Home » , , » আরব বিশ্বে গণতন্ত্রের লড়াই

আরব বিশ্বে গণতন্ত্রের লড়াই

Written By Unknown on Tuesday, February 8, 2011 | 5:55 PM

রব বিশ্ব বা মধ্যপ্রাচ্যে অসন্তোষ বহু বছরের। এ অসন্তোষের পেছনে বড় একটা কারণ গণতন্ত্রের অভাব ও স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো। গত শতাব্দীর পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে আফ্রিকা বা দক্ষিণ এশিয়ায় গণতন্ত্রের হাওয়া লাগলেও আরব বিশ্বে তা লাগেনি।

এর বড় দুটি কারণের একটি হলো_তেল বিক্রি করে পাওয়া পেট্রোডলার, যেটা আমরা সত্তরের দশক থেকে দেখছি। অন্য কারণটি হলো_স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধানদের ওপর আমেরিকার কর্তৃত্ব বা সমর্থন। আর এটা এমন পর্যায়ে চলে যাচ্ছিল যে, জনগণের অসন্তোষ প্রকাশের কোনো মাধ্যম ছিল না। কারণ পার্লামেন্ট গণতান্ত্রিক নয়, বিশেষ করে রাজতন্ত্রে তা একেবারেই ছিল না। মিডিয়া ও সিভিল সোসাইটিকেও উঠে আসতে দেওয়া হচ্ছিল না। একাডেমিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও নজরদারির মধ্যে রাখা হচ্ছিল। এর ফলে জনমনে পুঞ্জীভূত হচ্ছিল ক্ষোভ ও অসন্তোষ। আর এটাকে কাজে লাগিয়েছে মুসলিম জঙ্গিরা। এর একটি উদাহরণ আমরা দেখতে পাই নয়-এগারোতে। এখানে সৌদি আরবের অনেকে জড়িত ছিল, এমনকি ওসামা বিন লাদেনও সৌদি আরবের। তারা একই সঙ্গে নিজেদের সরকার ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিল।
এভাবে আরব বিশ্বে গণতান্ত্রিক কাঠামোটিকে আটকে রাখার ফলে ইসলামী মৌলবাদী বা জঙ্গিরা এর সুযোগ গ্রহণ করল। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পারছিল একটি পর্যায়ে এসে তাদের স্বার্থ আর ভালোভাবে রক্ষিত হচ্ছে না, কারণ আরব বিশ্বের জনগণের মধ্যে আমেরিকাবিরোধী মনোভাব জেগে উঠতে শুরু করছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কায়রো ভাষণে মিসরের পরিবর্তনের কথা বললেন। কারণ মনে রাখতে হবে, ওবামা নিজেই পরিবর্তনের স্লোগান নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। তিনি কায়রো ভাষণের এক জায়গায় বললেন, মিসরের জনগণের যে আকাঙ্ক্ষা তার সঙ্গে তার (ওবামার) আ@ি@@@ক সমর্থন আছে। এটা তিনি বললেন, কারণ তিনি বুঝতে পারছিলেন আরব বিশ্বে দিন দিন আমেরিকাবিরোধী মনোভাব ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছিল। আর এ মনোভাব আরব বিশ্বে প্রকট রূপে দেখা দিল যখন বিশ্বমন্দার ঢেউ গিয়ে লাগল। এর ফলে পশ্চিমা দেশগুলোই কিন্তু বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলো এবং আরব বিশ্বের তেলকে সামনে রেখে পেট্রোডলারকেন্দ্রিক যে স্বপ্ন অনেকের ছিল তা ভেঙে গেল।
আমরা দেখলাম, মন্দার কারণে তিউনিশিয়ায় অসন্তোষ বেড়ে গেল এবং ২৩ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা বেন আলীকে জনগণ সৌদি আরবে পালাতে বাধ্য করল। এ অসন্তোষ শুধু মিসরে নয়, ছড়িয়ে গেল জর্দান, ইয়েমেন, সিরিয়াসহ পুরো আরব বিশ্বে। কারণ সেসব জনগণ দেখল তিউনিসিয়ার বিক্ষোভে সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করেনি, বেন আলী বা সেই রাষ্ট্রকাঠামোকে সমর্থন করেনি যুক্তরাষ্ট্র। তখন তারা বুঝতে পারল, জনগণ যদি ঐক্যবদ্ধভাবে চেষ্টা চালায়, তবে আরব বিশ্বে যে অবস্থা বিরাজ করছে তার পরিবর্তন আনা সম্ভব। এই উদাহরণটা মিসর বা কায়রোতে খুব কাজে দিয়েছে। কারণ জনগণ দেখল, হোসনি মুবারকও ৩০ বছর ধরে ক্ষমতায় আছেন, মিসরেও গণতন্ত্রের প্রচণ্ড অভাব এবং বিশ্বমন্দার প্রভাব পড়েছে। তাই তিউনিসিয়া থেকে মিসর এই শিক্ষাটিই নিল যে, কায়রোর তাহরির স্কয়ারে যদি তারা ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন চালিয়ে যায়, তবে বেন আলীর মতো হোসনি মুবারককেও বিতারিত করা সম্ভব এবং সামরিক বাহিনীও তখন মাঝামাঝি অবস্থান নেবে। ঠিক তা-ই ঘটল। টানা ১০-১২ দিনের বিক্ষোভের মুখে হোসনি মোবারক বলতে বাধ্য হলেন, আগামী সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি দাঁড়াচ্ছেন না। কিন্তু যখন তিনি এ ঘোষণা দিলেন, তখন জনগণ মনে করল, এই ঘোষণার অনেক দেরি হয়ে গেছে এবং হোসনি মুবারকের এই আশ্বাসটিও খুবই সামান্য। একটা হিসাবে দেখা যায়, এ আন্দোলনে তিন শ বা তার চেয়ে বেশি লোক মারা গেছে। তাই জনগণ মনে করছে, হোসনি মুবারককে বিশ্বাস করা যায় না, তাঁকে এই মুহূর্তে পদত্যাগ করতে হবে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে, কায়রোতে যে বিপ্লবতুল্য আন্দোলন ঘটছে, এর বিপক্ষে গিয়ে যদি তারা পুরোপুরি হোসনি মুবারকের পক্ষাবলম্বন করে, তবে তাদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে।
এখন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যেহেতু বেশ কিছু সময় আছে, তাই তারা (যুক্তরাষ্ট্র) পরোক্ষভাবে বলল, হোসনি মুবারক যদি এখনই চলে যান, তো ভালো কথা। সে ক্ষেত্রে একটি ট্রানজিশনাল সরকার যেন থাকে।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, মিসরের পরিস্থিতি এমন এক বিন্দুতে এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে হোসনি মুবারকের ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়াটা অবশ্যম্ভাবী। সেপ্টেম্বরে যাবেন না আগে যাবেন, তা নিয়ে এখন দরকষাকষি চলছে। এই দরকষাকষির মধ্যে বিশেষ করে মুসলিম ব্রাদারহুডকে আমরা দেখতে পাচ্ছি। যদিও একসময় তাদের ব্যান্ড করা হয়েছিল, তবু তাদেরকেই ডাকা হচ্ছে সমঝোতায় বসতে। বরাবরই কিন্তু মুসলিম ব্রাদারহুড বলে আসছিল, যতক্ষণ পর্যন্ত হোসনি মুবারক পদত্যাগ না করছেন, ততক্ষণ তারা কোনো নেগোসিয়েশনে যাবে না। কিন্তু রবিবার শোনা গেল, তারা আলোচনার প্রস্তাব মেনে নিয়েছে।
এখানে বলে রাখি, হোসনি মুবারক নির্বাচনে দাঁড়াবেন না_এটা যেমন বলেছেন, তেমনি ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওমর সুলাইমানকেও নিয়োগ দিয়েছেন। আশা করা যাচ্ছে, ট্রানজিশন বিষয়ে সুলাইমানের একটা বড় ভূমিকা থাকবে। সুলাইমানের ডাকে ব্রাদারহুড আলোচনায় বসতে রাজি হয়েছে। বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন, আলোচনায় বসার জন্য, পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য ব্রাদারহুডের ওপর আরব বিশ্বের অন্যান্য দেশের চাপ রয়েছে। কারণ বেন আলীর মতো যদি মুবারককেও বিদায় নিতে হয়, তবে অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদেরও টিকে থাকাটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। এ ধরনের বিক্ষোভ এখন পর্যন্ত প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ হলেও রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে যে তা ঘটবে না, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ এরই মধ্যে জর্দানে আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে।
মিসরের উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে মুসলিম ব্রাদারহুড স্বাভাবিকভাবেই একটা ঝুঁকি নিয়েছে। এখন বোঝা যাবে, তাদের (ব্রাদারহুড) কাঠামোতে তারা কতখানি লাভবান হয়। মিসরে সেক্যুলার সিভিল সোসাইটি বলতে গেলে নেই, যা আছে সেটা মূলত ধর্মভিত্তিক সিভিল সোসাইটি; বিশেষ করে মসজিদ, মাদ্রাসা_এ ধরনের সিভিল সোসাইটি রয়েছে। আর এসব পরিমণ্ডলে ব্রাদারহুডের সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক আছে। এই সাংগঠনিক নেটওয়ার্কটা নির্বাচনের সময় হয়তো তাদের কাজে দেবে, তারা হয়তো লাভবান হতে পারে। কিন্তু একই সঙ্গে ব্রাদারহুড এই যে ঝুঁকিটি নিল, তাতে অন্য পার্টি বা এমন অনেক ব্যক্তির কথা আমরা শুনছি, যেমন এল বারাদির কথা। এই আলোচনা থেকে তাঁদের মধ্যে কে বা কারা শেষ পর্যন্ত লাভবান হবেন তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে বোঝা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রও চাইছে পরিস্থিতিটা যেন সামাল দেওয়া যায় এবং পরিবর্তনটা যেন একটু ধীরগতিতে হয়, যাতে করে তাদের স্বার্থটাও রক্ষা হবে আবার মুবারকও বিদায় নেবেন।
অন্যদিকে মনে রাখতে হবে, এরই মধ্যে মুসলিম ব্রাদারহুডের কাঠামোর ভেতরেও কিন্তু বড় ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। এখন তারা গণতন্ত্র এমনকি বহুদলীয় গণতন্ত্রেও বিশ্বাস করে। জনগণের দাবি বা আকাঙ্ক্ষার কথা মাথায় রেখে ব্রাদারহুড এমন কিছু করবে না, যাতে করে গণতান্ত্রিক কাঠামো দুর্বল হয়ে যায়।
এখন ইসরায়েল সম্পর্কে যা বলা যায় তা হলো, যেসব কারণে ইসরায়েল এত দিন পার পেয়ে যাচ্ছিল, তার সঙ্গে কিন্তু হোসনি মুবারকের এক ধরনের সম্পর্ক ছিল। মিসরে যদি গণতন্ত্র আসে, তার চাপ কিন্তু ইসরায়েলের ওপর পড়বে। তখন তারা কোনো না কোনো উপায়ে ফিলিস্তিনের সঙ্গে মীমাংসা করতে বাধ্য হবে। এই যে তারা বছরের পর বছর পার পেয়ে যাচ্ছে কোনো সমঝোতা না করে, তার পেছনে হোসনি মুবারকের স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো জড়িত ছিল। কারণ তার (মুবারক) সঙ্গে আবার যুক্তরাষ্ট্রের সুসম্পর্ক। তাই অন্য কথায় বলা যেতে পারে, মিসরের গণতন্ত্র ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গড়ার ব্যাপারটিকে ত্বরান্বিত ও সহায়তা করবে।
অন্যদিকে মনে রাখতে হবে, এ পরিস্থিতি থেকে ইরানও একটা সুযোগ নেবে; কারণ মিসরের সাথে ইরানের সম্পর্ক কখনোই ভালো ছিল না। তবে বিপ্লবের পরে ইরান যে রাষ্ট্রকাঠামো তৈরি করেছে তার সঙ্গে মিসরের জনগণের আকাঙ্ক্ষার কোনো মিল নেই। কারণ মিসরের বিপ্লব একটি পার্টির অধীনে হচ্ছে না, কিন্তু ইরানে খামিনির চিন্তাধারার ওপর ভিত্তি করেই বিপ্লব হয়েছিল। মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুডও এই অন্তর্বর্তী সময়ে সব পার্টির সমন্বয়ে ন্যাশনাল কোয়ালিশনের কথা বলছে। এখানে এককভাবে কিন্তু ব্রাদারহুড উঠে আসছে না। আর পুরো আন্দোলনটাই যে তারা করেছে সে দাবিও করতে পারছে না। ইরানের সঙ্গে মিসরের আরেকটি মৌলিক পার্থক্য আছে শিয়া-সুনি্নর বিষয়ে। সে হিসেবে মিসরীয়রা ততক্ষণই ইরানের সমর্থনকে গ্রহণ করবে, যতক্ষণ তা গণতন্ত্রের পক্ষে হয়।
মিসরে যখন লাখ লাখ লোক রাস্তায় নামল, তখনই যুক্তরাষ্ট্র এ আন্দোলনকে সমর্থন বা মিসরের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে শুরু করল, তার আগে নয়। উপায় না পেয়েই যুক্তরাষ্ট্রের এই হস্তক্ষেপ। অথচ মুবারককে তো তারাই এত বছর ধরে ক্ষমতায় রেখেছে। যখন যুক্তরাষ্ট্র বুঝে ফেলল মুবারকের সময় ফুরিয়ে এসেছে, তখনই তাঁকে চলে যাওয়ার কথা বলতে শুরু করল। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা হলো।
এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের লাভ-ক্ষতির বিষয়ে বলতে হয়, স্বল্পমেয়াদে বাংলাদেশের ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ মিসরে অনেক বাংলাদেশি শ্রমিক রয়েছেন। মিসরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেমে যাওয়ার ফলে তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, যার কিছুটা প্রভাব পড়বে বাংলাদেশে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশ লাভবান হবে, যদি আরব বিশ্বে গণতন্ত্র আসে। কারণ অনেকেই মনে করেন, সেখানে যেসব প্রবাসী শ্রমিক থাকেন, তাঁদের তেমন কোনো মানবাধিকার নেই, নাগরিক অধিকার নেই, তাঁরা পরিবার নিয়ে সেখানে যেতে পারেন না। এই যে কতগুলো কাঠামো তৈরি হয়ে গেছে স্বৈরতন্ত্রের কারণে, গণতন্ত্র সত্যিকার অর্থে প্রতিষ্ঠিত হলে তা আর থাকবে না।
এতে কোনো সন্দেহ নেই, কায়রোতে যদি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে আরব বিশ্বেই তার প্রভাব পড়বে। কারণ আরব বিশ্বে মিসরকে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক রাজধানী বলা হয়। তাই এখানে যদি সত্যিকার অর্থেই গণতন্ত্র আসে, তবে তা আরব বিশ্বে ছড়াতে বাধ্য। এটা গভীরভাবে লক্ষ করার বিষয় যে, কিভাবে এর সমাধান হচ্ছে। কেননা আরব বিশ্বের গণতন্ত্রের সঙ্গে আমাদের গণতন্ত্রও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারণ আমাদের প্রচুর প্রবাসী শ্রমিক আরব বিশ্বে রয়েছেন। আরব বিশ্বে গণতন্ত্র শক্তিশালী হলে বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশ্বে তা ভালো মডেল হিসেবে দেখা দেবে।
ইমতিয়াজ আহমেদ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক।

0 comments:

Post a Comment

 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. XNews2X - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু