Home » , , » বিজয়ে উন্মাতাল মিসর তবুও শঙ্কার ছায়া

বিজয়ে উন্মাতাল মিসর তবুও শঙ্কার ছায়া

Written By Unknown on Sunday, February 13, 2011 | 1:14 AM

সূর্য প্রতিদিনই ওঠে। কিন্তু কোনো কোনো সূর্যোদয় মানুষকে আলোড়িত করে দারুণভাবে। যেমন, গতকালের দিনটায় আলোড়িত হয়েছে মিসরের কোটি কোটি মানুষ। গতকাল শনিবার ছিল মিসরের গত ৩০ বছরের ইতিহাসে প্রথম আলোকিত অনাবিল এক দিন।

তবে মুবারকবিহীন এই দিন পুরো দ্বিধাহীন নয়। কারণ গণতন্ত্র স্বরূপে প্রতিষ্ঠা পায়নি এখনো। ক্ষমতা আপাতত সেনাবাহিনীর হাতে ন্যস্ত হওয়ায় পুরনো শঙ্কাও কাজ করছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মনে। কেননা মুবারকরা এভাবেই মিসরে ক্ষমতাসীন হয়েছেন। আবারও যে কেউ হবেন না, এর নিশ্চয়তা কী? ফলে এখনো বাকি রয়েছে অপেক্ষার প্রহর।
টানা ১৮ দিন দেশজুড়ে তীব্র গণবিক্ষোভের পর হোসনি মুবারককে পদত্যাগে বাধ্য করতে পারায় মিসরবাসীর মনে এখন বাঁধভাঙা আনন্দের জোয়ার। গত শুক্রবার রাতে ভাইস প্রেসিডেন্ট ওমর সুলেইমান পলাতক হোসনি মুবারকের পদত্যাগের বার্তাটি পাঠ করার পর থেকেই কায়রো যেন নির্ঘুম নগরী। লাখ লাখ মিসরীয় শুক্রবার রাত থেকেই আনন্দে উদ্বেল। গতকালও তারা মনের আনন্দে গেয়েছে বিজয়ের গান, উড়িয়েছে দেশের পতাকা।
এদিকে মিসরের বরখাস্ত হওয়া প্রধানমন্ত্রী আহমেদ নাফিজের দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন প্রধান কেঁৗসুলি। এ ছাড়া আত্মগোপন করে থাকা দেশটির সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হাবিব আল-আদলির ভ্রমণের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এ ছাড়া হাবিব আল-আদলিসহ ক্ষমতাচ্যুত হোসনি মুবারক সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। মিসরের বার্তা সংস্থা মেনার উদ্ধৃতি দিয়ে গতকাল শনিবার রাতে এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি।
মেনার খবরে বলা হয়, রাষ্ট্রের প্রধান কেঁৗসুলির দপ্তর দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে মুবারকের ঘনিষ্ঠ ও এনডিপির একজন শীর্ষ নেতা ইস্পাত ব্যবসায়ী আহমেদ ইজের অর্থসম্পদ জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছে। মেনা জানায়, সাবেক গৃহায়ণমন্ত্রী আহমেদ আল-মাগরাবি এবং সাবেক শিল্পমন্ত্রী রশিদ মোহাম্মদ রশিদের অর্থসম্পদ নিয়েও তদন্ত চলছে। কায়রো শহরে গতকালও হয়েছে বিজয় মিছিল। যুবকরা হাতে হাত মিলিয়ে পরস্পর
অনুভূতি বিনিময় করেছে। মিসরীয়দের এ যেন পুনর্জন্মের দিন।
দুই রাত আগেও যারা বিক্ষোভে অংশ নিয়ে তাহরির স্কয়ারে ফেলা অস্থায়ী তাঁবুর ভেতর উদ্বেগ ও শঙ্কায় রাত পার করেছিল, গতকাল তারাই ছিল বিজয় মিছিলগুলোর সম্মুখভাগে। তাদেরই একজন ৪০ বছর বয়সী কৃষি প্রকৌশলী ওসামা সাদাল্লাহ গতকাল মিছিল থেকে বলেন, 'আজ শুধুই উৎসবের দিন। আমাদের জাতির পুনর্জন্ম হয়েছে। আমরা পৃথিবীকে দেখিয়ে দিয়েছি_আমরা পারি। আজ পৃথিবীজুড়ে শুধুই আমাদের বিজয়ের সংবাদ। এ জন্য আমরা গর্বিত। এটা ভীষণ সুখের মুহূর্ত।'
অবশ্য মুবারকের পতনের পর মিসরের রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ সেনাবাহিনীর হাতে চলে যাওয়ায় এ সুখ তাদের কপালে সইবে কি না, সেটা নিয়েও উৎসবের মধ্যেই চলছে নানা আলোচনা। মুবারকের পতনের আনন্দে আত্মহারা হলেও এখন মিসরীয়দের মুখে মুখে এটাও ঘুরছে_সেনাবাহিনী কি তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে?
সেনা নিয়ন্ত্রণের কারণে এত দিন ধরে গণমানুষের সঙ্গে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া রাজনৈতিক দলগুলো হঠাৎ করেই যেন চলে গেছে দৃশ্যপটের আড়ালে। তবে মিসরের সেনাবাহিনী গতকালও এক ঘোষণায় দেশবাসীকে দেওয়া তাদের প্রতিশ্রুতি অক্ষুণ্ন রাখার ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সেনাবাহিনীর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দেওয়া ভাষণে খুব শিগগিরই নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকারের পরিবর্তন ঘটবে এবং দেশটিতে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেওয়া হবে বলে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। তবে ওই বিবৃতির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলোর বিষয়ে সেনা সরকার তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। তারা জানিয়েছে, এর আগে মুবারকের শাসনামলে ইসরায়েলসহ সারা পৃথিবীর সঙ্গে মিসরের যেসব চুক্তি ছিল, সেগুলো মেনে চলা হবে। বিশেষ করে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পাদিত শান্তিচুক্তি অব্যাহত থাকবে বলে ঘোষণা দেওয়ায় পাশের দেশটিতে স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়েছে। বিবৃতিতে নতুন সরকার গঠন না হওয়া পর্যন্ত দেশটির বর্তমান সরকার ও প্রশাসনকে কাজ চালিয়ে যাওয়ার আহ্বানও জানানো হয়।
এদিকে সেনা সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মেদ হোসেইন তানতাভি খুব শিগগিরই তাঁর সরকারের অবস্থান ও নীতি ঘোষণা করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট পদ থেকে হোসনি মুবারক পদত্যাগ করে সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ায় দেশটির সামরিক বাহিনীর প্রধান হিসেবে ৭৫ বছর বয়সী তানতাভি গত শুক্রবার জাতীয় প্রতিরক্ষা কাউন্সিলে মুবারকের স্থলাভিষিক্ত হন। তাঁর ভাষণে সরকার পরিবর্তনের সম্ভাব্য পথ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়ার আশা করছেন মিসরের রাজনীতিবিদরা।
মিসরের রাস্তাগুলো থেকে সেনাবাহিনীর ট্যাংকসহ ভারী সাঁজোয়া যানগুলোকে গতকাল সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। গত ১৮ দিনের গণবিদ্রোহের সময় সরকারি নির্দেশে সম্ভাব্য সহিংসতা মোকাবিলার উদ্দেশ্যে এসব সাঁজোয়া যান কায়রো শহরের বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করা হয়। কিন্তু উদ্বেগজনক পরিস্থিতির ভেতরেও দেশটির সেনাবাহিনী আশ্চর্যজনকভাবে শান্ত থাকায় এসব ভারী অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারের প্রয়োজন পড়েনি। অন্যদিকে সেনাবাহিনী গণমানুষের বিক্ষোভ চলাকালে সরাসরি কোনো অবস্থান না নেওয়ায় বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা ক্ষমতায় আসার পরও তাদের প্রতি দেশটির সাধারণ মানুষ বিশ্বাস রেখেছে। এটা মিসরের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য দিক বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মত প্রকাশ করেছেন। তবে সেনাবাহিনী অঙ্গীকার পাল্টে নিজেরাই ক্ষমতাসীন হওয়ার পরিকল্পনা করলে সাধারণ মানুষ আবারও মাঠে নামবে বলেই তাঁদের ধারণা।
প্রেসিডেন্ট পদ থেকে হোসনি মুবারক পদত্যাগ করায় মিসরের বিরোধী দলগুলো এবং পশ্চিমা রাষ্ট্রপ্রধানরা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, 'মিসরবাসী পরিবর্তনের জন্য আকুল হয়ে ছিল। ক্ষমতা ছেড়ে মুবারক সে ডাকে সাড়া দিতে বাধ্য হয়েছেন। মিসরবাসী প্রমাণ করেছে, বর্তমান সময়ে আদর্শ গণতন্ত্র ছাড়া আর কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়।'
মিসরের বৃহত্তম বিরোধী দল মুসলিম ব্রাদারহুড মুবারক ক্ষমতা ছাড়ায় আনন্দিত হলেও সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছে, সেনাবাহিনী তাদের প্রতিশ্রুতি অক্ষুণ্ন রাখবে এটাই তাদের প্রত্যাশা।'
এদিকে গতকাল সুয়েজ খালের নিকটবর্তী ইসমাইলিয়া শহরে শত শত পুলিশ ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় রাস্তায় নেমে আসে। তাদের সঙ্গে সাদা পোশাকের গোয়েন্দা পুলিশও এ বিক্ষোভে যোগ দেয়। বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলিবর্ষণের জন্য অনুতাপ প্রকাশ করে তারা অভিযোগ করে, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণের জন্য তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। চাকরিবিধি অনুযায়ী তারা কেবল এ নির্দেশ পালন করেছে। তবে কাজটা ছিল জঘন্য অন্যায়। এ সময় তারা 'পুলিশ ও জনতা ভাই ভাই'-জাতীয় স্লোগান দিয়েও রাস্তা প্রকম্পিত করে। এই নির্দেশের জন্য তারা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হাবিব আল-আদরিকেও দায়ী করে। উল্লেখ্য, গণ-অভ্যুত্থানের সময় পুলিশের হামলায় ৩০০ মিশরীয় আন্দোলনকারী নিহত ও কায়েক হাজার আহত হয়।
এদিকে গতকাল শনিবারও কায়রোর একটি জেল থেকে ৬০০ বন্দি পালিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। পুলিশ জানায়, জেলের ভেতরে বন্দিরা প্রথমে বিক্ষোভ করে। এরপর দাঙ্গা বাধিয়ে দেয়। এ সময় পুলিশ দাঙ্গা থামানোর চেষ্টা করলে জেলখানার বাইরে থেকে একদল সশস্ত্র বন্দুকধারী পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। পুলিশ পাল্টা গুলি ছোড়ার সময় বন্দিদের একটি অংশ পুলিশের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ করে। এ সময় সৃষ্ট সংঘর্ষে কয়েকজন নিহত এবং বেশ কিছু আহত হলেও প্রায় ৬০০ বন্দি পালিয়ে যায়। আহত-নিহতের সংখ্যা তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ জানাতে পারেনি। তবে অন্য একটি সূত্র দাবি করেছে, পুলিশের একটি অংশ বিচারাধীন এসব আসামিকে জেল থেকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।
এদিকে মিসরের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত দৈনিক 'আল-আহরাম' মুবারকের পতনের পর তাদের শিরোনামে লিখেছে 'দেশের তরুণ প্রজন্ম মুবারককে গদি ছাড়তে বাধ্য করল'। এ শিরোনামের মধ্য দিয়ে পত্রিকাটি তাদের অবস্থান পরিবর্তনের চেষ্টা চালিয়েছে বলে অন্যান্য প্রচারমাধ্যম জানিয়েছে।
সূত্র : এএফপি, এপি, বিবিসি, রয়টার্স।

0 comments:

Post a Comment

 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. XNews2X - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু