Home » , , » মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী...

মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী...

Written By Unknown on Thursday, May 26, 2011 | 4:12 AM

তিনি এসেছিলেন বাংলা কাব্যের অঙ্গনে সম্পূর্ণ নতুন সুর আর কণ্ঠস্বর নিয়ে। দিয়েছিলেন বাংলা গানের এক নতুন ভুবনের সন্ধানও। তিনি মহাবিদ্রোহী, বিষণ্ন, তীব্র রোমান্টিক কবি কাজী নজরুল ইসলাম। 'জ্যৈষ্ঠের ঝড়' হয়ে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন তিনি বাংলা কাব্যের প্রচলিত অঙ্গন। 'বিদ্রোহী' কবিতার অভূতপূর্ব উচ্চারণে চমকে দিয়েছিলেন সমগ্র উপমহাদেশ।
'মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তূর্য'_ এই বিস্ময়কর দ্বৈতসত্তায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী এবং মানবতায় হৃদয় সংবেদী প্রেমিক জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন আজ। সব সংকীর্ণতার দেয়াল ভেঙে বাংলা সাহিত্যে নতুন কাব্যধারা সৃষ্টি করেছিলেন যিনি, সেই চিরবিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন জাতীয় পর্যায়ে উদযাপন শুরু হচ্ছে আজ। আজ থেকে ১১২ বছর আগে ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ এক ঝড়ের রাতে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্ম নিয়েছিলেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সাহিত্য সমালোচকরা তাকে যথার্থই 'জ্যৈষ্ঠের ঝড়' আখ্যা দিয়েছিলেন। কারণ ঝড়ের মতোই সবকিছু ওলটপালট করে দিয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। ব্রিটিশ ভারতের ঔপনিবেশিক শাসনের শৃঙ্খল ছেঁড়ার দৃঢ় অঙ্গীকারের পাশাপাশি তার কাব্যে মূর্ত হয়ে উঠেছিল অসাম্প্রদায়িক, ভেদাভেদহীন এমন এক মানবিক সমতার সমাজ গড়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা, যে সমাজে মানুষের পরিচয় হবে ধর্ম-বর্ণ, ধনী-দরিদ্রের সকল ভেদাভেদের ঊধর্ে্ব। তাই মুক্তিকামী মানুষের আকাঙ্ক্ষার কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়েছিল তার উচ্চারণ। নজরুল এক আশ্চর্য প্রতিভা! একদিকে প্রেমিক, অন্যদিকে বিদ্রোহী; 'এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তূর্য।' কী কবিতায়, কী গানে, উপন্যাসে, গল্পে, সাংবাদিকতায় তথা সম্পাদকীয় নিবন্ধে, প্রবন্ধে_ সর্বত্রই মানবমুক্তির প্রেমময় বাণী, দ্রোহের বাণী ঝঙ্কৃত হয়েছে তার সৃষ্টিতে।
বাংলা কাব্যে নতুন যুগের স্রষ্টা কাজী নজরুল ইসলাম প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সৈনিক হয়ে যে দীপ্র তারুণ্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন, সেই তারুণ্যই শতদল হয়ে ফুটেছিল তার সাহিত্যিক জীবনে। ১৯২১ সালের শেষ দিকে যখন 'বিদ্রোহী' কবিতা লেখেন (১৯২২ সালে প্রকাশিত), তখনই বাংলা কবিতায় চিরকালের জন্য অমর হয়ে গিয়েছিল তার আসন। প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'অগি্নবীণা' আগুনের হল্কা ছড়িয়ে দিয়েছিল শোষিত-বঞ্চিত সমাজে। তিনি বিদ্রোহ করেছিলেন পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিঁড়তে, হিন্দু-মুসলিম বিরোধ আর সংকীর্ণতার পাষাণ প্রাচীর ভাঙতে এবং শাসন-শোষণমুক্ত মানবিক সমাজ গঠনের স্বপ্নে। অগি্নবীণা, বিষের বাঁশী, ধূমকেতু প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল ইংরেজ শাসকদের। একের পর এক নিষিদ্ধ হতে থাকে তার কাব্যগ্রন্থ; কিন্তু প্রতিজ্ঞায় অনড় কবির কলম থেমে থাকেনি। কারাগারেও গেয়েছেন 'ভাঙার গান'। চিরকালের মানবমুক্তির বাণীবাহক নজরুলের পক্ষেই লেখা সম্ভব হয়েছিল 'মহা_ বিদ্রোহী রণক্লান্ত,/আমি সেই দিন হব শান্ত,/যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,/অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না_।'
'দারিদ্র্য'কে নতুন মাত্রায় উত্তীর্ণকারী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি দারিদ্র্যের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছিলেন 'অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস...।' হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ঐক্যের মহামন্ত্রে অবিভক্ত ভারতবর্ষকে তিনি সাম্প্রদায়িকতামুক্ত করার সাধনায় সমাজ সংস্কারকের ভূমিকাও পালন করেন। সমাজতান্ত্রিক আদর্শে উজ্জীবিত হয়েও ইসলামী ঐতিহ্য আর হিন্দু পুরাণের অভূতপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়ে 'সবার উপরে মানুষ সত্য' এই অনন্য দর্শন প্রতিষ্ঠা করে সবার হৃদয়ে মানবতার কবি হিসেবে অমর হয়ে আছেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তার কবিতা ও গান অনন্য প্রেরণা জুগিয়েছে। স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবল্পুব্দ শেখ মুজিবুর রহমান তাকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন নাগরিকত্ব দিয়ে। বাংলাদেশের প্রধান বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণেই হয়েছে তার শেষশয্যা।
কবির জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে আজ সকালে কবির সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া। বাংলা একাডেমী, নজরুল ইনস্টিটিউট, নজরুল একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমীসহ নানা সাংস্কৃতিক সংগঠন দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি উদযাপন করবে। বিটিভি ও বেতারসহ দেশের বেসরকারি টেলিভিশন ও এফএম রেডিও স্টেশনগুলো দিবসটি উপলক্ষে নানা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে। জাতীয় দৈনিকগুলো প্রকাশ করেছে বিশেষ সংখ্যা।
নজরুলজয়ন্তীর কর্মসূচি হিসেবে আজ ময়মনসিংহের ত্রিশাল ও কুমিল্লার দরিরামপুরে তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠানমালা শুরু হচ্ছে। নজরুল স্মৃতিবিজড়িত ত্রিশালে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শুরু হচ্ছে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা। সেমিনার, আলোচনা সভা, সঙ্গীতানুষ্ঠানসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে খ্যাতনামা শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের অংশগ্রহণে মুখর হয়ে উঠবে ত্রিশালের দরিরামপুর।
রাষ্ট্রপতির বাণী : রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান তার বাণীতে বলেছেন, নজরুল বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাসে এক শাশ্বত দিকপাল, উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি একাধারে সংগ্রামী, সমাজ সংস্কারক, জাতীয়তাবোধের ধারক, প্রেমের পূজারি, সাম্য ও শান্তির বাহক।
প্রধানমন্ত্রীর বাণী : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেছেন, তিনি 'বিদ্রোহী কবি', আধুনিক বাংলা গানের 'বুলবুল'। তার শিকল ভাঙার গানে সে সময়কার ঝিমিয়ে পড়া বাঙালি সমাজ জেগে উঠেছিল। তার সাহিত্যকর্ম মানব অনুভূতির গভীরে প্রোথিত হয়ে নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্য বিশ্ববিবেককে নাড়া দিয়েছিল।
বিরোধী দলের নেতার বাণী : বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়া তার বাণীতে বলেন, বাংলা সাহিত্যের এ কালজয়ী পুরুষকে জাতীয় কবি হিসেবে পেয়ে আমরা গর্বিত। বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব শাখা তার সৃষ্টির পরশে ঐশ্বর্যমণ্ডিত হয়েছে।
সরকারি-বেসরকারি অনুষ্ঠানমালা : রাজধানীসহ সারাদেশে সরকারি পর্যায় ছাড়াও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন নজরুলজয়ন্তী পালন করবে। সকাল সাড়ে ৬টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে কবির সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে শুরু হবে দিনের অনুষ্ঠানমালা। ত্রিশালে কবির জন্মবার্ষিকীর মূল অনুষ্ঠান হবে। কুমিল্লার দৌলতপুর ও চট্টগ্রাম শহরে যথাযথ মর্যাদায় নজরুল জন্মজয়ন্তী পালনের লক্ষ্যে নানা কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। নজরুলের স্মৃতিধন্য জেলাগুলো ছাড়াও দেশের সব জেলায় কবির জন্মবার্ষিকী উদযাপন করবে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন। আজ সকালে রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান কবির স্মৃতিধন্য ময়মনসিংহের ত্রিশালে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন করবেন। অনুষ্ঠানমালায় রয়েছে আলোচনা ও কবির সাহিত্যকর্মের পরিবেশনা।
আওয়ামী লীগ : সকাল ৮টায় জাতীয় কবির মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবে আওয়ামী লীগ। দলের সাধারণ সম্পাদক এলজিআরডিমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম যথাযোগ্য মর্যাদায় কবির জন্মদিন পালনের জন্য দল, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মী-সমর্থকসহ দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
বাংলা একাডেমী : জাতীয় কবির মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে শুরু হবে বাংলা একাডেমীর অনুষ্ঠানমালা। বিকেলে একাডেমীতে রয়েছে আলোচনা সভা।
শিল্পকলা একাডেমী : সঙ্গীত ও নৃত্যকলা কেন্দ্র মিলনায়তনে দু'দিনের অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন করবেন একাডেমীর মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী।
ছায়ানট : ছায়ানট তাদের নিজস্ব মিলনায়তনে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় আয়োজন করেছে সঙ্গীতানুষ্ঠান। এতে নজরুলের নাটক ও চলচ্চিত্রের গান পরিবেশিত হবে।
এছাড়া নানা আয়োজনে জন্মদিন উদযাপন করবে জাতীয় কবিতা পরিষদ, বঙ্গবন্ধু লেখক পরিষদ, বিশ্ব কবিতা কণ্ঠ পরিষদসহ নানা সংগঠন।

0 comments:

Post a Comment

 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. XNews2X - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু