পরিবেশ- গাছ কাটা আন্দোলন by পাভেল পার্থ

Thursday, January 2, 2014

পৃথিবীর মূল সম্পদগুলো হলো ভূমি, জল ও প্রতিবেশগত বৈচিত্র্য। গরিব নিম্নবর্গের প্রাকৃতিক মূলধনও তাই। প্রতিবেশবৈচিত্র্যের অন্যতম কারিগর উদ্ভিদ। উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য শ্রেণীকরণে বৃক্ষ, বিরুৎ, গুল্ম ও তৃণর ভেতর বৃক্ষরূপটি চারধারের বাস্তুসংস্থানের সঙ্গে অভিযোজনের প্রক্রিয়ায় বিকশিত হয়েছে,
যা সমান্তরাল বিবর্তনের এক গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন। দুনিয়ার মোট উদ্ভিদ প্রজাতির ভেতর প্রায় ২৫ ভাগই বৃক্ষ। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বনে এখন পর্যন্ত প্রায় ৭০০ প্রজাতির সপুষ্পক উদ্ভিদ শনাক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয় উদ্যানে প্রায় ৯৫২ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে।

গাছবিহীন একমুহূর্তও আমরা কল্পনা করতে পারি না। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, ধর্ম, বিশ্বাস, রীতি, শাস্ত্র-পুরাণ, নীতিকথা, প্রথা, বাণিজ্য, দর্শন, মনস্তত্ত্ব, উৎসব, পার্বণ, শিল্প-সংস্কৃতি, আশ্রয়, প্রশান্তি যাপিত জীবনের সবকিছুই গাছকে ঘিরে, গাছ নিয়ে। এমনকি এ জনপদের রাজনৈতিক ঐতিহাসিকতার সঙ্গেও গাছ জড়িত আছে ওতপ্রোতভাবে। গাছ নিয়ে, গাছ ঘিরে রাজনৈতিক দরবার ও সংগ্রামেরও কমতি নেই। ব্রিটিশ জুলুমের বিরুদ্ধে সংগঠিত নীল বিদ্রোহ জড়িয়ে আছে নীলগাছের স্মৃতি নিয়ে। তেভাগা, নানকা, টঙ্কসহ ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনগুলো মূলত ধানগাছকে ঘিরেই। উন্নয়ন বলপ্রয়োগ আর বিনাশী তাণ্ডব থেকে এ দেশের নিম্নবর্গ গাছদের জান বাঁচাতে রুখে দাঁড়িয়েছে বারবার।

দক্ষিণ এশিয়ায় গাছ রাজনীতি ও সংগ্রামের অংশ হলেও সম্প্রতি বাংলাদেশে প্রশ্নহীনভাবে ‘রাজনৈতিক সহিংসতায়’ নিহত হয়েছে অগণিত বৃক্ষ-প্রাণ। ২০১৩ সালে জামায়াতে ইসলামী, বিএনপিসহ ১৮ দলের হরতাল-অবরোধসহ নানা রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে নৃশংস কায়দায় খুন হয়েছে দেশের অগণিত পাবলিক বৃক্ষ। মূলত হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচির মাধ্যমে ‘নির্বিচার গাছ কাটা’ এক ‘রাজনৈতিক কর্মসূচি’ হিসেবে রূপ নিয়েছে। এ খুনখারাবির বিরোধিতা না করে ১৮ দলও একে ‘রাজনৈতিক কর্মসূচি’ হিসেবে মেনে নিয়েছে। বট, আম, শিশু, অর্জুন, একাশিয়া, ইউক্যালিপটাস, মেহগনি, কড়ই, বৃষ্টিগাছ কাটা পড়েছে সবচেয়ে বেশি। মূলত সড়কের পাশের এসব গাছের মালিক বন বিভাগ, স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল বিভাগ, সড়ক ও জনপথ বিভাগ। বন বিভাগসহ কোনো রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষই বৃক্ষগুলোর নিরাপত্তা দিতে পারেনি।
গাছ নিহত হলে গাছ শুধু একাই মরে না, মানুষসহ সব প্রাণসত্তার জন্যই তা ঝুঁকি ও উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। গাছ তাই সব সমাজে, সব ধর্মে ও সংস্কৃতিতে কেন্দ্রীয় আরাধনার বিষয়। সুন্দরবন অঞ্চলে বাগদীদের ভেতর প্রচলিত ‘নাপিতের ছেলে-রাজার ছেলে ও রাজকন্যা’ কাহিনিতে দেখা যায়, বিষফল নামের এক গাছের ফল ফিরিয়ে দেয় মৃতের জীবন।

একটি পূর্ণবয়স্ক বৃক্ষ বছরে যে পরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহ করে, তা কমপক্ষে ১০ জন পূর্ণবয়স্ক মানুষের বার্ষিক অক্সিজেনের চাহিদা মেটায়। ভারতের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টি এম দাস ১৯৭৯ সালে পূর্ণবয়স্ক একটি বৃক্ষের অবদানকে আর্থিক মূল্যে বিবেচনা করে দেখান, ৫০ বছর বয়সী একটি বৃক্ষের অর্থনৈতিক মূল্য প্রায় এক লাখ ৮৮ হাজার মার্কিন ডলার (সূত্র: ইন্ডিয়ান বায়োলজিস্ট, ভলিউম-১১, সংখ্যা ১-২)। টি এম দাসের হিসাবে, ৫০ বছর বয়সী একটি বৃক্ষ বছরে প্রায় ২১ লাখ টাকার অক্সিজেন সরবরাহ করে। বছরে প্রাণীসম্পদের জন্য প্রোটিন জোগায় এক লাখ ৪০ হাজার টাকার, মাটি ক্ষয়রোধ ও মাটির উর্বরতা বাড়ায় ২১ লাখ টাকার, পানি পরিশোধন ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করে ২১ লাখ টাকার এবং বায়ুদূষণ রোধ করে প্রায় ৪২ লাখ টাকার। রাজনৈতিক সহিংসতার ভেতর দিয়ে গাছ হত্যার মাধ্যমে প্রকৃতির ভারসাম্য বিনষ্ট হয়েছে, বিশৃঙ্খল হয়েছে স্থানীয় খাদ্যচক্র। কেবল মানুষই খাদ্য-জ্বালানি-বিশ্রামস্থল হারায়নি, অগণিত পাখি-সরীসৃপ-পতঙ্গ-পরগাছা-পরাশ্রয়ী লতাগুল্ম হারিয়েছে জীবনধারণের উৎস ও আশ্রয়স্থল। নিহত বৃক্ষগুলো অক্সিজেন সরবরাহ ও কার্বন শোষণ করে বায়ুচক্রে যে বিন্যাস তৈরি করেছিল, তা-ও ধ্বংস হয়েছে। এর করুণ পরিণতি আবহাওয়াচক্র এবং সর্বোপরি জলবায়ু পঞ্জিকার ওপর পড়বে। রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে এভাবে বৃক্ষনিধন চলতে থাকলে বাংলাদেশকেও একসময় ‘বৈশ্বিক জলবায়ু বিপর্যয়ের’ দায় কিছুটা হলেও ঘাড়ে তুলতে হবে।

বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে ছোট আয়তনের একটি দেশ হয়েও প্রাণবৈচিত্র্য এবং রকমভিন্ন প্রতিবেশ ও জটিল বাস্তুসংস্থানে ভরপুর এক অনন্য পরিসর। কিন্তু দিনে দিনে দেশের এই বৈচিত্র্যময় প্রাণ ও পরিসর নিশ্চিহ্ন হয়ে এক সংকটময় পরিস্থিতি তৈরি করছে। একটি গাছ নিশ্চিহ্ন হলে তা প্রভাবিত করে আমাদের ভাষাকাঠামোর বিন্যাসকেও। ১৯৯৭ সালে করপোরেট অক্সিডেন্টালের মাধ্যমে মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া ও মাগুরছড়া বনভূমি ঝলসে গেলে সেখানকার আদিবাসী ত্রিপুরি, খাসি ও চা-বাগানিদের ভাষা থেকে হারিয়ে যেতে থাকে অনেক গাছের নাম। কিন্তু শত বলপ্রয়োগ আর বাহাদুরি ঠেলে এখনো এ জনপদ গাছকে বিশ্বাস করে, আগলে রাখে, মানত করে, গাছের সঙ্গেই বন্ধক রাখে জীবনের বিজ্ঞান। এখনো আদিবাসী ওঁরাও গ্রামে কারাম পরবের জন্য সংরক্ষিত হয় কারাম বৃক্ষ। সোহরাই পরবে লাগবে বলে সুন্দরবনের মুন্ডারা বাদাবনের সুন্দরীগাছকে সুরক্ষা দেন। বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে তুলসী, বেল, ফণীমনসা, দূর্বা ঘাস পবিত্র উদ্ভিদ হিসেবে হাজার হাজার বছর ধরে পূজিত। বাঙালি মুসলিম সমাজে খেজুর ও বরইগাছের এক লোকায়ত পবিত্র মাত্রা আছে। এখনো চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলের সুড়লা মৌজায় তেভাগা আন্দোলনের সাক্ষী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেশের প্রবীণতম তেঁতুল বৃক্ষ। পলাশীর আম্রকানন, মেহেরপুর আমবাগান, খুলনার প্রেমকানন, রমনার বটমূল বৃক্ষময়তার ভেতর দিয়েই তুলে ধরেছে আমাদের সভ্যতা ও ইতিহাসের নির্যাস। হাইকোর্ট ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১০ তারিখে শ্রীমঙ্গলের নাহার পুঞ্জির চার হাজার গাছ কাটার অনুমোদন দিলে এর বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন শুরু করেন খাসি আদিবাসীরা। সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার মান্নারগাঁও ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামের এক পবিত্র বটবৃক্ষ ‘কালাচাঁদ ঠাকুরের গাছ’ কাটার বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণ সংগঠিত করেন আন্দোলন (সূত্র: প্রথম আলো, ২৮ মার্চ ২০১২)। কেবল নিম্নবর্গ নয়, বৃক্ষের জীবন বাঁচাতে বন বিভাগও নানা সময় রুখে দাঁড়ানোর সাহস করেছে। কক্সবাজারের দক্ষিণ বন বিভাগের আওতাধীন টেকনাফ উপজেলার জাহাজপুরা সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়ে পাকা সড়ক নির্মাণের জন্য প্রায় ৩৬টি প্রবীণ গর্জন বৃক্ষের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেছিল স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদপ্তর। এলজিইডিকে বনের ভেতর দিয়ে সড়ক নির্মাণ না করার অনুরোধ জানিয়েছিল বন বিভাগ (সূত্র: প্রথম আলো, ২৫-২-২০১০)।

যে জনপদ বৃক্ষের আহাজারি বুকে নিয়ে বিকশিত করে চলেছে এক টগবগে সভ্যতার বনিয়াদ, সে জনপদ কোনোভাবেই বৃক্ষ হত্যাকারী হিসেবে উদ্যত হতে পারে না। আমরা এটি বিশ্বাস করতে চাই না। গাছ হত্যা কোনোভাবেই রাজনৈতিক কর্মসূচি হতে পারে না। বিদ্যমান ঔপনিবেশিক বন আইন, বন্য প্রাণী আইন ও পরিবেশ আইনের মাধ্যমে এ অন্যায়ের সুরাহা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে বৃক্ষনিধন ও পরিবেশ বিপর্যয়ের সব ঘটনাকে দৃষ্টান্তমূলক অপরাধ ও বিচারের আওতায় আনা জরুরি। ২০১৩ সালে রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত গাছের রাষ্ট্রীয় পরিসংখ্যান, সুষ্ঠু তদন্ত প্রকাশ ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে এখনই কার্যকর রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ আশা করি। আসুন, বৃক্ষ-মানুষসহ প্রাণসত্তার সংসারকে অবিরত রাখার ঐতিহাসিক জনদর্শনকে বিকশিত করি। রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে প্রাণ ও প্রকৃতির ওপর সব অন্যায় আঘাতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই।

পাভেল পার্থ। গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ।
animistbnagla@gmail.com

দূষণ ঠেকাবে তিন অণুযোদ্ধা by তৌহিদ এলাহী

Thursday, February 10, 2011

ট্যানারিগুলোতে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে প্রচুর ক্রোমিয়াম। প্রক্রিয়া শেষে এর কিছু উচ্ছিষ্ট চলে যাচ্ছে নদীনালায়, আর কিছু হচ্ছে পশুপাখি ও মাছের খাবার। এভাবে মানুষের দেহে ঢুকে যাচ্ছে বিষাক্ত ক্রোমিয়াম, ঘটাচ্ছে ক্যান্সারসহ অনেক রোগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মোজাম্মেল হক ও তাঁর গবেষক দল এমন তিনটি অণুজীব শনাক্ত করেছেন যেগুলো ওই বিষাক্ত ক্রোমিয়ামকে বানিয়ে দেবে পুরোপুরি নির্বিষ।

দেশে প্রায় ৩০০ ট্যানারি আছে। এর মধ্যে বুড়িগঙ্গা নদীর ধারেই শতকরা নব্বই ভাগ চামড়া কারখানা। এগুলোতে প্রতিদিন গড়ে ২২০ মেট্রিক টন চামড়া প্রক্রিয়াজাত হচ্ছে। প্রতিদিন প্রায় ৬০০-১০০০ কেজি উচ্ছিষ্ট পড়ছে নদীতে। কিছু কিছু আবার মুরগি ও মাছের খাদ্য এবং সার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় স্বাভাবিকভাবেই বিক্রিয়ক হিসেবে ব্যবহার করা হয় প্রচুর ক্রোমিয়াম যৌগ, ক্রোম পাউডার, লিকার ইত্যাদি। এখান থেকে কোনোভাবে এই বিষাক্ত ক্রোমিয়াম মানুষের দেহে ঢুকে গেলে বা সংস্পর্শে এলে তৈরি হয় ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগ। শ্বাস-প্রশ্বাস, খাদ্যদ্রব্য বা পানীয়ের মাধ্যমে মানুষের সংস্পর্শে এলে ত্বকের প্রদাহ, অ্যালার্জি, ক্ষত, অ্যাজমা ঘটায়। নাকের সেপ্টাম পর্দা ছিদ্র করে ফেলতে পারে এই ক্রোমিয়াম। শ্বাসনালি ও পাকস্থলির বিষক্রিয়াও ঘটায়। পাকস্থলি ও অন্ত্রের প্রদাহ, যকৃৎ এবং মূত্রনালির সমস্যা তৈরি করতেও এর জুড়ি নেই।
গবেষণা দলের সহকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ইফতেখার মো. রফিকুল্লাহ রোমান জানান, ক্রোমিয়াম মানবদেহের ক্রোমোজোমের সঙ্গে বিক্রিয়া করে ক্ষতিকর মিউটেশন বা পরিবর্তন ঘটিয়ে কোষের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি অর্থাৎ ক্যান্সার তৈরি করে। পাশাপাশি ক্রোমিয়ামযুক্ত চামড়া শিল্পের আবর্জনা জলজ পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে সেখানকার বাস্তুসংস্থানও নষ্ট করে। এর কারণে স্বাভাবিক অণুজীবের জীবনও বিপন্ন হয়। আর আমাদের চামড়া শিল্পের উচ্ছিষ্ট থেকে খাদ্য ও জৈবসার তৈরির প্রক্রিয়ায় বিজ্ঞানভিত্তিক পন্থাও অনুসরণ করা হয় না। ক্রোমিয়ামযুক্ত উচ্ছিষ্ট চামড়ার শতকরা ৫৩ ভাগের সঙ্গে কোনো যন্ত্রের সংস্পর্শ ঘটে না। সেগুলো থেকে খালি হাতেই তৈরি হচ্ছে মুরগি-মাছের খাবার। এর ধারাবাহিকতায় ক্রোমিয়াম ঢুকে যাচ্ছে শাকসবজিতে। পরে বিভিন্ন পর্যায়ে খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে মানুষের দেহে ঢুকে বিপর্যয় ঘটাচ্ছে।
আগের এক গবেষণায় দেশের হাঁস-মুরগির খামার ও মাছের খাবারে ২.৪৯ শতাংশ ক্রোমিয়াম উপাদান পাওয়া গেছে। আর চামড়া শিল্প সংলগ্ন খালে ৪.০৬ পার্টস পার মিলিয়ন (পিপিএম) ঘনমাত্রায় এবং নদীতে ০.৪৪৩ পিপিএম ঘনমাত্রায় ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে।
অধঃক্ষেপণ, আয়ন বিনিময় ছাড়াও ক্রোমিয়াম দূষণ রোধে আরো কয়েকটি পদ্ধতি প্রচলিত আছে। তবে এগুলো সাশ্রয়ী নয়। প্রয়োজন প্রচুর রাসায়নিক বিক্রিয়ক ও জ্বালানি। এ কারণেই দেশে এগুলোর ব্যবহার চোখে পড়ে না। আবার পদ্ধতিগুলো অন্যভাবে পরিবেশের ক্ষতি করে। আর এ কাজে ড. মোজাম্মেল হকের গবেষণাপ্রাপ্ত অণুজীব ব্যবহার হবে সাশ্রয়ী ও শতভাগ পরিবেশবান্ধব।
রোমান জানান, চামড়া শিল্পে ব্যবহৃত ক্রোমিয়াম সাধারণত দু'ভাবে দ্রবণে মিশে থাকে। এর একটি ক্ষতিকর ও অন্যটি নিরীহ। এটিই গবেষণার মূল ভিত্তি। আবিষ্কৃত তিনটি অণুজীব হলো ইশেরিকিয়া, স্টেফাইলোকক্কাস অরিয়াস, পেডিয়োকক্কাস পেন্টোসেসিয়াস। এরা ক্রোমিয়াম রিডাকটেজ নামের এক ধরনের এনজাইম বা উৎসেচক তৈরি করে। এই ক্রোমিয়াম রিডাকটেজ এনজাইম ক্ষতিকর ক্রোমিয়ামকে নিরীহ ক্রোমিয়ামে পরিণত করে।
এ গবেষণায় প্রথমে চামড়া শিল্প এলাকা সংলগ্ন খাল ও নদী থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করা হয়। আর উচ্ছিষ্ট চামড়াজাত দ্রব্য থেকে প্রস্তুত খাদ্যের জন্য হাজারীবাগ, নিমতলীর প্রাণী ও মৎস্য খাদ্য তৈরির কারখানাগুলো থেকে নমুনা খাদ্য সংগ্রহ করা হয়। পানির নমুনা থেকে 'লুরিয়া বারটানি আগার' নামের বিশেষ ব্যবস্থায় ইশেরিকিয়া, স্টেফাইলোকক্কাস অরিয়াস এবং পেডিওকক্কাস পেন্টোসেসিয়াস ব্যাকটেরিয়া তিনটি শনাক্ত করা হয়। পরে আরেকটি পরীক্ষার মাধ্যমে অণুজীবগুলোর উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়। আর বিভিন্ন পর্যায়ে রাসায়নিক ও শারীরিক প্রক্রিয়াজাতকরণের পর খাদ্য উপাদানগুলো থেকে অ্যাটমিক অ্যাবজর্বশন স্পেকট্রোফটোমিটার (এএএস) যন্ত্রের সাহায্যে ক্রোমিয়ামের উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়। পাশাপাশি এতে ক্ষতিকর ক্রোমিয়ামের পরিমাণ ও ঘনমাত্রাও বের করা হয়। এরপর শনাক্ত করা ব্যাকটেরিয়াগুলো ক্রোমিয়ামযুক্ত নমুনায় প্রয়োগের মাধ্যমে এগুলোর কার্যক্ষমতা পরীক্ষা করা হয়। দেখা যায়, অণুজীব নিঃসৃত ক্রোমিয়াম রিডাকটেজ এনজাইমের প্রভাবে বিষাক্ত ক্রোমিয়াম নিরীহ ক্রোমিয়ামে পরিণত হয়েছে। শনাক্তকারী তিনটি ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে পেডিয়োকক্কাস পেন্টোসেসিয়াস সর্বোচ্চ কার্যকারিতা প্রদর্শন করেছে।
গবেষণা দলের প্রধান ড. মো. মোজাম্মেল হক জানান, এটি গবেষণার প্রাথমিক ধাপ। এটি শিল্প পর্যায়ে প্রয়োগের আগে আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন। এ জন্য সরকারের পাশাপাশি চামড়া, খাদ্য ও পরিবেশসংশ্লিষ্ট মহলের ভূমিকা রাখতে হবে।
এই গবেষণাকর্ম নিয়ে ইতিমধ্যে দুটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। 'বাংলাদেশ জার্নাল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ' এবং বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস প্রকাশিত তৃতীয় বাংলাদেশ-জাপান জয়েন্ট ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সের 'ফুড সেফটি অ্যান্ড হাইজিন' নামের বিজ্ঞান সাময়িকীগুলোতে প্রকাশিত প্রবন্ধ দুটি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। ড. মো. মোজাম্মেল হকের এই গবেষণা দলে আরো ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. ইলিয়াস, শিক্ষার্থী শাহনেওয়াজ বিন মান্নান, বিজয়চন্দ্র দেবনাথ ও সফিউল ইসলাম।

নিয়ম না মেনে পুরোনো জাহাজ আসছে, ভাঙাও চলছে

Wednesday, February 2, 2011

ট্টগ্রামে ভাঙার জন্য আরও চারটি পুরোনো জাহাজ আমদানি করা হয়েছে। এ নিয়ে গত এক মাসে ভাঙার জন্য ৩০টি জাহাজ আনা হলো। উচ্চ আদালতের নির্দেশ আর আন্তর্জাতিক বর্জ্য চলাচলবিষয়ক সনদ অমান্য করে এই জাহাজগুলো আনা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতিও নেওয়া হয়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

ভাঙার জন্য পুরোনো জাহাজ (স্ক্র্যাপ) আমদানির আগে রপ্তানিকারক দেশ থেকে বর্জ্যমুক্ত সনদ (প্রি-ক্লিনিং সার্টিফিকেট) নিতে হবে। থাকতে হবে পরিবেশ ছাড়পত্র। আদালতের এ নির্দেশনা থাকলেও বেশির ভাগ আমদানিকারক তা অমান্য করে চলেছেন।
গত ১৮ জানুয়ারি ম্যাক করপোরেশনের আমদানি করা এমভি প্রণাম নামের একটি পুরোনো জাহাজ কাটার সময় বর্জ্যের কারণে ঘটে যাওয়া বিস্ফোরণে চারজন শ্রমিক নিহত হন। আটজন আহত হয়ে হাসপাতালে রয়েছেন।
গত বছর প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রাম সফরে গিয়ে জাহাজভাঙা শিল্পে পরিবেশসম্মতভাবে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ নির্দেশের পর এখন পর্যন্ত একটি জাহাজভাঙা ইয়ার্ডও নিয়ম মেনে ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেনি।
এদিকে বিভিন্ন দেশের ৪৮টি পরিবেশবাদী ও শ্রমিক অধিকার সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি খোলা চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, ইউরোপীয় দেশগুলো তাদের বেশির ভাগ বর্জ্যযুক্ত জাহাজ নিজেদের দেশে বর্জ্যমুক্ত না করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এতে বাংলাদেশে বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করে তারা উচ্চ আদালতের নির্দেশ ও আন্তর্জাতিক আইন মেনে পুরোনো জাহাজ আমদানির ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানিয়েছে।
আন্তরাষ্ট্রীয় বর্জ্য চলাচলবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদ (ভেসেল কনভেনশন) অনুযায়ী পুরোনো জাহাজ একটি বর্জ্য। রপ্তানিকারক দেশকে বর্জ্যমুক্ত করে আমদানিকারক দেশে পাঠানোর শর্তযুক্ত এই কনভেনশন তৈরি হয় ১৯৮৯ সালে। বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর করলেও এটি মেনে চলে না। মানে না রপ্তানিকারক দেশগুলোও।
মন্ত্রীর জিনতত্ত্ব: গত ২৯ জানুয়ারি পরিবেশ ও বন প্রতিমন্ত্রী হাছান মাহমুদ চট্টগ্রামে জাহাজভাঙা শিল্পের পক্ষে বক্তব্য দেন। চট্টগ্রাম চেম্বার আয়োজিত ‘পরিবেশ রক্ষায় শিল্পপতিদের ভূমিকা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় মূলত জাহাজভাঙা শিল্প নিয়ে আলোচনা হয়। হাছান মাহমুদ সেখানে বলেন, ‘আমি জাহাজভাঙা শিল্পের জন্য অনেক কিছু করেছি। কিন্তু এই শিল্পের ওপর খারাপ জিনের আছর পড়েছে। এই জিন হাইকোর্টের বারান্দায় ঘোরাঘুরি করে। এই জিনের সঙ্গে বিদেশিদের যোগাযোগ রয়েছে। তারা বাংলাদেশে লোহার ব্যবসা করতে চাইছে।’
এদিকে জাহাজভাঙা ইয়ার্ডের পক্ষে পরিবেশ প্রতিমন্ত্রীর প্রকাশ্য অবস্থানের পর পরিবেশ অধিদপ্তর দ্রুততার সঙ্গে ছাড়পত্র দেওয়া শুরু করেছে। এ মাসে মোট ৪৪টি ইয়ার্ডকে পরিবেশ ছাড়পত্র দেওয়া হয় বলে জানা গেছে। এর আগে অক্টোবরে ১৬টি প্রতিষ্ঠানকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। ফলে এখন জাহাজভাঙার পরিবেশ ছাড়পত্র পাওয়া ইয়ার্ডের সংখ্যা দাঁড়াল ৬০টি। সীতাকুণ্ডের জাহাজভাঙা ইয়ার্ডের সংখ্যা মোট ১৩৫। গত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলের শেষ দিকে এই সংখ্যা ছিল ৬০-৬৫।
জানা গেছে, জাহাজভাঙা ইয়ার্ডগুলোতে শ্রমিকের মৃত্যু ও নিয়ম না মানার বিষয়ে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির গত সভায় আলোচনা হয়েছে। সভায় হাছান মাহমুদকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কীভাবে শর্ত সাপেক্ষে ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে। উত্তরে মন্ত্রী বলেছেন, ছাড়পত্র পাওয়া ৪৪টি ইয়ার্ডের বেশির ভাগই ৭৫ শতাংশ শর্ত মেনে কাজ করছে।
১২ বা ১৩ ফেব্রুয়ারি সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরীর নেতৃত্বে পরিবেশ মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় কমিটির একটি প্রতিনিধিদল চট্টগ্রামে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। তারা জাহাজভাঙা ইয়ার্ডগুলো পরিদর্শন করবে।
এ ব্যাপারে সাবের হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, জাহাজভাঙা ইয়ার্ডগুলোর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ ও পরিবেশ-সংক্রান্ত নিয়মকানুন না মানার অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে শোনা যাচ্ছে। ঢাকায় বসে পরিস্থিতি সম্পর্কে মূল্যায়ন না করে তাঁরা সরেজমিনে গিয়ে দেখতে চান বলে জানান।
আদালতের নির্দেশ অমান্য: ২০০৯ সালের অক্টোবরে ১৬টি জাহাজভাঙা ইয়ার্ডকে ছাড়পত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে উচ্চ আদালত থেকে বলা হয়, পরিবেশ অধিদপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী ছাড়পত্র নিতে হবে। শর্ত সাপেক্ষে ছাড়পত্রের কোনো নিয়ম নেই। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তর ওই নির্দেশকে পাশ কাটিয়ে ১৬টির ছাড়পত্র বহাল রাখার পাশাপাশি নতুন করে আরও ছাড়পত্র দেয়।
চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টম হাউস সূত্র জানায়, বহির্নোঙরে গত সোমবারও ভাঙার জন্য আনা চারটি জাহাজ অপেক্ষা করছিল। এ নিয়ে গত তিন মাসে ভাঙার জন্য আমদানি হয়েছে ৩০টি জাহাজ। তবে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক জাফর আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত অক্টোবরের পর ২৬টি জাহাজ আমদানির ছাড়পত্র দিয়েছি। অন্য চারটি জাহাজ কীভাবে এল, আমরা জানি না।’
প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালের ৫ ও ১৭ মার্চ হাইকোর্টের রায়ে সব পুরোনো জাহাজ আমদানির ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি ও রপ্তানিকারক দেশের ছাড়পত্র নেওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এই আদেশ না মেনে জাহাজ আমদানির অনুমতি দিতে শুরু করে। এরপর রেকর্ডসংখ্যক ১৭২টি জাহাজ আসে। বিষয়টি বেলার পক্ষ থেকে জানানো হলে হাইকোর্ট গত বছরের ১১ মে আরেক আদেশে আবারও সব ধরনের জাহাজ আমদানির ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি ও রপ্তানিকারক দেশের ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক করেন।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক বলেন, আমদানিকারকদের পৃথক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত এসব জাহাজ একটি বিশেষজ্ঞ কমিটির সরেজমিন পরিদর্শনের পর ভিড়ানোর নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা এই নির্দেশনা মেনে কাজ করেছি। তবে কোনো জাহাজ কাটার অনুমোদন দেওয়া হয়নি। অনুমোদন ছাড়া জাহাজ কাটার সময় বিস্ফোরণে চার শ্রমিক নিহত হওয়ায় আমরা ম্যাক করপোরেশনের বিরুদ্ধে মামলা করেছি।’
এ প্রসঙ্গে জাহাজভাঙার ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যসোসিয়েশনের (বিএসবিএ) সাবেক সহসভাপতি কামাল উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনের প্রতি শ্রদ্ধা আছে বলে আমি কোনো জাহাজ আমদানি করিনি। এখন আমদানি করা জাহাজ ভাঙতে গিয়ে অনেকে হত্যা মামলার আসামি হচ্ছেন।’

জাহাজভাঙা শিল্প বনাম পরিবেশ ও মানুষ

Friday, January 14, 2011

জাহাজভাঙা শিল্প নিয়ে বিতর্কের গ্রহণযোগ্য একটি মীমাংসা করেছে উচ্চ আদালতের একটি রায়। শিল্পটি থাকবে; কিন্তু পরিবেশের দূষণ ও শ্রমিকদের প্রাণহানি দুটোই বন্ধ হবে—গত বুধবার দেওয়া উচ্চ আদালতের রায়ের সারমর্ম এটাই।

জাহাজভাঙা শিল্পের মালিকদের ক্রমাগত আইন ভঙ্গ এবং পরিবেশ ও শ্রমিকস্বার্থের মধ্যকার দ্বন্দ্বের সুরাহা করার আইনি ভিত্তি এর মাধ্যমে গঠিত হলো। এখন শিল্পটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার এবং সরকারের পরিবেশ, শিল্প ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হচ্ছে, নিজ নিজ ক্ষেত্রে রায়টির প্রতিফলন হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করা। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) দায়ের করা এক আবেদনের ভিত্তিতে উচ্চ আদালত এই রায় দেন। রায়ের অন্য অংশগুলোও গুরুত্বপূর্ণ। তাতে এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে রসায়নবিদ, পরিবেশবিদ, পদার্থবিদ, আইনবিদ, সাংবাদিকসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই কমিটিতে যাতে শ্রমিক ও মালিক-প্রতিনিধিরাও থাকেন, তা-ও নিশ্চিত করতে হবে।
বিশ্বের অনেক দেশেই জাহাজভাঙা শিল্প নিষিদ্ধ। ইউরোপ-আমেরিকাসহ সেসব দেশের বাতিল ও বিষাক্ত জাহাজের কবল থেকে রেহাই পাওয়ার লাভজনক পথ হলো বাংলাদেশে তা বিক্রি করা। জাহাজ কেটে লোহা বের করার প্রক্রিয়ায় এসব বর্জ্য ও রাসায়নিক সাগর, মাটি ও বায়ুকে ভয়ানকভাবে দূষণ করে। অন্যদিকে জাহাজ কাটতে গিয়ে বিস্ফোরণ ও গ্যাসের শিকার হয়ে শ্রমিকদের মৃত্যু হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ কেন উন্নত বিশ্বের বাতিল জাহাজ ও বর্জ্যের ভাগাড় হবে। অন্য দিক থেকে এই শিল্পের মাধ্যমেই দেশের ইস্পাতশিল্প দাঁড়িয়ে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশের লোহা ও ইস্পাতের চাহিদাও তারা মেটাচ্ছে। সে কারণে শিল্পটির টিকে থাকাও প্রয়োজন এবং তার জন্যই প্রয়োজন একে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণ করা।
এ কারণেই উচ্চ আদালতের নির্দেশ, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় থেকে ছাড়পত্র নেওয়ার বিধান এবং পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ২০১০-এর পরিবেশসম্মত ব্যবস্থাপনাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পাশাপাশি বাতিল জাহাজ আমদানির সময় রপ্তানিকারক দেশ থেকেই সেসবের বর্জ্য পরিশোধনের নির্দেশও দেওয়া হয়। পরিবেশ ও মানুষের কম ক্ষতি করেও এই শিল্প লাভজনকভাবে চলতে পারে। উচ্চ আদালত তা-ই দেখিয়ে দিল। আইনের ফাঁকফোকর গলে যাতে কোনোভাবেই বিষাক্ত বর্জ্যবাহী জাহাজ এ দেশে আসতে না পারে, কিংবা শ্রমিকদের অনিরাপদ কর্মপরিবেশ চলতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে মন্ত্রণালয়গুলোকেই।

ইটভাটার করাল গ্রাসে কৃষিজমি, জনস্বাস্থ্য

Thursday, January 13, 2011

ঢাকার দূষিত বায়ুতে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার কারণে প্রতি তিনজন কোমলমতি স্কুলশিক্ষার্থীর মধ্যে দুজনই অ্যাজমায় আক্রান্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তাদের কেউই উত্তরাধিকার বা পারিবারিক সূত্রে শ্বাসকষ্টের রোগী নয়। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির আওতায় পরিবেশ অধিদপ্তর পরিচালিত 'ঢাকার স্কুলশিশুদের মধ্যে বায়ুদূষণের প্রভাব' শীর্ষক গবেষণায় এ ভয়াবহ তথ্য ঘোষণা করা হয়েছে।

গবেষণায় বলা হয়েছে, রাজধানীর তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণীর ১৮০ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে ৪২ দিন গবেষণা করে ১২০ জনকেই অ্যাজমায় আক্রান্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান অধ্যাপক এজাজ হোসেন বলেন, ইটভাটা থেকে নির্গত ধোঁয়ার আণবিক কণা মারাত্মক ক্ষতিকর। বাতাসে এর পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে তা মানুষের অ্যাজমাসহ নানা ধরনের জটিল রোগ সৃষ্টি করে। তিনি বুয়েটের এক গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে জানান, দেশের বায়ুদূষণের শতকরা ৩০ ভাগের জন্য দায়ী ইটভাটাগুলো।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডা. তৈমুর এ কে মাহমুদ বলেন, বায়ুদূষণ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য মারাত্দক ক্ষতিকর। এটা কোমলমতি শিশুদের জন্য বিষস্বরূপ। দূষিত বায়ুর পরিবেশে বেড়ে ওঠা মানুষ পেটের পীড়া থেকে শুরু করে কিডনি রোগসহ ফুসফুসের ক্যান্সারেও আক্রান্ত হতে পারে। মহিলারা জন্ম দিতে পারে বিকলাঙ্গ শিশু।

জাতিসংঘের গবেষণা পরিচালনায় যুক্ত পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) কাজী সারোয়ার ইমতিয়াজ হাশমী বলেন, ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা ক্রমেই ভয়াবহ হচ্ছে। সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে বায়ুদূষন রোধে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে না পারলে ভবিষ্যতে এর পরিণাম আরো ভয়াবহ হবে। বিশ্বব্যাংকের পরিবেশবিজ্ঞানী ও দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. খলীকুজ্জমান বলেন, ঢাকা মহানগরীর গাড়ির কারণে প্রায় ৭০ শতাংশ আর ৩০ শতাংশ বায়ুদূষিত হয় নগরীর আশপাশের ইটখোলার কারণে।

ফসলি মাটি যাচ্ছে ইটভাটার পেটে : সরকারি হিসাবে দেশে ইটখোলার সংখ্যা চার হাজার ৫১০। এর মধ্যে অবৈধ (পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই) এক হাজার ১৯৯টি। এসব ইটখোলায় প্রতিবছর পোড়ানো হয় তিন হাজার ২৪০ কোটি ইট। প্রতি হাজার ইটের জন্য কাঠ পোড়াতে হয় আট থেকে ১০ মণ। তবে বাংলাদেশ ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতি এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের হিসাবে দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে ইটখোলার সংখ্যা প্রায় ছয় হাজার। এসব ইটখোলার প্রতিটিতে উৎপাদন বছরে গড়ে ৭৫ লাখ ইট। এ হিসাবে ছয় হাজার ইটখোলায় উৎপাদন হয় বছরে সাড়ে চার হাজার কোটি ইট। গড় মানের সাড়ে ৯ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য, সাড়ে চার ইঞ্চি প্রস্থ ও তিন ইঞ্চি পুরুত্বের একেকটি ইটে মাটি লাগে তিন কেজি থেকে সাড়ে তিন কেজি। গড়ে তিন কেজি ধরলেও সাড়ে চার হাজার কোটি ইটে মাটি লাগে বছরে সাড়ে ১৩ হাজার কোটি কেজি বা সাড়ে ১৩ কোটি টন, যার পুরোটাই পুড়ে লাল হয়ে যায়।

ইট-শ্রমিকরা জানায়, ভূমির উপরি অংশের এক থেকে দেড় ফুট মাটি কেটে নিয়ে ইট প্রস্তুত করা হয়। ইটখোলায় ব্যবহৃত মাটির অধিকাংশই এঁটেল-দোআঁশ ও বালি-দোআঁশ (ফসলি) মাটি। কৃষিবিদ ও মৃত্তিকা গবেষকরা বলছেন, স্বাভাবিক নিয়মে জমির উপরিভাগে পলি জমে জমে এক ফুট পুরু হতে সময় নেয় তিন থেকে চার দশক। তাঁদের হিসাবে, ইটখোলা যে পরিমাণ ফসলি মাটি ধ্বংস করছে, তা বন্ধ হলে বছরে অন্তত ৫০ লাখ টন খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়ত। তাঁদের হিসাবে, ছয় হাজার ইটখোলার দখলে রয়েছে (প্রতিটি গড়ে সোয়া আট একর) প্রায় ৫০ হাজার একর আবাদি জমি। তাঁরা ইউএনডিপির আওতাধীন স্টকহোমের এনভায়রনমেন্ট ইনস্টিটিউটের গবেষক ড. প্যাট্রিক ও ড. লিসার গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে জানান, ইটখোলাসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশ বছরে দশমিক চার বিলিয়ন ইউএস ডলার (প্রায় ২৮০ কোটি টাকার ধান, গম, সয়াবিন ও আলু) সমমূল্যের কৃষি ফসল উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতি বলছে, দেশের ছয় হাজার ইটখোলায় বছরে বিনিয়োগ প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। এ খাতে কর্মসংস্থান প্রায় ২০ লাখ মানুষের। এ খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আয় বছরে প্রায় ১৭৫ কোটি টাকা, যা ক্রমে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ হারে বাড়ছে। ২০ থেকে ২৫ শতাংশ চাহিদা বাড়ায় এবং ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় বছরে যোগ হচ্ছে দেড় শ থেকে ২০০টি নতুন ইটখোলা। এদিকে পরিসংখ্যান ব্যুরো জমি কমে যাওয়ার ভয়াবহ তথ্য দিয়েছে। তারা বলছে, ১৯৮৬ সালে দেশে আবাদযোগ্য জমি ছিল ৮১ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টর। ২০০৩ সালে ৭০ লাখ ৮৭ হাজার হেক্টর। ২০০৭ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ৬৭ লাখ ৯০ হাজার হেক্টরে। এভাবে প্রতিবছর গড়ে ৬৫ হাজার হেক্টর জমি কমে গেছে। সর্বশেষ শুমারির উদ্ধৃতি দিয়ে ভূমি জরিপ অধিদপ্তর জানিয়েছে, ১৯৮৬ সালে দেশে এক কোটি ৩৮ লাখ ১৮ হাজার বসতবাড়ি ছিল। ২০০৩ সালে এ সংখ্যা হয়েছে এক কোটি ৭৮ লাখ ৪২ হাজার, আর ২০০৭ সালে প্রায় এক কোটি ৮৭ লাখ ৯০ হাজার। প্রতিবছর গড়ে দুই লাখ ৩৬ হাজার ৭০৫টি বাড়ি নির্মাণ বেড়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০ বছর পর দেশের চাষযোগ্য কৃষিজমি নেমে আসবে মাত্র ৫০ হাজার হেক্টরে। তাদের হিসাবে, ইট তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে প্রতিবছর ব্যবহার হচ্ছে লক্ষাধিক হেক্টর জমির উপরিভাগের উর্বর মাটি। এ ছাড়া ১৯৭৩ সালে আট লাখ ৩৩ হাজার হেক্টর জমি লবণাক্ত ছিল। ২০০০ সালে তা ১৮ লাখ হেক্টর ছাড়িয়েছে।

ইটখোলার লাইসেন্স বন্ধের সুপারিশ: পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. জাফর আহমেদ খান কালের কণ্ঠকে বলেন, জনবহুল এ দেশের প্রেক্ষাপটে ইটখোলা খুবই ক্ষতিকর। ইটখোলার প্রভাবে শুধু কৃষিজমিই কমছে না, ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়ছে পরিবেশের ভারসাম্য। সব দিক বিবেচনায় নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ইটখোলার লাইসেন্স প্রদান বন্ধের সুপারিশ করা হয়েছে। এ জন্য বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিনিয়তই চাপের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তিনি জানান, অবৈধ ইটখোলার মালিকদের ৩১ আগস্টের মধ্যে সরকারি ছাড়পত্র নিতে বলা হয়েছে; যদিও এরই মধ্যে ইটখোলায় নির্বিচারে কাঠ পোড়ানো এবং ক্ষতিকর পদার্থ নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণে পদস্থ কর্মকর্তা, ইটখোলার মালিক ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ১২ সদস্যের 'ন্যাশনাল ব্রিক অ্যাডভাইজরি কমিটি' নামের একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি ইটখোলা স্থাপন, ইট পোড়ানোর পদ্ধতি আধুনিকায়নের পদক্ষেপ, ইটখোলাগুলোর গৃহীত কার্যক্রম এবং আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, অবৈধ ইটখোলাগুলোকে পরিবেশগত ছাড়পত্র নেওয়ার জন্য ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে শিগগিরই গণবিজ্ঞপ্তি জারি হবে। তাঁরা বলেছেন, ইট পোড়ানো (নিয়ন্ত্রণ) আইনের ৫ ধারায় ইট পোড়াতে কাঠ ব্যবহার সম্পূর্ণ পরিহার এবং বায়ুদূষণকারী উচ্চ সালফারযুক্ত কয়লা ব্যবহারও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রাখা হয়েছে আইন অমান্যকারীদের এক বছরের কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান। কিন্তু এ দেশের অধিকাংশ ইটখোলার প্রধান জ্বালানি কাঠ ও সালফারযুক্ত নিম্নমানের কয়লা। কর্মকর্তাদের অভিযোগ, ইটখোলার মালিকদের অধিকাংশই প্রভাবশালী। তারা অর্থের বিনিময়ে স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে দুর্দান্ত দাপটে ক্রমাগত পরিবেশদূষণসহ কৃষিজমি ধ্বংস করে চলছে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এ সাত্তারের তত্ত্বাবধানে করা এক গবেষণা প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের গবেষণা কর্মকর্তা মো. তহিদুল ইসলাম জানান, ইটখোলার নির্গত ধোঁয়ায় নাইট্রোজেন ও সালফার ডাই-অক্সাইড মিলে ওজোন নামের গ্যাস তৈরি করে, যা পাতাজাতীয় ফসলের সরাসরি ক্ষতি করে। পাতা ফুটো করে দাগ দাগ হওয়াসহ গাছকে রোগাক্রান্ত করে ফেলে। এতে গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে ও প্রয়োজনীয় খাবার শোষণে ব্যর্থ হয়। ফলে ফসল আকারে ছোট হয়, উৎপাদন কমে যায় অন্তত ১৫ থেকে ২০ শতাংশ।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. জহুরুল করিম বলেন, কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের ফসলি জমির পরিমাণ খুবই সীমিত। মৃত্তিকা সম্পদ সহজে নষ্ট করা গেলেও তা পুনরুদ্ধার খুবই কঠিন। ইট তৈরিতে মাটির উপরি অংশ ব্যবহৃত হয়। আর ফসলেও পুষ্টি জোগায় ওপরের ছয় ইঞ্চি মাটি। তিনি বলেন, ইটখোলার ধোঁয়া, ধুলাবালির কারণে আবহাওয়া ঘোলাটে থাকে। ফসলি গাছ খাদ্য গ্রহণে ব্যর্থ হয়। ফলে উৎপাদন কমে। কৃষি ও পরিবেশের দিক বিবেচনায় নিয়ে পৃথিবীর বহু দেশ মাটি পুড়িয়ে ইট উৎপাদন বন্ধ করেছে। অথচ অবৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিতে বাংলাদেশে ইট উৎপাদন বাড়ছেই।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহসভাপতি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, 'আমাদের দেশের ইটখোলায় ব্যবহৃত কয়লার অধিকাংশই ভারতের মেঘালয় থেকে আমদানি করা, যা অত্যন্ত নিম্নমানের। এগুলো ব্যবহারে সালফার নির্গত হয় ৭ থেকে ১০ শতাংশ।' তিনি বলেন, জ্বালানি ব্যবহারের দিক থেকে বিবেচনা করলে দেশের প্রায় সব ইটখোলাই নিয়ম ভঙ্গ করছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দ রেজোয়ানা হাসান বলেন, পরিবেশ আইনে ইটখোলা স্থাপনে বসতি ও বনভূমি থেকে যে দূরত্বের কথা বলা আছে, তা মানা হচ্ছে না। নিষিদ্ধ জ্বালানি ব্যবহারসহ নানা দিকে আইন অমান্য করলেও ইটখোলার মালিকদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে না। বাংলাদেশ ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতির মহাসচিব মাইজউদ্দিন বলেন, 'অবৈধ ইটখোলাগুলোর বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থাই নেওয়া হোক, আমরা এর পক্ষে আছি।' তিনি বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশেই এসব অবৈধ ইটখোলা চালানো হচ্ছে। তিনি দাবি করেন, উন্নত বিশ্বের মতো পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে ইট পোড়ানোর চেষ্টা চলছে। তবে ইটখোলার মালিকরা সম্প্রতি ট্রেড লাইসেন্স, টিন, আয়কর, ভূমি উন্নয়ন কর, বিএসটিআই, ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ নানা ক্ষেত্রের অন্তহীন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তিনি জানান, দেশে এক লাখ আট হাজার থেকে এক লাখ ২৪ হাজার ঘনফুট আয়তনের এক সেকশন, দেড় ও দুই সেকশন ইটখোলার সংখ্যা বেশি। এসব ইটখোলায় বছরে প্রায় সাত মিলিয়ন টন কয়লা পুড়ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. জাফর আহমেদ খান বলেন, ইট পোড়ানোর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায় থেকে সবাইকে অবগত করতে হবে। পরিবেশের ক্ষতি করে এমন প্রতিষ্ঠান যাতে অর্থ সহায়তা না পায়, সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে।

রাজধানীর মোহাম্মদপুর-বছিলা হয়ে পশ্চিম দিকে এগোলেই পোড়া মবিলের মতো দেখতে দুর্গন্ধযুক্ত কালো পানির ছোট খাল। কোথাও হাঁটু, কোথাও কোমরপানির খালটি পেরোলেই শলমাসি, ওয়াসপুর ও আটিগ্রাম। গ্রামগুলো ঘনবসতিপূর্ণ। গ্রামের দুই পাশে অসংখ্য ইটখোলা। বাড়ির উঠানেও ইটখোলা। মাথা তুলে দাঁড়ানো অধিকাংশ চিমনির মুখ থেকে নির্গত হচ্ছে কালো ধোঁয়া। উড়ন্ত ধোঁয়া, ধুলোবালি ও দুর্গন্ধে শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়া কষ্টকর।

আটিগ্রামের চল্লিশোর্ধ্ব কৃষক সোলাইমান আলী, মোশারফ হোসেন ও সামছুল জানান, পাঁচ বছর আগেও এসব মাঠে এত বেশি ইটখোলা ছিল না। সে সময় এ মাঠে গম, পেঁয়াজ, আলুর চাষ হতো। এখন তেমন জমি নেই বললেই চলে। ইটখোলার ফাঁকে ফাঁকে খণ্ড খণ্ড প্লটে দুই বছর ধরে কিছু ফসল উৎপাদনের চেষ্টা করেও লাভ হচ্ছে না। কারণ, ইটখোলার কালো ধোঁয়া আর ইট বহনকারী ট্রাকের ধুলায় ফসলের মাথা ঢেকে যায়। ফলে ফসলের গাছ অঙ্কুরেই মারা যায়। তাঁরা জানান, এসব মাঠে এখন চাষের জমি নেই বললেই চলে। ইট তৈরির প্রয়োজনে জমির ওপরের অংশের মাটি ইটখোলার মালিকরা কিনে নিচ্ছেন। পাশের শলমাসি গ্রামের একসময়ের কৃষক (এখন দিনমজুর) লুৎফর রহমান বলেন, 'ফসল হয় না, তাই জমি চাষ করি না। ১০ কাঠা জমির মাটি দেড় ফুট গভীর করে নগদ ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়েছি।' একই ধরনের তথ্য জানান তিন গ্রামের অসংখ্য মানুষ।

আটিগ্রামের দিনমজুর আইয়ুব আলী জানান, তাঁর আট বছরের ছেলে আমিন বছিলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। তিন বছর ধরে আমিনের শরীরে খোসপাচড়া লেগেই আছে। এখন প্রায় সারাক্ষণই হাত-পা ও শরীর চুলকায়। তার তিন বছরের মেয়ে আমেনাও হয়েছে প্রতিবন্ধী (এক পা অসম্পন্ন)। সাইফুল, কায়েম, মধু, সালেকসহ অনেকেই জানান, এ গ্রামের অধিকাংশ শিশু রোগাক্রান্ত। লালুর ছয় বছরের ছেলে ফাহিম, মজিদের ১০ বছরের মেয়ে সকিনা, মোহাম্মদ আলীর সাত বছরের মেয়ে করুণার মতো অনেকেই শ্বাসকষ্ট রোগে ভুগছে।

এলাকাবাসী জানায়, বছরের অন্যান্য সময় কিছুটা কম হলেও অক্টোবর-নভেম্বর থেকে মার্চ-এপ্রিলের প্রায় ছয় মাস এ এলাকায় টিকে থাকা কষ্টকর হয়। এ সময় আর্থিক অবস্থা ভালো এমন অনেকেই এলাকা ছেড়ে যান। রাজধানী ঘিরে দেড় হাজার ইটখোলা: জনবসতির তিন কিলোমিটারের মধ্যে ইটখোলা নির্মাণ নিষিদ্ধ থাকলেও রাজধানী ঘিরে গড়ে উঠেছে প্রায় দেড় হাজার ইটখোলা। এসব ইটখোলায় পোড়ানো নিম্নমানের কয়লা, টায়ার, প্লাস্টিক ও রাবারের টুকরার নির্গত কালো ধোঁয়া প্রতিনিয়তই দূষিত করছে ঢাকার বাতাস। ফলে ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকার দেড় কোটি মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ পড়ছে হুমকির মুখে। অকালমৃত্যুর শিকার হচ্ছে অসংখ্য মানুষ।

পরিবেশ অধিদপ্তরের ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট প্রজেক্টের পরিচালক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন জানান, ইটখোলা ও গাড়ির ধোঁয়ার কারণে ঢাকার বাতাসে ভাসমান অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ ভয়াবহ আকারে বাড়ছে। এসব বস্তুকণার পরিমাণ শীতকালের ১২০ দিন আরো বেশি থাকে। তিনি বলেন, জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি বিবেচনা করে প্রচলিত সনাতন পদ্ধতির ইট তৈরি পর্যায়ক্রমে বদ্ধ করে পরিবেশবান্ধব ইট ব্যবহারের পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, জনবসতির তিন কিলোমিটারের মধ্যে ইটখোলা নির্মাণ নিষিদ্ধ থাকলেও তা মানা হয়নি, এখনো হচ্ছে না। এ ছাড়া নির্ধারিত ১২০ ফুট চিমনিও অনেকে ব্যবহার করছে না। তিনি বলেন, ইটখোলা শুধু বায়ুদূষণই করছে না, সেই সঙ্গে ফসলি জমিকে নিষ্ফলা করছে। ইটখোলার কর্মচারীদের থেকে জানা গেছে, খোলায় কয়লা ও কাঠ পোড়ানো হয়। আগুনের তাপমাত্রা বাড়াতে ও দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী করতে ভারতীয় (নিম্নমান) কয়লার পাশাপাশি শত শত মণ নিষিদ্ধ টায়ার, প্লাস্টিক ও রাবারের টুকরা পোড়ানো হয়। ঝাঁজ ও দুর্গন্ধযুক্ত এসব পোড়ানোয় পুরো এলাকা ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে ছেয়ে যায়।

ইটখোলার কয়েকজন মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বীকার করেন, ইটখোলায় আগুন ধরানোর সময় কিছু কাঠ ব্যবহার করা হয়। কয়লার মজুদ ফুরিয়ে গেলেও কাঠ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আবাসন ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এসব এলাকার জমি ও ফ্ল্যাট দামে-দরে পছন্দ হলেও ইটখোলার ধোঁয়ার কারণে অনেকেই কিনতে আগ্রহী হয় না।

রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইবিসিআর) ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুসতাক হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ঢাকার বাতাসে মিশে থাকা কার্বন পার্টিকেল, সালফার, নাইট্রোজেনসহ অন্যান্য রাসায়নিক উপাদান মানবদেহের ভয়াবহ ক্ষতি করে। দূষিত বায়ুতে নিয়মিত শ্বাস-প্রশ্বাস নিলে নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস, হৃদরোগ, শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগ, লিভার ও কিডনি অকেজোসহ মূত্রথলি ও খাদ্যনালি ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে। এ ছাড়া নতুন নতুন রোগেরও উপসর্গ দেখা দেয়। এতে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন ঘটে, যা ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের পরিবেশবিজ্ঞানী ড. এম খলীকুজ্জমান বাংলাদেশে বছরে সাড়ে ১২ শতাংশ মৃত্যুর ঘটনা পরিবেশগত কারণে ঘটে উল্লেখ করে বলেন, পরিবেশগত স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমানো গেলে জাতীয় আয়ের সাড়ে ৩ শতাংশ অর্থনৈতিক সুবিধা ভোগ করা সম্ভব। গবেষণার উপাত্ত তুলে ধরে তিনি বলেন, রাজধানীতে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বছরে এক হাজার ২০০ থেকে তিন হাজার ৩০০ মৃত্যু এড়ানো এবং আট কোটি মানুষের গুরুতর অসুস্থতা রোধ করা সম্ভব। এতে জাতীয় আয়ের দশমিক ৩৪ শতাংশ থেকে ১ শতাংশ সাশ্রয় হতে পারে। এ ছাড়া বায়ুদূষণের কারণে সারা দেশে বছরে সাত হাজার ৬০০ থেকে ৩০ হাজার ৪০০ মৃত্যু এড়ানো এবং তিন লাখ থেকে ১২ লাখ পর্যন্ত মানুষের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ সম্ভব। এতে ১১৪ থেকে ৪৫৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সাশ্রয় সম্ভব, যা জাতীয় আয়ের দশমিক ২৩ শতাংশ থেকে দশমিক ৯২ শতাংশ।

জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক আসিফ মুজতবা মাহমুদ বলেন, বায়ুদূষণের কারণে নবজাতক, শিশু, বয়স্ক এবং হুদরোগে আক্রান্তরা সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে থাকে। এতে শিশুরা হাঁপানি ও ব্রঙ্কাইটিসসহ অন্যান্য শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত হয়।

ইটের বিকল্প 'কংক্রিট ব্লক' চালু করার উদ্যোগ নেই
সনাতন পদ্ধতির ইটভাটা পরিবেশদূষণের পাশাপাশি কৃষিজমি ক্রমাগত গ্রাস করে চললেও ইটের বিকল্প পরিবেশবান্ধব ও দামে সস্তা 'কংক্রিট ব্লক' চালুর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। ফলে বিকল্প ইট তৈরির জন্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগকারী শিল্পোদ্যোক্তারা হতাশায় পড়েছেন।

জানা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও ১৯৯৯ সাল থেকে কংক্রিটের ব্লক নির্মাণকাজে ব্যবহার শুরু হয়েছে। বসুন্ধরা, কনকর্ড, আলফা, রূপসী, স্কাইভিউ, মীরসহ অর্ধশত প্রতিষ্ঠান হলো ও সলিড কংক্রিটের সিলিং, পেডিং ব্লক, কার্ব স্টোনসহ পরিবেশবান্ধব ইট তৈরি ও বিপণন করছে। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে প্রচারণা না থাকায় এর কার্যক্রম প্রসারিত হচ্ছে না। পরিবেশ অধিদপ্তরের ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট প্রজেক্টের পরিচালক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বলেন, ইটখোলার নির্গত কালো ধোঁয়া বায়ুদূষণের পাশাপাশি পরিবেশের মারাত্দক বিপর্যয় ডেকে আনছে। তিনি বলেন, পরিবেশ সংরক্ষণের প্রয়োজনেই কংক্রিট ব্লকের ব্যবহার বাড়ানো জরুরি এবং এটা সময়ের দাবি।

কনকর্ড গ্রুপের রেডিমিক্স অ্যান্ড কংক্রিট প্রোডাক্ট লিমিটেড, মীর রেডিমিক্স অ্যান্ড কংক্রিট প্রা. লি. ও স্কাইভিউ ফাউন্ডেশনের একাধিক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, পোড়ামাটির ইট বাংলাদেশের জন্য যুগোপযোগী নির্মাণসামগ্রী নয়। এর তৈরি প্রক্রিয়া একদিকে যেমন পরিবেশবিধ্বংসী, অন্যদিকে দামেও বেশি। অথচ কংক্রিটের সলিড ও হলো ব্লক আধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি পরিবেশবান্ধব নির্মাণসামগ্রী। এর ব্যয়ও ইটের তুলনায় অর্ধেকেরও কম এবং স্থাপনা দীর্ঘস্থায়ী। কংক্রিট ইট পরিবেশ সংরক্ষণ ও ভূমিকম্প প্রতিরোধক। তাঁরা বলছেন, শুধু প্রচারণার অভাবে কংক্রিট ব্লকের বিকাশ ঘটছে না। অথচ এ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ শতকোটি টাকার বেশি। সরকার ইচ্ছা করলেই বিশেষ নির্দেশনায় সরকারি স্থাপনাগুলোতে কংক্রিট ব্লক ব্যবহার করতে পারে।

জানা যায়, কংক্রিট ব্লকের স্থাপনা হালকা হওয়ায় লোহার রড ও প্লাস্টার-গাঁথুনিতে সিমেন্ট-বালু কম লাগে। ইলেকট্রিক লাইন স্থাপন সহজ হয়। তাপ ও শব্দ প্রতিরোধক হওয়ায় ঘর তুলনামূলক শীতে গরম ও গরমে ঠাণ্ডা থাকে। অল্প সময়ে নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয়। কংক্রিটের ব্লক বিভিন্ন আকৃতির করা যায়। বেশি পরিচিত হিসেবে কাজে লাগে ১৬ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য, ৮ ইঞ্চি প্রস্থ এবং ৪ ও ৬ ইঞ্চি পুরুত্বের হলো ব্লক, যা একটি ইটের প্রায় তিন গুণ। কংক্রিট ব্লকের অন্যতম কাঁচামাল নুড়িপাথর, বালু ও সিমেন্ট। অন্যদিকে ইটের কাঁচামাল কৃষিজমির উপরিভাগের উর্বর ফসলি মাটি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে প্রতিষ্ঠিত অর্ধশত কারখানায় কংক্রিট ব্লক উৎপাদনের ক্ষমতা বছরে প্রায় এক হাজার কোটি ইটের সমান। কংক্রিট ব্লকের ব্যবহার বাড়লে পোড়ামাটির ইটের চাহিদা কমে আসবে। পরিবেশ-গাছপালা ধ্বংস হবে না। আবাদি জমি কমবে না। পঙ্গু-রোগা শিশু জন্ম নেবে না।

জানা যায়, বিশ্বের প্রায় সব দেশেই কংক্রিট ব্লক ব্যবহৃত হচ্ছে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে একচেটিয়া। বাংলাদেশের বেশ কিছু খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানে কংক্রিট ব্লক ব্যবহৃত হয়েছে। এর মধ্যে বসুন্ধরা পেভিং ব্লক দিয়ে করা হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার ইয়ার্ড, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রাস্তা, রাজশাহী শিশুপার্ক উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া সিলিং ও হলো ব্লকে নির্মিত হয়েছে রাজধানীর ওয়েস্টিন হোটেল, ঢাকা ও চট্টগ্রামের ইউএসটিসি ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা। বসুন্ধরা টেকনোলজিস লিমিটেডে তৈরি হচ্ছে পেভিং ও হলো ব্লক, কনকর্ড রেডিমিক্স অ্যান্ড কংক্রিট প্রা. লি. সিলিং ব্লক, আলফা রেডিমিক্স অ্যান্ড কংক্রিট প্রা. লি. পেভিং ব্লক, রূপসী রেডিমিক্স অ্যান্ড কংক্রিট প্রা. লি. কার্ব স্টোন, মীর রেডিমিক্স অ্যান্ড কংক্রিট প্রা. লি. সলিড ব্লক, স্কাইভিউ ফাউন্ডেশন। এদিকে ইটখোলার মালিকদের অনেকেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ইটখোলা পরিবেশ দূষণ করছে, এটা ঠিক; কংক্রিট ব্লকের ব্যবহার বাড়লে এ দূষণ কিছুটা কমবে।

সানমুন কম্পানির ম্যানেজার (মার্কেটিং) জাহিদুল ইসলাম বলেন, 'বিশ্বব্যাপী পরিচিত কংক্রিটের ব্লক আমাদের দেশে বেশি পরিচিত হতে পারেনি। সরকার উদ্যোগ নিলে এ শিল্পের বিকাশ সহজেই ঘটাতে পারে। বিশ্বব্যাংকের ৪৩৫ কোটি টাকা হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা বাংলাদেশে বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ হিসেবে ইটখোলা ও পরিবহন খাতকে চিহ্নিত করে ঢাকা ও এর আশপাশের শহরগুলোর বায়ুদূষণ কমিয়ে স্বাস্থ্যসম্মত শহর গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিশ্বব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ গত বছরের ১২ এপ্রিল ৬২ দশমিক ২০ মিলিয়ন ডলারের একটি প্রকল্প অনুমোদন করে। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যই ছিল বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করা। কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশের পরিবেশের ক্ষতি করে বানানো ইট ভারতে রপ্তানি করার কারণে বিশ্বব্যাংকের অনুদানের প্রায় ৪৩৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা হাতছাড়া হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, এরই মধ্যে বাংলাদেশের পরিবেশ নষ্ট করে ইট রপ্তানির বিষয়ে জানতে চেয়েছে বিশ্বব্যাংক।

ইট রপ্তানির কারণে পরিবেশ দূষণ রোধে বিশ্বব্যাংকের এ কার্যক্রম পরিকল্পিতভাবে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে কি না তা ক্ষতিয়ে দেখার জন্য পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদকে অনুরোধ জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী এ কে এম মাঈদুল ইসলাম। গত ২৪ আগস্ট পরিবেশ প্রতিমন্ত্রীকে লেখা এক চিঠিতে তিনি বলেছেন, ইট উৎপাদন করে কৃষিজমি নষ্ট করবে না বলে ভারত আমদানির পক্ষে কাজ করছে। আর বাংলাদেশ কৃষিজমি ও পরিবেশ নষ্ট করে ইট রপ্তানি করছে। এ ক্ষেত্রে রপ্তানি আয়কেও মুখ্য করে তুলে ধরায় বিভান্তিকর নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ কে এম মাঈদুল ইসলাম ক্ষোভের সঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এ দেশে ভালো কাজ করা যাবে না। ভালো কাজের জন্য পদেক্ষপ নিলে সেটাও অনেকের কাছেই অন্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। আর ইটখোলার মালিকদের মতো যাদের টাকা বেশি তাঁদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শুধু নিজেকেই কালার করা হয়।'

জানা যায়, বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় পরিবেশ অধিদপ্তর ইটখোলার মাধ্যমে বায়ুদূষণ রোধে ১২৩ কোটি টাকার 'টেকনোলজি চেঞ্জ' করার উদ্যোগ নিয়েছে। ভারতে ইট রপ্তানি : বাংলাদেশের ফসলি জমির উর্বর মাটি পুড়িয়ে তৈরি করা ইট ভারতে রপ্তানি শুরু হয়েছে। গত বছরের ২০ আগস্ট ভারতের ত্রিপুরায় প্রথমবারের মতো আখাউড়া বন্দর দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ইট রপ্তানির কনসাইনমেন্ট উদ্বোধন করেন বাণিজ্যমন্ত্রী লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ত্রিপুরার শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী জিতেন্দ্র চৌধুরী। গত সপ্তাহ পর্যন্ত ইট রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার মে. টন। প্রতিটনের গড় মূল্য সাড়ে ৪১ হাজার টাকা হিসেবে মোট মূল্য দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০ কোটি টাকা।

ইট রপ্তানির আগে গত ১৯ আগস্ট মতিঝিলের ফেডারেশন চেম্বারে ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে নতুন এই পণ্যের রপ্তানির সম্ভাবনা তুলে ধরে ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট ও নিটল গ্রুপের স্বত্বাধিকারী আবদুল মাতলুব আহমাদ জানান, ত্রিপুরার দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় ইট উৎপাদনে খরচ বেশি পড়ায় সেখানে বাংলাদেশি ইটের ব্যাপক চাহিদা। ত্রিপুরা সীমান্ত-সংলগ্ন বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা ও সিলেটে প্রচুর ইটখোলা রয়েছে। ত্রিপুরার ব্যবসায়ীরা এসব এলাকা থেকে ইট নিতে আগ্রহী। তাঁরা প্রতিটি ইটের দাম সাত টাকা করে দিতে এবং বছরে প্রায় ২৮০ কোটি টাকা মূল্যের ৪০ কোটি পিস ইট নিতে চায়। তাঁর মতে, ইট রপ্তানির সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি বছরে ৩০০ কোটি ডলার কমাতে সহায়তা করবে। এর আগে থেকে ত্রিপুরাসহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অঙ্গরাজ্যে বাংলাদেশের উৎপাদিত সিমেন্ট, প্লাস্টিক পাইপ, সিরামিক ফার্নিচারসহ বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। তিনি অবশ্য বলেন, বাংলাদেশি যেসব ইটখোলার মালিক পরিবেশসম্মতভাবে ইট তৈরি করবেন, কেবল তাঁরাই রপ্তানির সুযোগ পাবেন। বায়ুদূষণ-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে মাতলুব আহমাদ বলেন, যেকোনো শিল্প স্থাপন করলে দূষণ হবে। কিন্তু দেখতে হবে দূষণের মাত্রা কত? বেশি হলে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিতে হবে।

তিন মন্ত্রীর ভাষ্য: কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, 'ইট রপ্তানি হোক--এটা আমিও চাই। তবে কৃষি ও পরিবেশ নষ্ট করে নয়।' তিনি জানান, ইট রপ্তানির আগে কৃষি মন্ত্রণালয়ের মতামত চাওয়া হলে তাতে তিনি বলেছিলেন, 'ইছামতীর ওপারে ভারত ৫২টি ইটখোলার জন্য নদী থেকে মাটি তুলে ইট বানাচ্ছে। বাংলাদেশের ইটখোলার মালিকরা যদি তাঁদের মতো (সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে) নদী থেকে ড্রেজারের সাহায্যে এঁটেল মাটি তুলে ইট বানাতে পারে, তাহলে রপ্তানিতে আপত্তি নেই। কারণ এতে নদীর খননও হয়, আবার বৈদেশিক আয়ও বাড়ে। তিনি আরো জানান, কৃষি মন্ত্রণালয় এখন উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টায় মাঠপর্যায়ে কাজ করে যাচ্ছে। ইটখোলার মালিকদের অনিয়মের বিরুদ্ধে মামলা করার সময় নেই। মন্ত্রী বলেন, 'মাটির টপ সয়েল কাটলে আমি আহত হই।'

ইট রপ্তানির ফলে একদিকে পরিবেশ দূষণ, অন্যদিকে কৃষি জমি ধ্বংস_পরিবেশবাদীদের এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান বলেন, সরকারের আয় বাড়ানোর চিন্তা থেকেই ইট রপ্তানি শুরু করা হয়েছে। দেশের ইটখোলাগুলো পরিবেশ আইনের আলোকেই পরিচালিত হচ্ছে। পরিবেশ দূষণ যাতে না হয় সেদিকেও দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। পরিবেশ দূষণকারী ইটখোলার মালিকদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে জেলা প্রশাসকরা ব্যবস্থা নিচ্ছেন। পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী ডা. হাছান মাহমুদ বলেন, ইটখোলার কালো ধোঁয়া পরিবেশের ক্ষতি করে। তবে পরিবেশ নীতিমালার আওতায় ইটখোলা পরিচালিত হলে এ ক্ষতি কমে আসতে বাধ্য। কালো ধোঁয়া রোধে জিগজ্যাগ ও হোপক্লিনস ব্যবহারের কঠোর নির্দেশনা সম্প্রতি মাঠপর্যায়ে দেওয়া হয়েছে। শিল্পায়নের প্রয়োজনে ইটখোলা লোকালয় থেকে দূর করতে বলা হয়েছে। তিনি মনে করেন, দেশে যে পরিমাণ ইটখোলা রয়েছে তার প্রয়োজন নেই। বরং ইটখোলার সংখ্যা কমিয়ে সেগুলোতে পরিবেশসম্মত পদ্ধতিতে উৎপাদন আরো বাড়ানো যেতে পারে। তিনি বলেন, কৃষি ও পরিবেশ রক্ষার প্রয়োজনে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো কংক্রিট ব্লকের ব্যবহার বাড়ানো উচিত।

কক্সবাজার সৈকত এলাকা থেকে সব স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ

Monday, January 10, 2011

হাইকোর্ট কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত এলাকা থেকে স্থায়ী-অস্থায়ী সব স্থাপনা উচ্ছেদ করার নির্দেশ দিয়েছেন। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে এ নির্দেশ দিয়ে এই বিষয়ে আগামী সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতেও বলা হয়েছে।

একই সঙ্গে আদালত সমুদ্রসৈকত এলাকার সীমানা নির্ধারণে একটি বিশেষ কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন। দখল রোধে নজরদারির ব্যবস্থা করতে পুলিশ সুপারকে বলা হয়েছে।
আজ সোমবার বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ জনস্বার্থে দায়ের করা এক রিটের প্রাথমিক শুনানি শেষে এ আদেশ দেন।
কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকত এলাকায় স্থাপনা নির্মাণ বন্ধে ও নির্মিত স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশনা চেয়ে জনস্বার্থে রিটটি করা হয়। মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে চারজন আইনজীবী রিটটি করেন।
আদালত দীর্ঘতম এ সমুদ্রসৈকত এলাকা দখলমুক্ত করে স্থাপনা নির্মাণ বন্ধে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, জানতে চেয়ে সরকারের প্রতি রুল জারি করেছেন। আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে পরিকল্পনা সচিব, অর্থসচিব, বনসচিব, স্থানীয় সরকার সচিব, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, ৫ জানুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিকে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত এলাকায় স্থাপনা নির্মাণ করে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট করা হচ্ছে—এমন একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনটি যুক্ত করে জনস্বার্থে রিট করা হয়।
আদালতে আবেদনকারীর পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন মনজিল মোরসেদ। আর সরকার পক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ বি এম আলতাফ হোসেন।
 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. XNews2X - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু