Home » , , » আত্মজীবনীর পাণ্ডুলিপি থেকে

আত্মজীবনীর পাণ্ডুলিপি থেকে

Written By Unknown on Monday, February 7, 2011 | 2:42 AM

মর একুশে গ্রন্থমেলা-২০১১তে প্রকাশিত হবে কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের আত্মজীবনীর দ্বিতীয় অংশ 'উঁকি দিয়ে দিগন্ত'। বইটি প্রকাশ করেছে ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ। প্রচ্ছদ করেছেন সমর মজুমদার। বইটির দাম রাখা হয়েছে ২৪০ টাকা। ইত্তেফাক সাময়িকীর পাঠকদের জন্য এখানে বইটির চুম্বক অংশটুকু ছাপা হলো।

বলা আমাকে মাটিতে নামিয়েছে কি নামায়নি, ঝড়ের মতো দাশুমাস্টার এসে ঘরে ঢুকলেন। ঠিকমতো আলোগুলো জ্বালানো হয়নি। কোনো দিকে না চেয়ে দাশুমাস্টার বললেন, এই, তোরা দু-ভাই আমার সঙ্গে আয়। আর তোরা সব সোজা বাড়ি চলে যা।

আমাদের হারিকেনের বাতি একদম কমানো। মাস্টারমশাইয়ের পিছু পিছু আমরা দু-ভাই হাঁটছি। চাঁদ নেই, অন্ধকারটা চোখে সয়ে আসছে। কাত্যায়নী ঠাকরানির মাটির বাড়িটা এদিকের শেষ হিঁদুবাড়ি। ঠাকরানি বহুদিন দেশছাড়া, বাড়িটা ফাঁকা পড়ে আছে। ওই বাড়ির পরেই খোনা ফকিরের দোকানের পাশ দিয়ে শিবতলার দিকে যাওয়ার গলিরাস্তাটা, তার পরেই মোসলমানপাড়ার শুরু আর শুরুতেই আমাদের ফাঁকা নতুন বাড়ি। এই বাড়িটা বাবা কিনেছিলেন বিনোদবাবুর কাছ থেকে। সেজন্য এখনো ওটা বিনোদবাবুর বাড়ি। আমরা পুরনো বাড়িতেই থাকি। এ বাড়িটা পড়ে আছে খালি। একটা পেয়ারা গাছ, দু-কোণে দুটো ডুমুরগাছ। গাধাপুইনি, কাঁটানটে আর ঘাসেভরা বাড়িটা। কাছে আসতেই দেখি দেয়াল ঘেঁষে ঠিক কোণের কাছটায় অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মানুষগুলোকে আবছা দেখা যাচ্ছে। কারা আছে, কে আছে বোঝার উপায় নেই। একজন একটু কাছে এগিয়ে এল, দেখলাম শ্রীধর কাকা, তার হাতে একটা পাঁঠা কাটার টাঙি। একবার যেন মনে হল, খোনা ফকিরের বড় ছেলে শঙ্করীদা আর বোধহয় আগুরিদের বেন্দাবনদাকে দেখলাম। সবারই হাতে কিছু-না-কিছু আছে, লাঠি, হুড়কো, বগি_এইসব।

একজন হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, কে যায়, মোলস্নাদের ছেলে দুটি? দাশুমাস্টার কথা বলে উঠলেন। গলা নয় যেন শানানো ইস্পাত, খবরদার, আমার ছাত্তর ওরা। আমি ওদের বাড়িতে পেঁৗছে দিয়ে আসি।ঃএইখানেই ওদের ছেড়ে দাও মাস্টার, আর এগিয়ো না। মোচনরা সব ওদের আস্তানায় জড়ো হয়েছে।ঃসে আমি দেখছি, দাশুমাস্টার বললেন।

শুকনোর দিনে ধুলোভরা রাস্তায় পা ডুবে যাচ্ছে। এইটুকু রাস্তা, মনে হচ্ছে অনেক দূর। আস্তানায় এসে দেখি সারা মোসলমানপাড়ার মানুষ সেখানে জড়ো হয়েছে। একদিকে রাস্তার ইটের ভাঙা মিনার, তার মাথায় পাকুড়গাছের চারা আর একদিকে ফাঁকা উঠোনের মতো জায়গা। সেখানে আমরা হা-ডু-ডু, হিঙেডারি খেলি, মাদার মহররম সব সেখানেই শুরু হয়। জায়গাটা এখন মানুষে ভরা। সবার হাতেই বাঁশ, লাঠি, একটা-দুটো কিরিচ। লাঠিওয়ালারাই বেশি। মোসলমানপাড়ার বাকি নেই কেউ; শুধু বাবা, নাজিরবক্স চাচার বুড়ো বাপ_এরকম কয়েকজন নেই। এমনকি লতিফ চাচার মতো আধবয়েসি মানুষটাও কোঁচরভর্তি কি কি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দাশুমাস্টার একেবারে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে বললেন, এই শোনো তোমরা, মোলস্নাবাড়ির ছেলে এই দুটি আমার কাছে পড়তে যায়। ওদের দিয়ে গেলাম। কেউ কোনো কথা বলল না। যা, এখানে দাঁড়াস না, বাড়ি চলে যা, এই বলে মাস্টারমশাই নিজের বাড়ির দিকে ফিরলেন। কেউ একটি কথাও বলল না। ধুলোভরা সাদা অাঁধারে দাশুমাস্টার একবারে মিলিয়ে গেলে একজন বলে উঠল, কপাল ভালো মাস্টারের, ভালোয় ভালোয় ফিরে গেল!

মনে হল, মোসলমানপাড়ার সবাই এসেছে। তবে মোটমাট ক-টাই বা লোক? সবসুদ্ধ এক শ' হয় কি না! লাঠি ঠুকতে ঠুকতে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে মলিস্নকবাড়ির ফকির চাচা। তার ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে খুব খারাপ একটা পচা ঘা। ওই ঘা বহুকাল ধরে শুকোয়নি। পানসে রক্ত গড়িয়ে পড়ে সেখান থেকে। হাড়-মাংস খসে পড়েছে, আঙুলটার আর সামান্যই বাকি। লোকে বলে কুঠ্ হয়েছে। খোঁড়াতে খোঁড়াতে কাছে এসে আমাকে দেখে বলল, কি বলব বাপ, আলস্না মেরে রেখেছে, নাইলে ওই কটা হিঁদু মালাউনকে এক লাপটেই সাবড়ে দেতম। লতিফ চাচা কোঁচড়ে কি নিয়ে যেন ঘুরছে, একজন বলল, বালি, সামনা সামনি হলেই হিঁদুগুনোর চোখে বালি ছুঁড়ে একদম কানা করে দেওয়া হবে, তারপর পিটিয়ে, ঠেঙিয়ে কিংবা কুপিয়ে কুপিয়ে মারো কেন আরাম করে। শুনলাম খবর দেওয়া হয়েছে সেই লেঠেলদের গাঁ ধারসোনায়, আসছে তারা সব। অবশ্যি হিঁদুরাও তাদের হিঁদু-গাঁ ক্ষীরগাঁয়ে খবর দিয়েছে। ভয়-পেদো হিঁদুরা আসবে কি-না কে জানে। মোসলমানপাড়া ঢোকার মোড়ে মোড়ে আড়াআড়ি করে গরু-মোষের গাড়ি রেখে দেওয়া হয়েছে। ওইসব পেরিয়ে আসতে আসতেই তাদের খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারা হবে। ভারি মজা! গাঁয়ে শুধু হিঁদু আর মোসলমানরা আছে! ওহিদ চাচা, বঁ্যাক চাচা, ননু কাকা, ভুতো কাকা, মোবাই শেখ, মনবশ চাচা, ষষ্ঠীদা, পঞ্চাদা, পঞ্চা হাড়ি, চক্কোবত্তি মশাই, আশু ভশ্চায্যি, রাম সামন্ত_এরা কেউ নেই। কোনোদিন ছিলও না। শুধু হিঁদু আর মোসলমান আছে!

পণ্ডিতমশাই বলে গেলেন, আগে বাড়ি যা, কোথাও দাঁড়াবি না। এতক্ষণ আমরা দু-ভাই বোকার মতো ঘোরাঘুরি করছিলাম, শেখদের বাড়ির নাছ-দুয়োরের পাশের গলি দিয়ে বাড়ি যাব, শুনতে পেলাম, ও-বাড়ির একটা ঘর থেকে কে যেন চেঁচিয়ে মেদিনী ফাটাচ্ছে। দুয়োর খুলে দে, খুলে দে বলছি, এই মা, হারামজাদি, দুয়োর খোল্, মালাউনের বংশ রাখব না, একবার ছেড়ে দে খালি। খুলবি না? এই ভাঙলম দুয়োর! দুমদাম শব্দ আসতে লাগল। ঘরে কিবরিয়া আটক আছে। ও কেমন খেপা সবাই জানে, মহররম খেলতে গিয়ে মানুষ খুন করার জোগাড় করে, মাদার নাচাতে গিয়ে একেকটা বাড়ি লণ্ডভণ্ড করে দেয়। ও ছাড়া থাকলে এতক্ষণে রক্তগঙ্গা বয়ে যেত।

ভাত দেওয়ার সময় ফুফু একটি কথা বলেনি। আমরা সবাই মাথা নিচু করে খাচ্ছিলাম। রাত খুব তাড়াতাড়ি নিশুতি হয়ে যাচ্ছিল বলেই বোধহয় আস্তানা আর বিনোদবাবুর বাড়ির কোণ থেকে হলস্না-চিৎকার অনেক স্পষ্ট শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল। এমনকি দু-চারটে কথাও শোনা যাচ্ছিল। ভাতঘর থেকে বেরিয়ে কোনো চাচাকেও দেখতে পেলাম না। জানি না কেউ কেউ আস্তানায় গিয়েছে কিনা।

ঘরে আজ অন্ধকার নীল ফোঁটাটা নেই। আলোই জ্বলছিল। বাবা বিছানার ওপর বসে। মা-ও ঘরে। দেয়ালে একনলা বন্দুকটা ঠেস দিয়ে রাখা, ফ্লুট বাঁশিটা একই জায়গায় রয়েছে, ভেসিলিন-মাখানো খাঁড়াটাও দেয়ালে টাঙানো। বাবা মাকেই বলছিলেন, সন্ধেবেলায় ওবেদ শেখ তার দলিজে বসে ছিল। মোসলমানপাড়া থেকে হিঁদুপাড়ার দিকে গরুর গাড়ি যাওয়ার রাস্তা সে বন্ধ করে দেবে। ওর গোয়ালের একদিকের কোণের দেয়াল গাড়ির চাকার ধাক্কা লেগে বারবার ভাঙছে বলে সে ওপথে গাড়িই যেতে দেবে না। দেয়ালের কোণে একটা খুঁটো পুঁতে দিলেই তো দেয়াল বাঁচে! ক-বার নাকি তেমন খুঁটো পুঁতেছিল, কারা উপড়ে দিয়েছে। সে তাই রাগ করে একটা খুঁটো দিয়েছে দেয়ালের কোণে আরেকটা রাস্তার ঠিক মাঝখানে। এটা সে করতে পারে না, সরকারি রাস্তা তো তুমি বন্ধ করতে পার না! এদিকে রামযুক্ত হাজরার গরুর গাড়ি আসছিল কয়লাটয়লা নিয়ে। হিঁদুপাড়ার রাস্তায় কাদা, সে মোসলমানপাড়া দিয়ে যাবে। রাস্তার খুঁটো দেখে তার মেজাজ খারাপ। ওবেদ তো বসেই ছিল দলিজে, রামযুক্তটা গোঁয়ার, সে তাকে কোনো কথা না বলে রাস্তার মাঝখানের খুঁটোটা উপড়ে ফেলল। বেশ, তাই কর্, খুঁটোটা উপড়ে ফেলে চলে যা, তা না, সে দেয়ালের কোণের খুঁটোটাও তুলে ফেলে দিল। ওবেদ নিজে উঠে এসে রামযুক্তর ঘাড় চেপে ধরল, রামযুক্ত, এই তোর গাড়ি আটকে দেলাম। দেখি তুই কেমন বাপের ব্যাটা, গাড়ি নিয়ে যা দেখি। বোধহয় কিবরিয়া আশেপাশে ছিল, সে এক ছুটে এসে রামযুক্তের গলা ধরে ঝুলে পড়েছে। লেগে গেল ঝটাপটি। রামযুক্ত আমার সঙ্গে যাত্রায় সং-এর পার্ট করত, আমি জানি তার গায়ে খুব বল। এক ঝটকায় কিবরিয়াকে ঝেড়ে ফেলে সে শুধু বললে, গাড়ি যেতে দিবি না? গাড়ি যেতে দিবি না? এই থাকল গাড়ি, যাচ্ছি আমি। শালার নেড়ের খুব বাড় বেড়েছে। শালাদের পাড়া জ্বালিয়ে দোব আজ। এই বলে গাড়ি ওইখানেই রেখে রামযুক্ত চলে গেল। এখন গাড়ি মাঝখানে_এদিকে মোসলমানরা, ওদিকে হিঁদুরা। আমি জানি একটা কিছু ঘটবেই। বাতাসভরা বিষ। নিঃশ্বাস সবাইকেই নিতে হচ্ছে। বিষ ঢুকবে না?

0 comments:

Post a Comment

 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. XNews2X - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু