Home » , , , » রাষ্ট্রের হত্যাকাণ্ডের নাম ক্রসফায়ার!

রাষ্ট্রের হত্যাকাণ্ডের নাম ক্রসফায়ার!

Written By Unknown on Wednesday, February 2, 2011 | 12:42 AM

ত পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা পাল্টা গুলি চালায়। এ সময়...পলায়নকালে তিনি ক্রসফায়ারে পড়ে নিহত হন। ফাঁকা জায়গাগুলোতে কারো নাম পূরণ করে নিন, তাহলে দেখবেন সংবাদপত্রে ছাপানো কোনো ক্রসফায়ারের সংবাদের সঙ্গে মিলে যাবে। এই গল্প শুনতে শুনতে পাঠক ক্লান্ত হয়ে গেছেন। নতুন কোনো গল্পও নেই।
অভিযোগ উঠেছে বিশেষ ধারার রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের হত্যা করার জন্যই ক্রসফায়ারের আবির্ভাব হয়েছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র জন্মের অল্প কিছুদিনের মাথায় শুরু হয় ক্রসফায়ার নামের হত্যাকাণ্ড, তাও আবার দেশের অন্যতম রাজনৈতিক নেতা সিরাজ সিকদারকে দিয়ে। কিন্তু রাষ্ট্রের পবিত্র সংবিধান অনুযায়ী আত্মপক্ষ সমর্থন করা প্রত্যেক মানুষের মৌলিক অধিকার। বিশ্লেষকরাও বলছেন তাই। বিশেষ ধারার সশস্ত্র কমিউনিস্টরা ক্রসফায়ারের বলি হয়েছেন মুজিব আমল থেকেই। সেই যাত্রা খালেদা-নিজামী পার হয়ে মহাজোট সরকারের আমলেও অব্যাহত রয়েছে। এই  বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ...

ঘটনা-১
১৯৭৫ সালের ইংরেজি নববর্ষের প্রথম দিন বুধবার। পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সভাপতি সিরাজ সিকদার চট্টগ্রাম থেকে গোয়েন্দা বিভাগের একদল সাদা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। এরপর জরুরিভাবে ওই দিন রাতেই তাঁকে ঢাকায় আনা হয়। তারপর কিছু জানা যায়নি। শুধু ৩ জানুয়ারি ১৯৭৫ সালের পত্রিকায় একটি সরকারি প্রেসনোট দেখে দেশবাসী হতবুদ্ধি হয়ে যান। যেখানে লেখা থাকে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সভাপতি সিরাজুল হক সিকদার ওরফে সিরাজ সিকদারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাভারে নিয়ে যাওয়ার সময় ওত পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা পুলিশের ওপর গুলি চালায়। পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। এ সময় সিরাজ সিকদার পালানোর চেষ্টা করেন। উভয়পক্ষের গোলাগুলিতে সিরাজ সিকদার নিহত হন।
কেউ কোনো প্রশ্ন করলেন না, গভীর রাতে সিরাজ সিকদারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কেন সাভারে নিয়ে যাওয়া হলো? হ্যান্ডকাপ পরা একজন মানুষ কিভাবে দৌড়ে গেলেন? এই হত্যাকাণ্ডের জন্য তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারকে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে পড়তে হয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রথম শিকার সিরাজ সিকদার।

ঘটনা-২
২০০৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর মিরপুরের রূপনগর আবাসিক এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের বর্ষীয়ান নেতা পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) সাধারণ সম্পাদক মোফাখকার চৌধুরী। এরপর ওই দিন রাতেই কুষ্টিয়ায় তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরের দিন পত্রিকার বড় বড় ছাপা অক্ষরে দেখা যায় সেই পুরনো গল্প। উভয় পক্ষের গুলি বিনিময়কালে চৌধুরী পালানোর চেষ্টা করেন; অতঃপর ক্রসফায়ারে নিহত হন। বর্ষীয়ান এই কমিউনিস্ট নেতা ছিলেন আজীবন অকৃতদার। তাঁর মৃত্যুর পর দারুণভাবে সমালোচিত হয়েছিল তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার।

ঘটনা-৩
দেশে জরুরি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসন চলছে। মত প্রকাশের কোনো অনুমতি নেই। ২০০৮-এর ২৫ জুলাই ভোরে মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনের ডি ব্লকের ৮ নম্বর রোডের একটি বাড়ি থেকে র‌্যাবের সদস্যরা পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল-লাল পতাকা) সম্পাদক ডা. মিজানুর রহমান টুটুলকে গ্রেপ্তার করে। তবে সংবাদমাধ্যমের কাছে তথ্যটি গোপন করলেও সংবাদপত্রগুলো তাঁর গ্রেপ্তারের খবর প্রকাশ করে। ২৬ জুলাই সকালে ডা. টুটুলের বাড়িতে পুলিশ আসে। পুলিশের কাছ থেকেই টুটুলের মা ছেলের গ্রেপ্তারের খবর শুনতে পান। ছেলেকে 'ক্রসফায়ারের' হাত থেকে বাঁচানোর জন্য সংবাদ সম্মেলন করে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান নভেরা খাতুন। কিন্তু মায়ের আর্তির প্রতি সহানুভূতি দেখায়নি বাংলাদেশ রাষ্ট্র। ২৭ জুলাই ভোরে রাজশাহীর তানোরে তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে পুলিশের হাতে নিহত হন ডা. মিজানুর রহমান টুটুল।

ঘটনা চার-৪
মুক্তিযোদ্ধা নিরাপদ বৈরাগী ক্রসফায়ারে
অতঃপর একটি বিদ্রূপ নাটকের মঞ্চায়ন

৮ অক্টোবর ২০০৮ রাত আড়াইটার দিকে পুলিশ সেখানে পেঁৗছে। সন্ত্রাসীরা পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে পুলিশকে লক্ষ করে গুলি ছোড়ে। এ সময় পুলিশও পাল্টা গুলি ছোড়ে। ৩৫ মিনিটব্যাপী বন্দুকযুদ্ধের পরে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। এ সময় পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় নিরাপদ বৈরাগী (৫৮) নামের একজনকে উদ্ধার করে। ডুমুরিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেঙ্ েনিলে কর্তব্যরত ডাক্তাররা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। ওসির দাবি, নিরাপদ বৈরাগী নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৬ অক্টোবর (মঙ্গলবার) পুলিশ বীর মুক্তিযোদ্ধা নিরাপদ বৈরাগীকে গ্রেপ্তার করে এবং শুক্রবার রাতে ক্রসফায়ারে হত্যা করে।
নিরাপদ বৈরাগীকে দাহ করার জন্য তাঁর লাশ নিয়ে যাওয়া হয়েছে শ্মশানে। শ্মশানে উপস্থিত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাখাওয়াত হোসেন, ডুমুরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফাউজুল কবিরসহ বিপুলসংখ্যক পুলিশ। পুলিশ লাশটি নামিয়ে জাতীয় পতাকা দিয়ে ঢেকে তাঁর সামনে দাঁড়াল। কর্মকর্তারা তাঁকে স্যালুট করলেন। এরপর দাহ করা হলো। এলাকার মানুষের বিস্ময়ের সীমা নেই। যাঁকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হলো, তাঁকে আবার জাতীয় পতাকায় গার্ড অব অনারে শেষ বিদায়! নাটক আর কাকে বলে!
নিরাপদ বৈরাগীর মুক্তিযোদ্ধা নম্বর-৯৭৭০। প্রতিমন্ত্রী ও সচিব স্বাক্ষরিত স্মারক-মুবিম/সা/খুলনা/প্র-৩/৪৫/২০০২/১৭৬। ২০০৩ সালের ২ মার্চ থেকে তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাতা পাচ্ছেন। প্রথমে ৩০০ টাকা করে ভাতা পেলেও পরে তিনি ৫০০ টাকা করে ভাতা পেতেন। অনেক দিন পর একসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ২৬ হাজার ৪০০ টাকাও উত্তোলন করেছেন এই মুক্তিযোদ্ধা।

ঘটনা-৫
ছেলেটির নাম কাজী মোহাম্মদ ইমতিয়াজ। ডাকনাম আবীর। পরিবারের মধ্যমণি। বন্ধু-বান্ধবের কাছেও অত্যন্ত প্রিয়। প্রাণবন্ত আড্ডাপ্রিয় আবীর বন্ধুদের প্রিয় মুখ। এমনই একটি দিন ছিল ১০ জানুয়ারি। সেদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত বাসায়ই ছিল আবীর। সেদিন বন্ধুদের সঙ্গে একটু আড্ডার বায়না ধরেছিল সে। কিন্তু তার মা রাজি নন এই রাতে বাইরে যাওয়ায়। অবশেষে আবীর মায়ের কাছ থেকে আধাঘণ্টার ছুটি পেল। দুরন্ত ছেলে এক দৌড়ে তিনতলা থেকে নামল। তখন সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে ৭টা। প্রথমে গেল বাসার পাশে খালি পড়ে থাকা একটি প্লটে। সেখানে তখন চলছে ব্যাডমিন্টন খেলা। সেখান থেকে রূপনগর আবাসিকের ২২ নম্বর রোডে যায় সে। সেখানেও ব্যাডমিন্টন খেলা দেখে সে। রাত তখন প্রায় সাড়ে ৮টা। আধাঘণ্টার ওয়াদা এক ঘণ্টায় পেরলো। মা এবার ফোন দিলেন। ছেলেটির যেন হুঁশ ফিরল। ফোন রিসিভ করলে বাড়ি ফেরার কথা বললেন মা। আবীর বলে 'মাত্র ১৫ মিনিটে আমি বাসায় আসছি।' মা সন্তুষ্ট। কিন্তু সেই ১৫ মিনিটও কেটে গেল। তবুও ছেলের খোঁজ নেই। মা আবার ফোন দিলেন। এবার রিকশায় বসে ফোন রিসিভ করে আবীর বলল, 'এই তো আম্মু, আমি রিকশায়। পাঁচ মিনিট লাগবে।' এ সময় রিকশার বেলের শব্দ শুনে মা আশ্বস্ত হলেন। তারপর আবার কেটে গেল ১৫ মিনিট। রাত ৯টায় রেগেমেগে মা আবার ফোন দিলেন। কিন্তু ফোন রিসিভ করল অচেনা কেউ। কে জিজ্ঞেস করতে ও পাশ থেকে ভারী কণ্ঠ ভেসে আসল। জানতে চাইল, আপনাদের বাসার নম্বর কত? মা যেন হকচকিয়ে গেলেন। বাসা নম্বর জানতে চাওয়ায় ভাবলেন, হয়তো আবীর ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েছে। তাকে জিম্মি করে হয়তো বাসায় ঢুকতে চাইছে। তাই তিনি এড়িয়ে গিয়ে বললেন, 'বাসা নম্বর জেনে কী হবে, আবীরকে দাও। আমি ওর মা।' কিন্তু আবীরকে আর দেওয়া হলো না। এরপর সে রাতে আরো কয়েকবার ফোন দেওয়া হলো আবীরের নম্বরে; কিন্তু কেউ আর রিসিভ করল না। এরই মধ্যে বাবা বাসায় ফিরেছেন। তিনি ভাবলেন, আবীর হয়তো কোনো বন্ধুর বাসায়। তাই ফোন রিসিভ করতে ভয় পাচ্ছে।
সংশয়ে আচ্ছন্ন মা সারা রাত ছটফটিয়ে পার করলেন। সকালেই এল সেই ভয়াবহ দুঃসংবাদ। টেলিভিশনের সংবাদ শিরোনামে জানা গেল, গতকাল রাত ১১টায় বেড়িবাঁধ বালুর মাঠসংলগ্ন এলাকায় একদল যুবক ডাকাতির উদ্দেশ্যে একত্র হওয়ার সময় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ হয়। এ সময় ক্রসফায়ারে আবীর নামে এক ডাকাতের মৃত্যু হয়েছে। মুহূর্তেই পরিবারের সবাই হতবাক। এরপর ঘটনার আরো নিশ্চয়তা মিলল ইত্তেফাকের সংবাদে। সেখানেও আবীরের মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে পল্লবী থানায় যোগাযোগ করা হলে ঘটনার সত্যতা মেলে। কিন্তু ততক্ষণে পরিবারটি নিস্তব্ধ। কিভাবে আবীরকে ডাকাতের খাতায় নাম লেখাল পুলিশ? যে ছেলে উঁচু গলায় কারো সঙ্গে কথা বলেনি, চোখ রাঙাতে শেখেনি_সে কিভাবে ডাকাতি করে? এলাকাবাসীও হতবাক। অবশেষে বিকেল ৫টায় পরিবারের কাছে আবীরের লাশ হস্তান্তর করা হয়। পোস্টমর্টেমে দেখানো হয়েছে, তার হাঁটুতে গুলি লেগেছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণেই তার এই মৃত্যু। অবশেষে ওই রাতে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়। মর্মান্তিকভাবে শেষ হয় একটি ছেলের উচ্ছ্বসিত জীবন।

ক্রসফায়ার
অর্থ ও ক্ষমতাবানদের দাপট

শুরুতে ক্রসফায়ার রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড এবং চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হয়। তবে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মধ্যে যাঁরা ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন তাঁদেরও ছ্যাঁচড়া সন্ত্রাসী হিসেবে প্রচার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এমন অভিযোগই করেছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড-বিরোধী কমিটি। কিছু চিহ্নিত চোর-বদমায়েশকে হত্যা করে সেসব এলাকায় মিষ্টি বিতরণও করা হয়েছে ওই সব বাহিনীর পক্ষ থেকে। ফলে মানুষের মধ্যে সন্ত্রাসীদের শাস্তির বিধান হিসেবে বিকল্প পথ ক্রসফায়ারের ওপর এক ধরনের নৈতিক সমর্থন তৈরি হয়। যদিও আইনের বিচারে চূড়ান্ত সাজা না হওয়া পর্যন্ত কাউকে দোষী বলার কোনো সুযোগ নেই। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না হওয়ার কারণে মানুষের মধ্যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের এই সর্বগ্রাসী রোগ রাজনৈতিক নেতাদের হত্যার মধ্য দিয়ে আরো সংঘাতময় জায়গায় গিয়ে পেঁৗছায়। আর হত্যার পর ওই রাজনৈতিক নেতাদের হিংস্র, অজানা শত শত মামলার আসামি হিসেবে উল্লেখ করে ক্রসফায়ারের পক্ষে এক ধরনের নৈতিক সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেছে র‌্যাব-পুলিশসহ ক্রসফায়ার সংঘটিত করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কিন্তু সেই রোগ এখন জনগণকে গিলে খাওয়ার পর্যায়ে পেঁৗছেছে, যে জনগণ ক্রসফয়ারের প্রাথমিক পর্যায় সমর্থন করেছিল। যার ফলে কোনো রকম রাজনীতি বা সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত নয় এমন মানুষও নিহত হচ্ছেন। বর্তমান সরকারের আমলে এমন সব মানুষ ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন, যাঁদের সঙ্গে না আছে রাজনীতির সংস্রব, না আছে সন্ত্রাসের সর্ম্পক। ভুক্তভোগী পরিবার বলছে, ক্রসফায়ারের মাধ্যমে স্থানীয় শত্রুতার বলি হয়েছেন। অর্থের বিনিময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ক্রসফায়ারের মতো রাষ্ট্রীয় আইনের আওতায় ক্রসফায়ার করছে। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রথম থেকে ক্রসফায়ার করা হয়েছে রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি থেকে। এখন সেই মিশন শেষ। কিন্তু ক্রসফায়ার এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। যে কারণে এসব বাহিনী এখন অর্থের বিনিময়েও ক্রসফায়ারে মানুষ নিহত করছে। বিশেষজ্ঞদের মতামত, এটা স্রেফ একটি ভাড়াটিয়া ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। এর কুফল দীর্ঘমেয়াদি।

ইশতেহার থেকে সরে এসেছে আওয়ামী লীগ
দিনবদলের সনদ বলে খ্যাত আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের ৫.২ অনুচ্ছেদে দলটি অঙ্গীকার করেছিল, 'বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা হবে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা হবে।' তবে এই প্রতিশ্রুতি ফাইলের নিচে চাপা পড়েছে আর জনগণকে বন্দুকের সামনে দাঁড় করিয়ে করা হয়েছে ক্রসফায়ার। বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগ জনগণের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি প্রত্যাখ্যান করেছে। ক্ষমতা গ্রহণের পর জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন, সব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের তদন্ত হবে। তবে প্রধানমন্ত্রীর এই হুঙ্কার বাস্তবে কোনো কাজে আসেনি, বন্ধ হয়নি বিচারবহির্ভূত হত্যার মিছিল।

পুলিশের চরিত্র : শাসক সরকারের আদেশ-নিষেধ
পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল বা সংক্ষেপে পিআরবি অনুযায়ী পুলিশের র্কমকাণ্ড পরিচালিত হয়ে আসছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি তাদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য ১৮১৩ সালে প্রথম পুলিশ বাহিনী গঠন করে। এই বাহিনীর মূল উদ্দেশ্য ছিল উপনিবেশবিরোধী বিপ্লবীদের দমন-নিপীড়ন।
পুলিশ আরো যেসব আইন দ্বারা পরিচালিত হয় তা হলো পুলিশ আইন ১৮৬১, ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮, পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল ১৯৪৩ প্রধানভাবে উল্লেখযোগ্য। এ আইনগুলোর আলোকে পরে যথাক্রমে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ ল ১৯৭৬, ১৯৭৮, ১৯৮৪ ও ১৯৯২ এবং আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন অর্ডিন্যান্স ১৯৭৯ জারি করা হয়। এ আইনগুলোর মাধ্যমে বিভাগীয় শহরে পুলিশের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। তবে ১৮৬১ সালের আইনটিকে মূল ধরে এখনো পুলিশ বিভাগের সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়ে আসছে। ১৮৬১ সালের ওই আইন তৈরি করা হয়েছিল ১৮৫৭ সালের ভারতের প্রথম জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের শক্তিকে দমনের জন্য, যাতে ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে আর কোনো আন্দোলন গড়ে উঠতে না পারে। এ আইনের ধারাবাহিকতায় পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল ১৯৪৩ জারি করা হয় তেভাগা আন্দোলন দমনের জন্য। পুলিশ বাহিনী গঠনের ইতিহাস শাসকদলকে রক্ষা করার ইতিহাস। ইতিহাসের এই ট্র্যাজেডি থেকে পুলিশ আজো বের হয়ে এসে একটি কল্যাণধর্মী জনগণের প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। শাসক সরকারের ভাড়াটিয়া হিসেবে বিরোধীদের দমাতে সংগঠনটির জুড়ি নেই।

পুলিশকে কি ক্রসফায়ারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে
সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছেন, 'আমার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর সন্ত্রাসীরা গুলি চালাবে, আর তারা বসে থাকতে পারে না।' বিষয়টি হলো আত্মরক্ষার অধিকারে পুলিশ গুলি চালাতে পারে। সেটা পুলিশ কেন, যে কেউ আত্মরক্ষার জন্য গুলি অথবা যেকোনো উপায়ে আক্রমণকারীকে প্রতিরোধ করতে পারে। পুলিশের জন্য আত্মরক্ষার আলাদা কোনো আইন নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে কোনো ব্যক্তি আটক হলে রাষ্ট্রই হবে তার একমাত্র হেফাজতকারী। সেখানে কোনোভাবে কোনো আটক ব্যক্তি বা বন্দির মৃত্যু হলে সেটা অবশ্যই তদন্ত হতে হবে এবং বিচার বিভাগীয় তদন্ত না হলে তার কোনো আইনি মূল্য নেই। অথচ বাংলাদেশে ক্রসফায়ারের গল্পে যত মানুষ বিচারবহির্ভূতভাবে নিহত হয়েছেন তার কোনো বিচার বিভাগীয় তদন্ত হয়নি।
পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেট অথবা পুলিশ সদর দপ্তরের পূর্বানুমতি ছাড়া তারা গুলি চালাতে পারে না। তবে তিন ধরনের পরিস্থিতিতে গুলি চালাতে পারে।
১. মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বা যাবজ্জীবন করাদণ্ডপ্রাপ্ত কোনো আসামি পালানোর চেষ্টা করলে, সেই আসামিকে রুখতে গুলি চালাতে পারে।
২. দাঙ্গা দমনকালে প্রথমে হুঁশিয়ারি, তারপর পর্যায়ক্রমে লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও রাবার বুলেট ছোড়া; এর পরও যদি দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন ওই দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশ গুলি চালাতে পারে।
৩. বিশেষ কোনো পরিস্থিতিতে যদি কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিঘি্নত হয় তাহলে সে ক্ষেত্রেও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বা আত্মরক্ষার স্বার্থে পুলিশ গুলি চালাতে পারে।
এই তিন ধরনের প্রেক্ষাপটে পুলিশ গুলি চালালে পরবর্তী সময়ে পুলিশের বিভাগীয় একটি তদন্ত সম্পন্ন করার বিধান রয়েছে। শুধু পুলিশের নিজস্ব বিভাগের তদন্ত এ ক্ষেত্রে গ্রহণীয় নয়, বিচার বিভাগীয় তদন্তও সম্পন্ন করতে হবে। তবে বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে যাঁরা ক্রসফায়ারের নামে লাইন অব ফায়ারে সরাসরি নিহত হচ্ছেন তাঁদের বেলায় এসব আইন এ পর্যন্ত কার্যকর ছিল বলে কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

র‌্যাব গঠন
'যে যায় লঙ্কায় সে হয় রাবণ'_বাঙালির এই পুরনো প্রবাদের প্রতি সম্মান রেখেই বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী প্রতিবার কিছু নিবর্তনমূলক আইন নতুবা কোনো বাহিনী করে থাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময় রক্ষীবাহিনী করে সে সময়কার প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক বামপন্থী সংগঠনের নেতা-কর্মীকে নিশ্চিহ্ন করার দায়ভার এখনো আওয়ামী লীগের শরীর থেকে মুছে যায়নি। এর পর জিয়াউর রহমান থেকে সদ্যবিদায়ী ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় জারি করা নিবর্তনমূলক আইনে লাখ লাখ মানুষ নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তবে এ সব কিছুকে ছাড়িয়ে গেছে খালেদা-নিজামীর সময় করা র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র‌্যাব গঠন। 'ঞযব অৎসবফ চড়ষরপব ইধঃঃধষরড়হং (অসবহফসবহঃ) অপঃ ২০০৩' আইনটি ১২ জুলাই ২০০৩ সালে বাংলাদেশ সরকার গেজেট আকারে প্রকাশ করে। 'ঞযব অৎসবফ চড়ষরপব ইধঃঃধষরড়হং ঙৎফরহধহপব, ১৯৭৯' সংশোধন করে র‌্যাব গঠন করা হয়।
দেশের বিভিন্ন বাহিনী থেকে সদস্য নিয়ে র‌্যাব গঠিত হয়েছে। সরকার ইচ্ছে করলে যেকোনো বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে যেকোনো বিভাগে নিয়োগ করতে পারে। সরকারের এই ক্ষমতাকে নির্বাহী ক্ষমতা বলে। র‌্যাবে যেমন পুলিশের সদস্য আছে, তেমনি আছে বিমান ও সেনাবাহিনীর সদস্য। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা হলো বিভিন্ন বাহিনী থেকে এনে র‌্যাব গঠন করা হলেও এখানে যদি কোনো সদস্য ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে আমলযোগ্য অপরাধে জড়িয়ে পড়েন তবে তাঁকে কোন আইনে বিচার করা হবে সে বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। যদি দিকনির্দেশনা না থাকে তবে ধরে নেওয়া যায়, বিভিন্ন বাহিনী থেকে প্রেষণে আসা সদস্যদের নিজ নিজ বিভাগের আইন দ্বারা বিচার হবে। র‌্যাবে আসা সেনাবাহিনীর কোনো সদস্য যদি হত্যার মতো মারাত্মক ফৌজদারি দণ্ডবিধি লঙ্ঘন করেন, তবে তাঁর বিচার হবে সেনাবাহিনীর প্রচলিত আদালতে। আর এ ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার উপেক্ষিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। তা ছাড়া সেনাবাহিনীর সদস্যদের কাজ তো আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা নয়, তাঁদের কাজ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার মতো কাজে নিয়োজিত গুরুত্বপূর্ণ একটি জাতীয় বাহিনীকে র‌্যাবে এনে বিতর্কিত করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা মূলত পুলিশের কাজ। পুলিশের কাজ অন্য কোনো বাহিনী দিয়ে করানোটা উচিত নয় বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা।

উইকিলিকস এবং র‌্যাব
বিকল্প গণমাধ্যম ইউকিলিকসের তারবার্তায় বাংলাদেশের র‌্যাব সম্পর্কে মূল্যবান অনেক তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ১১ আগস্ট ইউকিলিকসের ফাঁস হওয়া তারবার্তায় জানা যায়, '২০০৮ সালের ১২ থেকে ১৬ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিনিধিদল র‌্যাব সম্পর্কে ধারণা পেতে এবং র‌্যাবের সঙ্গে একত্রে কাজের উপায় বের করতে বাংলাদেশ সফর করে। ওই তারবার্তায় র‌্যাবের বিরুদ্ধে ক্রসফায়ার এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের প্রসঙ্গ তুলে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে র‌্যাবের সঙ্গে কাজ করা সম্ভব নয়, কারণ তাতে সে দেশের আইন লঙ্ঘন হবে।' তবে ১৪ জানুয়ারি ২০০৯-এ পাঠানো অন্য একটি তারবার্তায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাবকে মানবাধিকার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআইয়ের বাংলাদেশি প্রতিরূপ হয়ে ওঠার সবচেয়ে ভালো সম্ভাবনা আছে র‌্যাবের।' এ বার্তায় রাষ্ট্রদূত জেমস মরিয়ার্টি র‌্যাব চালু রাখার পক্ষে যুক্তির অবতারণা করলে ভারতের রাষ্ট্রদূত পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তীর তাতে সমর্থন জানানোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
১৪ মে ২০০৯-এর একটি তারবার্তায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত মন্তব্য করেছেন, যুক্তরাজ্য ১৮ মাস ধরে র‌্যাবকে 'অনুসন্ধানী জেরা' এবং অন্যান্য 'কর্মকৌশল'-বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এবং যুক্তরাষ্ট্র দুজন ইউএস মার্শালকে তিন মাসের জন্য র‌্যাবের কাজ গোছানোর জন্য পাঠাচ্ছে। পশ্চিমা দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো র‌্যাব-পুলিশের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠে ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছে। কিন্তু তাদের দেশগুলো আবার র‌্যাবকে নানা ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে, এ স্ববিরোধিতার পেছনের রাজনীতি আরো গভীর।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাবকে সত্যিকারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার ব্যাপারে সহযোগিতা করতে চায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে গিয়ে যেন কোনোভাবেই মানবাধিকার ইস্যুটি বাদ না পড়ে তার জন্য নানা ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে মার্কিনিরা। কিন্তু বাস্তবে তা মিলছে না। মার্কিনিরা র‌্যাবকে সহযোগিতা করার পরও শুধু র‌্যাবের হাতে ২০১০ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন ৬৫ জন। বিচারবহির্ভূত হত্যার সঙ্গে যোগ হয়েছে গুপ্তহত্যা। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, মার্কিনিদের পরামর্শে ক্রসফায়ারের বদলে সরকার কি গুপ্তহত্যার পথ বেছে নিয়েছে?

সংবিধান মানুষ হত্যার লাইসেন্স দেয়নি
বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগের মৌলিক অধিকার চ্যাপ্টারের ৩৩-এর (১) অনুচ্ছেদে গ্রেপ্তার ও আটক ব্যক্তির হেফাজত সম্পর্কে বলা হয়েছে, 'গ্রেপ্তারকৃত কোনো ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্র গ্রেপ্তারের কারণ জ্ঞাপন না করিয়া প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাঁহার মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শের ও তাঁহার দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যাইবে না।
(২) গ্রেপ্তারকৃত ও প্রহরায় আটক প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে গ্রেপ্তারের চবি্বশ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের স্থান হইতে ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে (আনয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সময় ব্যতিরেকে) হাজির করা হইবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতীত তাঁহাকে তদতিরিক্তকাল প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না।'
সংবিধানের মৌলিক অধিকার চ্যাপ্টারের আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার সম্পর্কে ৩১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'আইনের আশ্রয় লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভ যেকোনো স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষত আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।'
সংবিধান মানুষ হত্যার লাইসেন্স দেয়নি। আর যে গল্পটি জনগণকে শোনানো হয় তা কোনোভাবেই এখন আর কেউ বিশ্বাস করে না। সাংবিধানিক সরকারের হাতে সংবিধান লঙ্ঘন কোনোভাবেই গণতন্ত্রের জন্য সুখবর নয়। গণতান্ত্রিকব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হলে দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে সবার আগে শক্তিশালী করতে হবে, বিচার বিভাগের সম্মান ঊধর্ে্ব তুলে ধরতে হবে। এ কাজ গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাজনৈতিক দলের।

টার্গেট বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শ
ঘুরে-ফিরে এই প্রশ্নটি আমজনতার মুখে_জঙ্গিরা কেন ক্রসফায়ারে নিহত হয়নি? র‌্যাবের সঙ্গে সম্মুখ সমরে জঙ্গিনেতা বাংলাভাই ধরা পড়ে এবং তাকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। শুধু বাংলাভাই নয়, র‌্যাব-পুলিশের সম্মুখযুদ্ধে জেমএবির অনেক রাঘব-বোয়ালই গ্রেপ্তার হয়েছে, তবে তাদের কারো ভাগ্যেই ক্রসফায়ার জোটেনি। ক্রসফায়ার শুধু সশস্ত্রপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির নেতা-কর্মীর বেলায়। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কমিউনিস্ট দলের যেসব নেতা-কর্মী ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন, তাঁদের স্বজনদের পক্ষে একাধিক অভিযোগ পাওয়া গেছে, স্থানীয় জামায়াত নেতাদের অভিযোগের কারণেই পুলিশ, র‌্যাব কিংবা যৌথবাহিনী তাঁদের ক্রসফায়ারে হত্যা করেছে। এমনও অভিযোগ রয়েছে, যেখানে জামায়াত নেতারা গোপন দলের ওই সব নেতা-কর্মীকে শনাক্ত করতে সোর্স হিসেবে কাজ করেছেন।
বিচারবহির্ভূত হত্যার সমালোচকরা মনে করেন, দেশের বাম প্রগতিশীল নেতৃত্বদের টার্গেট করেই মার্কিন নির্দেশে হত্যাকাণ্ড শুরু করেছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার; আর সে হত্যা এখনো চলছে।
মানুষ অপরাধী হয়ে জন্মগ্রহণ করে না। সমাজ ও পরিবেশ সর্বোপরি সামাজিক অবস্থাই তাকে সন্ত্রাসী হিসেবে তৈরি করে।
সে ক্ষেত্রে আইন শক্তিশালী হলে, বিচার বিভাগ সমুন্নত হলে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ঘটিয়ে কেউ নিস্তার না পেলে সমাজে সন্ত্রাসের প্রবণতা কমবে। বিনাবিচারে হত্যা করে সন্ত্রাস কমে না বরং তা আরো নানা মাত্রায় সমাজের ওপর চেপে বসে। সাম্প্রতিক সময়ের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি তা-ই নির্দেশ করে।
আবার রাজনৈতিক সংগ্রামকে শাসক শ্রেণী সন্ত্রাস হিসেবে ঘোষণা দিয়ে প্রতিরোধ করার ইতিহাসও রয়েছে। কিন্তু রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়েই প্রতিরোধ করতে হয়। এর বাইরে কোনো বিকল্প নেই। হত্যা কিংবা গুপ্তহত্যা কোনোভাবেই তার সমাধান নয়। বরং হত্যা-গুপ্তহত্যার পথ বেছে নিলে তার ফল ভবিষ্যতের জন্য আরো কোনো গভীর সংকট ডেকে আনে।
একটি গণতান্ত্রিক শাসন কাঠামোর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, বিচার বিভাগকে শক্তিশালী করা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। বাংলাদেশে যদি বিচার বিভাগ শক্তিশালী না হয়, ন্যায়বিচার নিশ্চিত না হয় তাহলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রই বিপন্ন হবে।

0 comments:

Post a Comment

 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. XNews2X - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু