Home » , , » ডিসেম্বর '৭১-এর কিছু স্মৃতি by জাফর আলম

ডিসেম্বর '৭১-এর কিছু স্মৃতি by জাফর আলম

Written By Unknown on Sunday, January 23, 2011 | 10:55 AM

মি ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে। সঙ্গে আমার স্ত্রী রহিমা, দুই কন্যা পারভীন ও জাবীন। উঠেছি ছোট ভাই বদিওলের আন্দরকিল্লার ঘাট ফরহাদবেগের বাসায়। আমার ভাই বদিওল তখন কঙ্বাজারে। ছোট বোন প্রয়াত জহুরা ছিল। আমাদের জন্য রাতে জহুরা খিচুড়ি রেঁধেছিল।

ওদিকে সেদিন বিকেলে চট্টগ্রাম লালদীঘির ময়দানে মুসলিম লীগ আয়োজিত জনসভায় মুক্তিযোদ্ধারা বোমা ফাটিয়েছে। জনসভা পণ্ড। অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার জন্য এ জনসভার আয়োজন করা হয়। সন্ধ্যা থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে কারফিউ জারি করা হয়েছে। আমার শ্বশুর মরহুম মকবুল আহামদ নাজির এসডিও কোর্টের পিয়ন রশীদকে কঙ্বাজার থেকে চট্টগ্রাম পাঠিয়েছে আমাদের নেওয়ার জন্য। কারফিউর কারণে বেচারি আমাদের বাসায় আসতে পারেনি, টেলিফোনে যোগাযোগ করেছিল। তার সঙ্গে সাব্যস্ত হলো, ৪ ডিসেম্বর সকালে কারফিউ প্রত্যাহৃত হলে আমাদের বাসায় এসে নিয়ে যাবে। হোটেল সফিনার সামনে চট্টগ্রাম থেকে কঙ্বাজারগামী বাস ছাড়বে।
৩ ডিসেম্বর রাত ৩টায় দেখলাম, কর্ণফুলী নদীর মোহনা থেকে পাকিস্তান নৌবাহিনীর জাহাজ থেকে শেলিং হচ্ছে। জাহাজের গোলা এসে পড়ছে কোর্ট বিল্ডিংয়ে। আর আগুনের ফুলকি বাসার ছাদ থেকে দেখা যাচ্ছে। আর আকাশে ভারতীয় বিমানের সঙ্গে পাকিস্তানি মিগ বিমানের কক ফাইট হচ্ছে। ঘুম থেকে ওঠে আমরা সবাই ছাদের ওপর গিয়ে এ দৃশ্য উপভোগ করেছি।
সকালে রশীদ বাসায় এসে আমাদের চট্টগ্রামের সফিনা হোটেলের সামনে নিয়ে গেল। কঙ্বাজারে যাওয়ার কোনো গাড়ি ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের কারণে তখন যোগাযোগব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত নাজুক। সকাল ১০টা পর্যন্ত অপেক্ষার পর আমরা কাশিমবাজার হোটেলে গিয়ে দুপুরের আহার সেরে নিই। ১১টায় কো-অপারেট ও বুক সোসাইটির সামনে একটি কঙ্বাজারগামী কোস্টার পাওয়া গেল। আমরা এ কোস্টারে উঠেছি। আমার স্ত্রী ও দুই কন্যাকে গাড়িতে বসিয়ে আমি নিচে দাঁড়িয়েছিলাম। আমরা সবাই গাড়ি ছাড়ার অপেক্ষায়। একজন স্বাস্থ্যবান তরুণ পরনে প্যান্ট, গায়ে হাফ শার্ট আর পায়ে চামড়ার স্যান্ডেল পরা দোকানের সামনে দাঁড়িয়েছিল। বয়স হবে ১৮ থেকে ১৯। হঠাৎ পাকিস্তান আর্মির একটি পিকআপ ভ্যান এসে হাজির। পেছনে ত্রিপলে ঢাকা। সামনে সিট থেকে একজন সাদা পোশাকধারী পাকিস্তানি সামরিক অফিসার আমেরিকান পিস্তল হাতে নিয়ে নেমেই হাঁক দিল। 'কুই নেহি হিনেগা' অর্থাৎ কেউ নড়বে না। তারপর পিকআপ গাড়ির পেছনের ত্রিপল তুলল। আমি পাশে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য দেখছিলাম।সামরিক অফিসারটি যখন পিকআপ ভ্যানের পেছনের ত্রিপল তুলল, দেখলাম, বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা লুঙ্গি ও প্যান্ট পরা, পেছনে দড়ি দিয়ে মোড়ানো হাত দুটি বাঁধা। ওরা সবাই কাঁদছে। অফিসারটি বলল, 'কউন হ্যায় দেখা দো' অর্থাৎ কে সে দেখিয়ে দাও। পিকআপের ভেতর থেকে একজন ইশারায় আমাদের পাশে দাঁড়ান মুক্তিযোদ্ধা তরুণকে দেখিয়ে দেয়। চিলে যেমন ছোঁ মেরে মুরগি নিয়ে যায়, তেমনি পাকিস্তানি সামরিক অফিসারটি তরুণটিকে ধরে নিয়ে পিকআপ ভ্যানে তুলে নিল আর ত্রিপল ঢেকে দ্রুত চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের দিকে চলে যায়। এসব তরুণ মুক্তিযোদ্ধা আর ফিরে আসেননি, আর বর্বর হানাদার বাহিনী তাঁদের হত্যা করেছিল নিশ্চয়। তাঁদের কান্না দেখে আমার চোখেও অশ্রু দেখা দিয়েছিল।
৪ ডিসেম্বর সকাল ১১টায় রওনা দিয়ে আমরা সন্ধ্যায় কঙ্বাজার পেঁৗছি। দোহাজারী-চিরিঙ্গা আর রামু বাসস্টেশনে আমাদের গাড়ি চেক হয়। তবে রক্ষা পেয়েছি, গাড়িতে দুজন ইপিআর বাহিনীর সদস্য যাত্রী ছিল। গাড়ি চেক করতে এলেই ওরা বলত, 'এ্যাঁহা কুই মুক্তি নেহি হ্যায়' অর্থাৎ এখানে কোনো মুক্তিযোদ্ধা নেই। দ্রুত গাড়ি স্টেশন ত্যাগ করে।
সন্ধ্যায় বাহারছড়ায় আমাদের বাড়িতে পেঁৗছে দেখি, সারা শহর অন্ধকার, নিষ্প্র্রদীপ মহড়া চলছে। কঙ্বাজার বিমানবন্দরে ভারতীয় জঙ্গি বিমান রকেট হামলা করেছে। টার্গেট ছিল বিমানবন্দরের অফিস ও বিমানবন্দর। আমরা জেনেছি, এই বিমান হামলায় কঙ্বাজার বিমানবন্দরে অ্যাডভোকেট মঈদুর রহমান চৌধুরী নিহত এবং বাহারছড়ার বিমানবন্দরের কর্মচারী মঞ্জুর গুরুতর আহত। পরে সে মারা যায়। আমার ফুফাতো ভাই কাদের বিমানবন্দরের কর্মচারী। সে কোনোমতে পরিখায় লুকিয়ে জীবনে রক্ষা পায়। ৫ ডিসেম্বর রাতে ভারতীয় জঙ্গি বিমান কঙ্বাজার বিমানবন্দরে বোমাবর্ষণ করে। আমি তখন সপরিবারে আমার শ্বশুর মকবুল আহামদ নাজিরের বাসায় অবস্থান করছি। এ বোমাবর্ষণে বাহারছড়াসহ আশপাশের বাড়িঘর কেঁপে ওঠে। আমরা ৬ ডিসেম্বর বাহারছড়ার বাড়ি ছেড়ে সদলবলে কলাতলীতে নিরাপদ স্থানে চলে যাই আমার শাশুড়ির পৈতৃক বাড়িতে। সে আরেক কাহিনী। স্বাধীনতার ৩৯ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু প্রতিবছর যখন বিজয়ের মাস ডিসেম্বর আসে তখন আমার চোখে একাত্তরের ৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের বাসস্ট্যান্ড থেকে একজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক ধরে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য চোখে ভেসে ওঠে। আমি আবেগাপ্লুত হই, উদ্বেলিত হই আর আমার দুচোখে দেখা যায় বেদনার অশ্রু। শুধু মনে প্রশ্ন জাগে, স্বাধীনতার ৩৯ বছর কেটে গেছে, কিন্তু আমরা কী এখনো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসরদের রাহু থেকে মুক্ত হতে পেরেছি? নাকি রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে ওরা এখনো সক্রিয়?

0 comments:

Post a Comment

 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. XNews2X - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু