জঙ্গিবাদ- আল-কায়েদার বিপদবার্তা by মশিউল আলম

Friday, February 21, 2014

আল-কায়েদার নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরির নামে ইন্টারনেটে প্রচারিত অডিও বার্তাটি সত্যিই জাওয়াহিরির বলে দাবি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যাপনারত বাংলাদেশি নিরাপত্তা বিশ্লেষক তাজ হাশমি।
গতকাল ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার-এ প্রকাশিত এক উপসম্পাদকীয় নিবন্ধে তিনি দাবি করেছেন, জাওয়াহিরির কণ্ঠস্বর তিনি চেনেন, তাঁর মিসরীয় উচ্চারণে বলা আরবি ভাষার বক্তৃতাটি তিনি ‘প্রায় নিশ্চিত’ভাবে শনাক্ত করতে পেরেছেন।

ওসামা বিন লাদেন নিহত হওয়ার পর তাঁর নেপথ্যের প্রধান ব্যক্তি মিসরীয় শল্যচিকিৎসক জাওয়াহিরি ছিন্নভিন্ন আল-কায়েদার হাল ধরেছেন, এমন খবর শোনা যায়। কিন্তু তিনি এখন কোন দেশে কী অবস্থায় আছেন, সে সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। ধারণা করা হয়, তিনি বহু বছর ধরে লুকিয়ে আছেন পাকিস্তান-আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী উপজাতীয় এলাকায়। লাদেন পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ শহরের এক বাড়িতে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় আমেরিকান সেনাদের আক্রমণে নিহত হওয়ার পর তাঁর জীবনের শেষ কয়েক বছরের জীবনযাপন সম্পর্কে যেসব তথ্য জানা যায়, তাতে দেখা যাচ্ছে মুঠোফোন, ইন্টারনেট, টেলিভিশন ইত্যাদি আধুনিক প্রযুক্তি থেকে লাদেন নিজেকে বিযুক্ত করেছিলেন। তিনি তাঁর অনুসারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন শুধু চিঠি-চিরকুটের মাধ্যমে, যেগুলো সশরীরে বহন করতেন তাঁর অতি বিশ্বস্ত দুই সহোদর। সম্ভবত জাওয়াহিরিও এখন একই ধরনের প্রযুক্তিহীন, বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করছেন। (সিআইএ আফগানিস্তান, পাকিস্তানসহ অন্যত্র ড্রোন হামলা চালিয়ে যেসব জঙ্গিকে হত্যা করেছে, তাদের অনেকেই মারা পড়েছেন মুঠোফোন ব্যবহার করার কারণে) তবে বক্তৃতা অডিও বা ভিডিও টেপে ধারণ করে হাতে হাতে তা স্থানান্তর এবং অবশেষে কোনো একটি স্থান থেকে তা ইন্টারনেটে আপলোড করা তাঁর লোকজনের পক্ষে সম্ভব। অবশ্য সে ক্ষেত্রেও ঝুঁকি থেকে যায়: আমেরিকান গোয়েন্দাদের পক্ষে প্রযুক্তিগতভাবে বের করা সম্ভব যে কম্পিউটার থেকে তা ইন্টারনেটে আপলোড করা হয়েছে তার ভৌগোলিক অবস্থান শনাক্ত করা।
তা সত্ত্বেও জাওয়াহিরির নামে অডিও বা ভিডিও বার্তা প্রচারের খবর প্রায়ই শোনা যায়। ২০১১ সালের ২ মে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ শহরে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় আমেরিকান সেনাদের আক্রমণে ওসামা বিন লাদেন নিহত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত জাওয়াহিরির অন্তত ১২টি বার্তা প্রচারের খবর পাওয়া যায় (অধিকাংশই অডিও)। সর্বশেষ মিসরের সামরিক বাহিনী মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা প্রেসিডেন্ট মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর তাঁর একটি অডিও বার্তা ইন্টারনেটে পাওয়া যায়, যেটিতে তিনি মিসরীয় সামরিক বাহিনীর কঠোর সমালোচনা করেন। এর আগে সিরিয়া, ইরাক, সোমালিয়া, পাকিস্তানসহ মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেও তাঁর অডিও বা ভিডিও বার্তা ইন্টারনেটে প্রচারিত হয়েছে।
এসব বিবেচনায় বাংলাদেশ নিয়ে জাওয়াহিরির কথিত অডিও বার্তাটি সম্পর্কে অধ্যাপক তাজ হাশমির নিশ্চয়তা বোধগম্য। কিন্তু বার্তাটি সত্যিই তাঁর কি না—এ প্রশ্নের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য এর তাৎপর্য। সংগঠন হিসেবে আল-কায়েদা এখন আর আগের মতো সংগঠিত নয়, বরং একটি ভাবাদর্শ হিসেবেই এটি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ইসলামপন্থী জঙ্গিদের উদ্বুদ্ধ করে চলেছে। বাংলাদেশে ২০০৭ সালের পর থেকে জঙ্গি তৎপরতা দৃশ্যমান নয়। তার আগে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে জামাআতুল মুজাহিদীন, হরকাতুল জিহাদ ইত্যাদি জঙ্গিগোষ্ঠীর যেসব সক্রিয় তৎপরতা লক্ষ করা গেছে, সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তারা আর সে রকম তৎপরতা প্রকাশ্যে চালাতে পারেনি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বাংলাদেশে ইসলামি জঙ্গিবাদের প্রভাব ক্রমেই কমেছে। আমেরিকা ও ভারত আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ দমনে মহাজোট সরকারের কাছে বেশ সহযোগিতা পেয়ে এসেছে। ফলে এখন বাংলাদেশে ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো চরম কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছে।
কিন্তু তার অর্থ এটা নয় যে ইসলামি জঙ্গিবাদ বাংলাদেশে নির্মূল হয়ে গেছে। আল-কায়েদা, পাকিস্তান-আফগানিস্তানের তালেবান, লস্কর-ই-তাইয়েবা কিংবা ভারতভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে তাদের গোপন যোগাযোগ হয়তো এখন আর আগের মতো নেই; কিন্তু স্থানীয়ভাবে তাদের কর্মকাণ্ড যে সচল রয়েছে, অন্তত তারা যে জঙ্গি বা জিহাদি ভাবাদর্শ প্রচারের কাজে নিয়োজিত আছে, তার কিছু কিছু আলামত মাঝেমধ্যেই পাওয়া যায়। শাহবাগ আন্দোলনের সময় ব্লগার রাজীব হত্যার ঘটনার মধ্য দিয়েও ইসলামি জঙ্গি ভাবাদর্শ নিয়ে কর্মরত কিছু কিছু গোষ্ঠীর অস্তিত্ব প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া ইন্টারনেটের বিভিন্ন ব্লগ বা সাইট থেকেও এটা বোঝা যায় যে ইসলামি জঙ্গিবাদী তৎপরতার ভাবাদর্শগত ক্ষেত্রটি এ দেশে নেহাত ছোট নয়। জাওয়াহিরির অডিও বার্তাটি ইন্টারনেটে প্রচারের দায়ে রাসেল বিন সাত্তার নামে যে তরুণকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের ভাষ্য অনুযায়ী, তাঁর কাছ থেকেও বেশ কিছু পরিমাণ জিহাদি প্রচারণা উপকরণ জব্দ করা হয়েছে। আর জাওয়াহিরির কথিত অডিও বার্তাটি, যার শিরোনাম ‘বাংলাদেশ: ম্যাসাকার বিহাইন্ড আ ওয়াল সাইলেন্স’, তার বক্তব্য থেকেও বোঝা যায়, জাওয়াহিরি বাংলাদেশে ‘ইসলামবিরোধী’দের বিরুদ্ধে ‘ইন্তিফাদা’ বা প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন যাদের প্রতি, তারা এ দেশে বিলক্ষণ রয়ে গেছে। অডিও বার্তার তাৎপর্য এটাই যে সেসব জঙ্গিগোষ্ঠী এককাট্টা সুসংগঠিত না হয়েও আয়মান আল-জাওয়াহিরির আহ্বানে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিচ্ছিন্নভাবেও সক্রিয়তা দেখাতে পারে।
তবে বাংলাদেশ সরকার যেমনটি বলেছে, তারা এই বার্তায় উদ্বিগ্ন হয়নি, তা যদি এ কারণে হয় যে জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীগুলোর ব্যাপারে সরকার যথেষ্ট মাত্রায় সতর্ক আছে, কেবল তাহলেই স্বস্তি বোধ করা যায়। অন্যথায় এই উদ্বেগহীনতা মর্মান্তিক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। শেখ হাসিনার সরকারকে ইসলামবিরোধী, নাস্তিক ইত্যাদি বলে প্রচার করার প্রবল তৎপরতা ইন্টারনেট জগতে লক্ষ করা যায়। শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে ইসলামি জঙ্গিদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু অনেক আগে থেকেই। উপরন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ড কার্যকর করে পুরো প্রক্রিয়াটি নিষ্পন্ন করার কাজ এখনো বাকি রয়ে গেছে।
কিন্তু জাওয়াহিরির এই অডিও বার্তা নিয়ে সরকারের লোকজনের কণ্ঠে যেসব রাজনৈতিক কথাবার্তা উচ্চারিত হচ্ছে, বিশেষত বিএনপি, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে আল-কায়েদা বা জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িয়ে যেসব কথা বলা হচ্ছে, তার ফলে সরকারের ওপর মানুষের আস্থা কমে যেতে পারে। অন্যদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টায় যেসব কথা বলা হচ্ছে, তাতে বিএনপির প্রতিও মানুষের সন্দেহ বাড়তে পারে। আল-কায়েদা কিংবা ইসলামি জঙ্গিবাদ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি রাজনীতি করতে চাইলে যে ঘোলাটে পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে, তাতে লাভ হবে কেবল জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোরই।
আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীগুলো অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তির দ্বারাও ব্যবহূত হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় রাষ্ট্রীয় সংস্থার গোপন সহযোগিতায় ইসলামি জঙ্গিদের তৎপরতা বৃদ্ধির বিষয়টি ইতিমধ্যে সুবিদিত। এমনকি ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়েও সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার কোনো কোনো কর্মকর্তা ‘হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ’ (হুজিবি) নামে তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসবাদী সংগঠনকে সহযোগিতা করেছেন, এমনকি রাজনৈতিক বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন—এমন তথ্য পাওয়া যায় আমেরিকান কূটনৈতিক দলিলে। জরুরি অবস্থায় যখন সব ধরনের রাজনৈতিক কার্যকলাপ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, সেই সময় জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন ডেকে রাজনৈতিক দল (ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি—আইডিপি) গঠনের ঘোষণা দিতে পেরেছিল হুজিবি।
এখন সে অবস্থা নেই বলেই মনে হয়। শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বে গত পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদী তৎপরতা দৃশ্যমান না হওয়ার একটি বড় কারণ হয়তো এটাও। এ দেশে আফগানিস্তান-পাকিস্তানের মতো সামাজিক সমর্থন ইসলামি জঙ্গিরা পায় না। তাদের পালিয়ে থাকতে হয় শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকেই নয়, সমাজের কাছ থেকেও। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কোনো মহল তাদের ব্যবহার করতে না চাইলে এবং রাষ্ট্রীয় কোনো সংস্থার মধ্যকার কোনো অংশ গোপনে তাদের মদদ না দিলে এ দেশে জঙ্গিদের পক্ষে বড় ধরনের কিছু করা অত্যন্ত কঠিন।


মশিউল আলম
: সাংবাদিক।

বিশেষ সাক্ষাৎকার- আফগানিস্তানে তালেবানের প্রভাব আর নেই: নাজেস আফরোজ by মশিউল আলম ও এ কে এম জাকারিয়া

Tuesday, February 11, 2014

নাজেস আফরোজের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান শহরে, ১৯৫৮ সালে। কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে ১৯৭৯ সালে রসায়নশাস্ত্রে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর এক বছর কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েন। ১৯৮১ সালে কলকাতার দৈনিক আজকাল পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করেন।
১৯৯৮ সালে বিবিসি বাংলা বিভাগে প্রযোজক হিসেবে যোগ দেন। ২০০১ সালে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে কাজ শুরু করেন প্রযোজক হিসেবে। ২০০৬ সালে বিবিসি ওয়ার্ল্ডের সাউথ এশিয়া ব্যুরোর এক্সিকিউটিভ এডিটর হন। ২০১১-১২-তে তিনি এডিটর ইন্টারন্যাশনাল অপারেশন্স-এর দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে লেখালেখি শুরু করেন। নাজেস আফরোজ একজন আফগানিস্তান বিশেষজ্ঞ।

প্রথম আলো  আপনি তো দীর্ঘ সময় ধরে আফগানিস্তানে যাওয়া-আসা করেছেন এবং সাংবাদিক হিসেবে সে দেশের খোঁজখবর রাখেন। দেশটির অবস্থা এখন কেমন?
নাজেস আফরোজ  ২০০১ সালে তালেবানের পতনের পর আফগানিস্তানের যে চেহারা ছিল, এখন তার সঙ্গে আকাশ-পাতাল তফাত।
প্রথম আলো  ভালো না খারাপ?
নাজেস আফরোজ  অনেক ভালো। ২০০২ সালে গোটা কাবুল শহরের যে ভগ্নদশা ছিল, আজকে সেই জায়গাগুলো ঘুরেফিরে দেখলে শহরটাকে চেনাই যায় না। জমির দাম, বাড়িভাড়া অনেক বেড়েছে। অবশ্য এর একটা কারণ, অনেক আন্তর্জাতিক এনজিও সেখানে কাজ করছে, প্রচুর বিদেশি লোক থাকে। এসব কারণে একটা ফলস ইকোনমি তৈরি হয়েছে। কিন্তু সেটাকে যদি বাদও দিই, তবু কাবুলের অনেক উন্নতি হয়েছে। শুধু কাবুল নয়, আমি হেরাত, মাজারে শরিফ, জালালাবাদ, কান্দাহার—যেখানেই গেছি, সবখানেই অনেক উন্নতি চোখে পড়েছে।
কাবুল শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার উত্তরে একটা ছোট্ট গঞ্জমতো আছে চারিকার নামে। চারিকার মানে চৌরাস্তা, চারটি প্রধান সড়ক সেখানে মিলিত হয়েছে। ২০০৩ সালে সেই চারিকারে দেখেছিলাম খুব দীন দশা, দু-চারটি দোকানপাট ছাড়া আর তেমন কিছু ছিল না। প্রায় ১০ বছর বাদে আমি আবার সেই চারিকারে গেলাম। দেখলাম, গমগম করছে প্রাণবন্ত একটা শহর। বোঝা গেল যে অর্থনীতির চাকা ঘুরছে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্য দেখতে পাবেন। চাষবাস হচ্ছে।
প্রথম আলো  নিরাপত্তা পরিস্থিতি কেমন?
নাজেস আফরোজ  নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে, এ কারণে যেকোনো জায়গায় যেকোনো সময় আক্রমণ হতে পারে। কিন্তু সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় সেটার প্রতিফলন একদমই চোখে পড়ে না। কারণ, তালেবান ও অন্যান্য বিদ্রোহী, জঙ্গিগোষ্ঠী আক্রমণ চালায় সরকারি লোকজন ও স্থাপনার ওপর এবং বিদেশিদের ওপর। সাধারণ মানুষ তাদের আক্রমণের শিকার হয় না। সেই কারণে নিরাপত্তার উদ্বেগটা সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে দৃশ্যমান নয়।
প্রথম আলো  কিন্তু আমরা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে আফগানিস্তানের যে চিত্র পাই, সেটা তো একেবারেই উল্টো।
নাজেস আফরোজ  আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের হয়ে কাজ করতে যাঁরা আফগানিস্তানে যান, তাঁদের বেশির ভাগই ইউরোপ-আমেরিকার মানুষ। গায়ের রঙেই তাঁদের আলাদা করে চেনা যায়। তাঁদের যাতায়াতের ওপর অনেক বিধিনিষেধ থাকে, তাঁদের প্রতিষ্ঠানই সেটা তাঁদের নিরাপত্তার স্বার্থে করে। আমি নিজেও বিবিসিতে কাজ করার সময় সেটা দেখেছি। তাঁরা যদি রাস্তাঘাটে না বেরোন, গ্রামগঞ্জে না যান, তাহলে প্রকৃত চিত্রটা পাবেন কী করে? সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় যে নিরাপত্তাহীনতার প্রভাব পড়ছে না, সেটা তো তাঁদের দেখতে হবে। বছর দেড়েক আগে আমি আমার আফগান বন্ধু-সহকর্মীর বাড়িতে গিয়ে থেকেছি—মাজারে শরিফে। সেখান থেকে একটা ছোট্ট ভাঙা গাড়িতে করে বাল্ক শহর পর্যন্ত গেছি, সেখানে রাস্তার মধ্যে ছবি তুলেছি। আমার সহকর্মীরা গাড়িতে করে মাজারে শরিফ চলে যায়, ১২ ঘণ্টা লাগে। অবশ্য কান্দাহারের সড়কটা নিরাপদ নয়; এ রকম আরও কিছু রাস্তা আছে, যেগুলো নিরাপদ নয়। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে আফগানিস্তান নিয়ে যাঁরা লেখেন, তাঁদের সিংহভাগই পশ্চিমা; সেখানে তাঁদের জীবনের নিরাপত্তার শঙ্কাটা খুব বেশি। সেই শঙ্কা তাঁদের লেখালেখিতে প্রতিফলিত হয়।
প্রথম আলো  আফগানিস্তান থেকে ন্যাটোর সেনাবাহিনী এ বছর চলে গেলে দেশটিতে আবার তালেবান ফিরে আসতে পারে বলে উদ্বেগের খবর আমরা পাই। আপনার কী মনে হয়?
নাজেস আফরোজ  তিন ধরনের সম্ভাবনা আছে। একটা হচ্ছে, এই সরকারের পতন ঘটবে, তালেবান ক্ষমতা নিয়ে নেবে। দুই নম্বর হচ্ছে, আলোচনা হবে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে। আফগানিস্তানের পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তিন নম্বর হচ্ছে, একটা মাঝামাঝি অবস্থা থাকবে। অর্থাৎ, একটা সরকার থাকবে এবং মাঝারি থেকে নিম্ন মাত্রায় বিদ্রোহ চলতে থাকবে। আমার ধারণা, এই শেষের সম্ভাবনাটাই বেশি।
প্রথম আলো  সে অবস্থায় বাইরের শক্তিগুলোর ভূমিকা কেমন হতে পারে? বিশেষত পাকিস্তানের?
নাজেস আফরোজ  আফগানরা মনে করে, পাকিস্তানের ভূমিকা নেতিবাচক; তাদের কাছে পাকিস্তানের প্রভাব, তাদের উপস্থিতি কাম্য নয়। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে অভিজাত পর্যন্ত, গোত্রনির্বিশেষে আফগানিস্তানের সব মানুষ এটা মনে করে। আর পাকিস্তান যে আফগানিস্তানে প্রভাব রাখতে চায়, সেটা খুব পরিষ্কার। পাকিস্তান খোলাখুলি সেটা বলেছেও। পাকিস্তানের আশঙ্কা হচ্ছে, আফগানিস্তানে ভারতীয় প্রভাব খুব বেশি। ভারত খুব বুদ্ধি করে সেখানে প্রভাব বাড়িয়েছে। ভারত আফগানিস্তানের পঞ্চম বৃহত্তম দ্বিপক্ষীয় দাতাদেশ। ভারত আফগানিস্তানকে দুই বিলিয়ন ডলার দিয়েছে; রাস্তা, স্কুল, হাসপাতাল বানিয়েছে, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন বানিয়ে দিচ্ছে, চিশত শহরের কাছে একটা বড় হাইড্রোইলেকট্রিক বাঁধ তৈরি করছে। আফগান পার্লামেন্টের নতুন ভবন তৈরির পুরো ব্যয় দিয়েছে ভারতীয় সরকার। এখন আফগান সরকার ভারতের কাছে সামরিক সাহায্য চাইছে। এটা পাকিস্তানকে ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন করেছে। আর পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি ঠিক করে তার সেনাবাহিনী, যার অনেক বড় বড় অফিসার একাত্তর সালকে ভুলতে পারেননি। এমনিতেই পাকিস্তানের পূর্ব সীমান্তে ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা আছে, কাশ্মীর নিয়ে তারা কিছু করতে পারেনি। এর ওপর আফগানিস্তানে যদি ভারতের প্রভাব বাড়ে এবং সামরিক সহযোগিতাও যুক্ত হয়—এটা নিয়ে তারা ভীষণ উদ্বিগ্ন।
প্রথম আলো  আমেরিকার ভূমিকাও তো নেতিবাচক হতে পারে। কারণ, আমরা দেখেছি, আফগান সরকারকে এড়িয়ে তারা তালেবানের সঙ্গে আলোচনা করেছে।
নাজেস আফরোজ  আমার ধারণা, আমেরিকানরা খুব ভেবেচিন্তে তালেবানের সঙ্গে কথা বলেছে, তা নয়। আফগানিস্তান বা ইরাকের যুদ্ধ আমেরিকার জনগণের কাছে ভীষণ অজনপ্রিয় হয়ে গেছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের মতো অত সেনা মারা না গেলেও গত ১২ বছরে চার-পাঁচ হাজার সেনা মারা গেছে, আট-দশ হাজার আহত হয়েছে, প্রচুর টাকা ব্যয় হচ্ছে। এর মধ্যে ২০০৮ সাল থেকে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ ছিল। ফলে, এ প্রশ্ন আমেরিকার ভেতরেই উঠছে যে আমরা ওখানে কী করছি? আবার সব ছেড়েছুড়ে চলেও যেতে পারছে না, কারণ তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে আফগানিস্তানে তারা একটা স্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করে দিয়ে যাবে। সে জন্য তারা সব পক্ষকে নিয়ে আলোচনা করে একটা শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সম্প্রতি তারা কাতারে তালেবানের সঙ্গে আলোচনা করেছে। আমেরিকানরা আশা করেছিল, তালেবান অন্তত তিনটি জিনিস করবে: আফগানিস্তানে যে সংবিধান তৈরি করা হয়েছে, সেটি মেনে নেবে, হামিদ কারজাইয়ের সরকারকে স্বীকৃতি দেবে এবং তালেবান বলবে যে আফগানিস্তানের ভূমিতে তারা কোনো সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীকে জায়গা দেবে না। কিন্তু তালেবান এই তিনটির কোনোটিতেই রাজি হয়নি। সে জন্য আমেরিকার সঙ্গে তালেবানের আলোচনা ভেঙে গেছে।
প্রথম আলো  সামাজিক দিক থেকে আফগানিস্তানে গত ১০-১২ বছরে আপনি কী ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করেছেন?
নাজেস আফরোজ  পরিবর্তন হচ্ছে খুব ধীরে। কিন্তু পরিবর্তন হচ্ছে। যারা লেখাপড়া করছে, তাদের মধ্যে নতুন ভাবনাচিন্তা আছে। প্রায় ৫০ লাখ আফগান বহু বছর শরণার্থী হিসেবে অন্যান্য দেশে বাস করেছে, তারা এখন ফিরে আসছে। কিছু নতুন ভাবনা তারাও নিয়ে আসছে। কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫০ হাজার ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করে, তাদের মধ্যে ৩০ শতাংশ মেয়ে। হেরাত খুবই ছোট শহর, সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী মেয়ে। আফগানিস্তানে আট-দশটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও আছে বেশ কয়েকটা। কাবুল শহরে কারদান ইউনিভার্সিটি নামে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে ১০ হাজার ছাত্রছাত্রী। তাদের অনেকে পেশাজীবী; সারা দিন কাজ করে, রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করে। ফলে, সামাজিক দিক থেকেও পরিবর্তন আসছে।
প্রথম আলো  সমাজে, সাধারণ মানুষের মধ্যে তালেবানের প্রভাব কেমন?
নাজেস আফরোজ  ১৯৯৪ সালের দিকে তালেবান যখন আসে, যখন জনগণ তাদের সমর্থন করেছিল। কিন্তু আজকে তাদের প্রতি সমর্থন ১ শতাংশও নেই। যেসব জায়গা তারা এখনো নিয়ন্ত্রণ করে, সেগুলোতে তাদের অস্ত্র হচ্ছে ভীতি। ১৯৯৪ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবান জনসাধারণের ওপর যে অকথ্য অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়েছে, সেটা মানুষের মনে গভীর ছাপ ফেলেছে। এ কারণে একটা আতঙ্ক এখনো রয়ে গেছে। কিন্তু তালেবানের প্রভাব তেমন নেই। মানুষের মন থেকে ভীতিটা কেটে গেলে তালেবানের মিথ ভেঙে যাবে। গণতন্ত্র ও ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা তৈরি হলে তালেবানের ভীতিটা দূর হবে। গজনি শহর ও উত্তরের কয়েকটা জায়গায় স্থানীয় জনগণ তালেবানের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে; মেরে বের করে দিয়েছে। আফগানিস্তানের লোকসংখ্যা তিন কোটি, এর ১ শতাংশও যদি তালেবানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, তালেবানের কিছু করার থাকবে না।
প্রথম আলো  আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
নাজেস আফরোজ  ধন্যবাদ।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মশিউল আলম ও এ কে এম জাকারিয়া

সন্ত্রাস- ছাত্রলীগের ‘আত্মরক্ষা’ ও নিষ্ক্রিয় আইন by মশিউল আলম

Saturday, February 8, 2014

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রতিক সহিংসতায় ‘যতজনের হাতে অস্ত্র দেখা গেছে, তারা সবাই ছাত্রলীগের নয়’—প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে এই কথা বলেছেন।
এর মানে দৃশ্যমান অস্ত্রধারীদের কয়েকজন ছাত্রলীগের। তাহলে ছাত্রলীগের এই অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে কী আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে? প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘ছাত্রলীগের যারা, আমরা তাদের বহিষ্কার করেছি। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’ বহিষ্কার মানে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার। এটা রাষ্ট্রের কোনো আইনি পদক্ষেপ নয়, সাংগঠনিক ব্যবস্থামাত্র। তাঁরা যে ফৌজদারি অপরাধ করেছেন, সে বিবেচনায় এটি নিতান্তই এক লঘু পদক্ষেপ, যা লোক দেখানো বলে কেউ ধরে নিলে তাকে দোষ দেওয়া যাবে না। তা ছাড়া আমরা জেনেছি, বহিষ্কৃত হয়েছেন সেদিনের অস্ত্রধারীদের মধ্য থেকে মাত্র দুজন। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে অন্তত ছয়জন অস্ত্রধারীর ছবি ছাপা হয়েছে, যাঁরা ছাত্রলীগের নেতা। বাকি চারজনকে কেন বহিষ্কার করা হয়নি? তাঁদের বিরুদ্ধে আদৌ কোনো পদক্ষেপ কি নেওয়া হয়েছে?

ছাত্রলীগের অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে ‘আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে’—প্রধানমন্ত্রীর এই উক্তি তথ্য না আশ্বাস, তা আমরা জানি না। কিন্তু কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার খবর এখনো পাওয়া যায়নি। বরং যাঁদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাঁরা কেউই ছাত্রলীগের নন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে যে চারটি মামলা দায়ের করা হয়েছে, সেগুলোর কোনোটিতেই ছাত্রলীগের অস্ত্রধারী কোনো নেতাকে আসামি করা হয়নি। আসামি করা হয়েছে ছাত্র ফেডারেশন, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন প্রভৃতি ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের, যাঁরা প্রগতিশীল ছাত্রজোটের ব্যানারে বর্ধিত ফি ও সন্ধ্যাকালীন মাস্টার্স কোর্স বন্ধ করার দাবিতে আন্দোলন করছেন।
আর ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীদের আসামি করা হয়েছে—এটা কোনো খবর নয়। কারণ, এটা যে করা হবে, তা আগে থেকেই সবার জানা। মামলা দায়েরের আগেই সরকারের একাধিক নেতা সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, গোলাগুলি করেছেন আন্দোলনকারীদের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা শিবিরের কর্মীরা। কিন্তু রহস্যজনক ব্যাপার হলো শিবিরের কোনো অস্ত্রধারীর ছবি কেউ তুলতে পারেনি। এমনকি আন্দোলনকারী সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ কোনো অস্ত্রধারী শিবিরের কর্মীকে দেখেছেন, এ রকম খবরও পাওয়া যায়নি। শিবিরের কর্মীরা সম্ভবত নিজেদের অদৃশ্য রেখে অস্ত্রচালনার কায়দা রপ্ত করেছেন কিংবা তাঁরা এমন মন্ত্র জানেন, যা পড়ে ফুঁ দিয়ে তাঁরা ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ফোটাবেন কিন্তু কেউ তাঁদের দেখতে পাবে না। শুধু অ্যাকশনের সময় অদৃশ্য থাকা কেন? অ্যাকশন শেষ করার পরও তাঁরা বেমালুম গায়েব হয়ে যাওয়ার কায়দা জানেন। নইলে পুলিশ তাঁদের একজনকেও গ্রেপ্তার করতে পারল না কেন? শিবির কি ছাত্রলীগ যে আইনের হাত তাঁদের স্পর্শ করার হিম্মত রাখে না?
না, ছাত্রলীগের কেউ অপরাধ করলে আইন তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না—এমন সাধারণীকরণ সঠিক নয়। দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের বিচারে ছাত্রলীগের ২২ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা তিনি বলেছেন। আদালতের রায়ে ১৪ জনের ফাঁসির রায়ের সংবাদ ইতিমধ্যে সুবিদিত এবং প্রশংসিত। কিন্তু স্মরণ না করে পারা যায় না যে বিশ্বজিতের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বাঁচানোর চেষ্টা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, হত্যাকারীদের কেউই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী নন। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরও বলেছিলেন একই ধরনের কথা। কিন্তু হত্যাদৃশ্যের ভিডিও ফুটেজ সম্প্রচারমাধ্যমে বারবার প্রচার, পুরো সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা এবং দেশব্যাপী ধিক্কার উঠেছিল। জনমতের প্রবল চাপের ফলে ঘটনার দুদিন পর কোতোয়ালি থানার পুলিশ ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় আট ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছিল এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেছিলেন যে তাঁরা বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার আসামি। কিন্তু ওই দিনই ঢাকা মহানগরের পুলিশ কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের বলেন, বিশ্বজিৎ হত্যার ঘটনায় পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করেনি, যাঁদের গ্রেপ্তারের কথা বলা হচ্ছে তাঁরা কেউ বিশ্বজিৎ হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। এ রকম কেলেঙ্কারির মধ্য দিয়ে পরস্ফুিট হয়েছিল একটিই বিষয়: সরকার বিশ্বজিৎ হত্যাকারী ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের আইনের আওতায় নিতে চায় না, পার পাইয়ে দিতে চায়। ওই নৃশংস হত্যাকাণ্ড নিয়ে সংবাদমাধ্যম দিনের পর দিন লেগে না থাকলে যে বিচার শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেছে, তা পাওয়া যেত কি না সন্দেহ।
কিন্তু সে জন্য বিশ্বজিৎ হত্যার বিচার করার জন্য সরকারের যে ধন্যবাদ ও প্রশংসা প্রাপ্য তা অস্বীকার করা যায় না। ধন্যবাদ আমরা দিয়েছি, প্রশংসা করতেও কার্পণ্য করিনি। এবং আমরা চাই আইন প্রয়োগের এই দৃষ্টান্ত বিরল ব্যতিক্রম হিসেবে না থেকে যেন সরকারের সাধারণ প্রবণতা হয়ে ওঠে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের ১৬ জনকে হত্যা করা হয়েছে, ছাত্রলীগের ছেলেরা সেখানে যেতে পারে না, তাদের রগ কেটে দেওয়া হয়—প্রধানমন্ত্রীর এসব অভিযোগের প্রতিকার করার দায়িত্ব সরকারের, আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের, ছাত্রলীগের নয়।
প্রধানমন্ত্রী সংসদে প্রশ্ন তুলেছেন, ‘আমাদের ছেলেদের কি জীবন বাঁচাবার অধিকার নেই?’ সরকারপ্রধানের কণ্ঠে এমন কথা উচ্চারিত হলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আগ্নেয়াস্ত্র বহন ও ব্যবহারে আরও উৎসাহিত হবেন। এমন কথা তিনি এর আগেও বলেছেন। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী এবার এ কথাও বলেছেন, ‘তবু সন্ত্রাসী সন্ত্রাসীই, সন্ত্রাসীদের বরদাশত করা হবে না।’ কিন্তু তার পরেই আবার ‘আত্মরক্ষার অধিকার সবার আছে’—এ কথাও বলেছেন। ফলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের কাছে এই বার্তা পৌঁছে যেতে পারে যে ‘আত্মরক্ষার্থে’ আগ্নেয়াস্ত্র বহন ও ব্যবহার করার পক্ষে খোদ প্রধানমন্ত্রীর সায় আছে।
কিন্তু ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আগ্নেয়াস্ত্র বহন ও ব্যবহার করলে ছাত্রশিবিরের সঙ্গে তাঁদের পার্থক্য থাকে না। ইসলামী ছাত্রশিবির সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালায় বলে সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি ক্রমেই প্রবলতর হয়েছে। তারা তাদের রগকাটা কুখ্যাতি অতিক্রম করে পেশাদার দুর্বৃত্তদের মতো চোরাগোপ্তা হামলাকারী গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। বিশেষত গত এক বছরে জামায়াত-শিবিরের ব্যাপক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড তাদের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। তাদের ব্যাপারে আপত্তি শুধু দেশের ভেতরে সীমাবদ্ধ নেই, আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোও তাদের প্রতি প্রচণ্ড নাখোশ। জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে তাদের প্রধান অভিযোগ ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিয়ে নয়, বরং তাদের সন্ত্রাসী তৎপরতা নিয়ে।
সন্ত্রাসের কারণে ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করার দাবি তুললে একই কারণে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিও যুক্তি পেয়ে যায়। কিন্তু কার যুক্তি কে মানবে, কে মানে এই দেশে? সন্ত্রাসী আচরণের কারণে ছাত্রলীগকে ছাত্রশিবিরের সঙ্গে তুলনা করলে তার প্রতিবাদে এই যুক্তি উত্থাপন করা হতে পারে যে ছাত্রলীগ আক্রমণ করে না, আত্মরক্ষার তাগিদে প্রতিক্রিয়া করে মাত্র। আত্মরক্ষার অধিকার তো ছাত্রলীগেরও আছে। কিন্তু ছাত্রলীগের অভিভাবক দল আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে বলে আত্মরক্ষা কিংবা যে প্রয়োজনেই হোক, ছাত্রলীগ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারসহ সহিংসতায় লিপ্ত হলে সরকারের এমন বেকায়দা হয় যে মন্ত্রীরা দিশাহারা হয়ে অসত্য-অর্ধসত্য কথা বলেন। সংবাদমাধ্যম সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে। এভাবে ছাত্রলীগ গত পাঁচ বছরে অজস্রবার সরকারকে ভীষণ বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। কিন্তু সরকার এটা সহ্য করে কেন?
‘সন্ত্রাসী সন্ত্রাসীই, সন্ত্রাসীদের বরদাশত করা হবে না’—প্রধানমন্ত্রীর এই উক্তি আন্তরিক হলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সেদিন যে ছয় অস্ত্রধারী ছাত্রলীগের নেতাকে দেখা গেছে, যাঁদের সশস্ত্র ছবি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তাঁদের প্রত্যেককে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করা হোক। তাঁদের আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখে এক গন্ডা মামলা দায়ের করে শত শত শিক্ষার্থীর গায়ে ফৌজদারি আসামির ছাপ্পড় মেরে দেওয়া কোনো কাজের কথা নয়। আর ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরাই যদি সব সন্ত্রাসের হোতা হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁদের একজনকেও পুলিশ এখন পর্যন্ত অস্ত্র-বিস্ফোরকসহ পাকড়াও করতে পারল না কেন, এই প্রশ্নেরও জবাব পাওয়া দরকার।
শান্তিপূর্ণভাবে যাঁরা আন্দোলন করছেন তাঁদের মামলার আসামি করা ঠিক হয়নি, বাম ধারার ছাত্রসংগঠন করা আইনের দৃষ্টিতে কোনো অপরাধ নয়, আসামির তালিকা থেকে তাঁদের নাম বাদ দেওয়া উচিত। শত শত শিক্ষার্থীকে আসামি করে তাঁদের মাথার ওপর একাধিক ফৌজদারি মামলা ঝুলিয়ে রাখলে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা কাটবে না, পড়াশোনার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরবে না। কিন্তু এখনকার প্রধান বিবেচনা হওয়া উচিত, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিয়ে স্বাভাবিক শিক্ষাজীবনে ফিরতে হবে।

মশিউল আলম: সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক।
 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. XNews2X - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু