমে বারাঙ্গনাপল্লীটি। জোয়ার ভাটার নদী কালিন্দী। ভাটায় জল নেমে গেলে চর ভেসে ওঠে। বারাঙ্গনাপল্লী থেকে দু’কদম হাঁটলেই নদীপাড়।

ওখান থেকে ঢালু হয়েছে ভূমি। বারাঙ্গনারা সকালে একবার, সন্ধেয় আরবার গা-গতর ধুতে যায় নদীজলে। পুরুষ-বর্জ্য শরীর থেকে সাফ করতে হয় যে তাদের। রাতে দিনে অতিথি আসে বারাঙ্গনাগৃহে। শরীর-ক্ষুধার তো কোনো রাত দিন নেই। মাহুত, মশালচি, সৈন্য, চারণকবি, টিকিনাড়া ব্রাহ্মণ, বাজারিয়া, হাটুরিয়া সবাই আসে ক্ষুধা মিটাতে। আর আসে ভীমের একজন সেনানায়ক, চণ্ডক তার নাম। মোহনার কাছে আসে সে। নদী-সমুদ্রের মিলনস্থল মোহনা। মিষ্টি আর নোনা জলে মাখামাখি, লুটোপুটি। নদী সমুদ্রকে আর সমুদ্র নদীকে পেয়ে তৃপ্ত। মোহনার কাছে এলেই চণ্ডকের তৃপ্তি। মোহনা তার নদী।
বারাঙ্গনাপল্লীটি তত বড় নয়, তবে এর মাঝখানে বিশাল চত্বর। চত্বরের চতুর্দিকে সারি সারি ঘর, মাটির দেয়াল। ঘরগুলো উঁচু উঁচু, প্রশস্ত আঙিনা। সেই আঙিনায় অতিথিদের বসার ব্যবস্থা। মিলনের স্থান ভিতরে। ভিতরটা নয়নাভিরাম। একদিকে বিশাল খাট, চারদিকে অগুরু চন্দনের সুবাস। একটু দূরে তাকিয়ার ওপর গুবাক-তাম্বুলের বাটা। অতিথিকে গুবাক-তাম্বুলে আপ্যায়নের রেওয়াজ আছে।
এই বারাঙ্গনাপল্লীর প্রধানা জানকি। জানকি একদা এই পল্লীরই বারাঙ্গনা ছিল। এখন প্রৌঢ়া জানকি ত্রিশ-চল্লিশ জন যৌবনবতী বারাঙ্গনার দেখাশোনা করে। তাদের নিরাপত্তার দিকেও নজর তার। পল্লীর চারদিকে সুউচ্চ মাটির পাঁচিল। দক্ষিণ দিকে প্রবেশদ্বার। ওই দ্বার দিয়েই আসা যাওয়া। পাঁচিল ডিঙানোর উপায় নেই।
শুধু ডমরনগরে নয়, আরও বিশাল বিশাল নগরীতে বাররামাদের আবাসস্থল। গৌড়, চম্পকনগর, মগধ, বৈশালী—এসব নগরে চিরায়ুষ্মতীরা বাস করে। তারা নগরীর শোভা। গঙ্গা-করতোয়া-কালিন্দী-সংলগ্ন ভূমিতে বারাঙ্গনারা বহু বহু প্রাচীনকাল থেকে কামলোভীদের তৃপ্তি দিয়ে আসছে। সমাজে তারা আদরণীয়। বাররামারাও তা জানে। ডমরনগরের বারাঙ্গনাপল্লীর মেয়েরা জানে যে, তারা ভোগের, ভোগের পর ছুড়ে ফেলারও। মোহনা, কুন্তি, সুবর্ণা, দময়ন্তী, অঙ্গনা, মেনকারা এও জানে যে, সমাজে তাদের কদর ওইটুকু সময় পর্যন্ত, যতদিন তাদের গতরে যৌবন আছে। তাই তারা স্তনের পরিচর্যা করে, অধরের পরিচর্যা করে। শরীরের ভাঁজে ভাঁজে মহুল মদ গরম করে ডলে। উষ্ণ মদে গতরের ব্যথা সারে। দীর্ঘ সময় মদের গন্ধ লেগে থাকে শরীরে। ওই গন্ধে গ্রাহকের দেহমন আনচান করে।
বারাঙ্গনাপল্লীর দুয়ারে দুয়ারে দীপাধার হাতে দাঁড়িয়ে থাকে চিরায়ুষ্মতীরা। তাম্বুল চর্চিত অধর তাদের। বারাঙ্গনাদের সন্তান হতে নেই। তবু হয়। কন্যাসন্তানেই সুখ তাদের। বিগতযৌবনে এই কন্যাই মূলধন। ডমরনগরের বারাঙ্গনাপল্লীতে এই পেশায় প্রথম যেদিন হাতেখড়ি হয়, সেদিন সকালে নাপিতানী এসে নখ খুঁটে দিয়ে যায়। মেয়েটির মাথায় ঘষে ঘষে সুবাসিত তেল মাখানো হয়। নদীতে স্নান করানো হয়। নতুন কাপড় আলতা কাজল পরিয়ে ধানদূর্বা দেয়া হয় তার মাথায়। ওর হাত ধরে লক্ষ্মী ঢুকবে যে এই বারাঙ্গনাপল্লীতে।
মোহনার স্পষ্ট মনে আছে—এই বৃত্তিতে ব্রতী হবার প্রথম দিনের কথা। সদ্য রজস্বলা হয়েছে সে। বামুনঠাকুর এসে গোধূলি লগ্নে একটি বঁটির সঙ্গে বিয়ে দিল তার। সিঁথিতে চিকন করে সিঁদুর দিল, গলায় ঝুলাল গাঁদাফুলের মালা। রাতের অতিথি ফুলমালা ছিঁড়তে বড় ভালোবাসে। অতিথি জানে—এ মালা শুধু মালা নয়, মেয়েটির অক্ষতযোনীর প্রমাণও। অক্ষতযোনীতে যুবা প্রৌঢ় বৃদ্ধ কার না আগ্রহ!
জানকির কাছ থেকে মোহনার কুমারিত্ব কিনে নিয়েছিল চণ্ডক। উচ্চ মূল্যে। সেরাতে আধা পন কড়ি দিয়ে মোহনার ঘরে ঢুকেছিল চণ্ডক।
বঁটির সঙ্গে বিয়ের পর থেকে ভাবনায় পড়েছিল মোহনা। বিয়েই যদি, বঁটির সঙ্গে কেন? জিজ্ঞেস করেছিল জানকিকে, ‘লোহার সাথে বিয়া কেনে, মানুষের সাথে নয় কেনে?’
জানকি বলেছিল, ‘এই পাড়ার অক্ষতযোনীদের গাছ বা লোহার সাথে বিয়া দেওয়ার নিয়ম। গাছ ত অমর, লোহার ক্ষয় নাই। এক গাছ মরল ত, তার বীজ থেকে আরেক গাছ জন্মাল, গাছ চিরায়ু, লোহা অক্ষয়। বারবধূরাও চিরায়ুষ্মতী। এক মোহনা গেলে, আরেক কাঞ্চনা আসে। জায়গা খালি থাকে না। তাই অমর জিনিসের সাথে মোদের বিয়া হয়। তোহারও হয়েছে।’
সেই থেকে বঁটিটিকে কাছে কাছে রাখে মোহনা। ভাবে—ওই-ই ত মোর স্বামী।
মোহনা উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা। জালিকদের ঘরে ফর্সা রঙের নারী নেই। মোহনার চুল কোঁকড়ানো। কোঁকড়া চুল খুব বেশি লম্বা হয় না। কিন্তু বিপুল হয়। মাথাভর্তি চুল মোহনার। চিপচিপে শরীর। চোখেমুখে এখনো গ্রামজীবনের শৈশব লেপ্টে আছে। কালিন্দী এগিয়ে যেতে যেতে যেতে যেখানে বাঁক নিয়েছে, সেই বাঁকে জেলেপল্লী। সেই পল্লীর নাম গাঙ্গী। সেই গাঙ্গী থেকে তিন বছরের মোহনাকে চুরি করে এনেছিল সনকা। কিনে নিয়েছিল জানকি। তারপর লালন-পালন। তারপর চ্লকের ডুবসাঁতার, মোহনায়। মদিরারক্তিম চোখে চণ্ডক মোহনার ঘরে ঢুকেছিল সেরাতে। মোহনার গলার মালায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেছিল, ‘এই মালা আমার, এই মোহনা আমার। এর ঘরে আর কাউরে ঢুকতে দিও না।’ [অংশ]

0 comments:

Post a Comment

 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. XNews2X - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু