Home » , » লিভারের যত অসুখ by ডা. জিয়াউল হক

লিভারের যত অসুখ by ডা. জিয়াউল হক

Written By Unknown on Tuesday, January 11, 2011 | 10:32 AM

লিভারের কিছু রোগ বংশগত, কিছু অ্যাকোয়ার্ড বা অর্জিত। কিছু রোগ স্বল্পস্থায়ী যা চিকিৎসায় পুরোপুরি ভালো হয়ে যায়, কিছু রোগ দীর্ঘস্থায়ী, যা চিকিৎসা সত্ত্বেও ভালো হয় না এবং প্রাণহানি ঘটায়।
সাধারণত লিভারের যেসব রোগ হয় তা হলো_১. ভাইরাল হেপাটাইটিস (যা জন্ডিস নামে পরিচিত), ২. লিভার সিরোসিস, ৩. লিভার ক্যান্সার, ৪. লিভারের ফোঁড়া, ৫. লিভারের জন্মগত ও মেটাবলিক রোগ ইত্যাদি।
তবে অসুখ হলেই লক্ষণ প্রকাশ পায় না লিভারের রোগের ক্ষেত্রে যেমনটি অন্য অঙ্গের রোগে দেখা যায়। কারণ লিভারের ১১ ভাগের এক ভাগও যদি ভালো থাকে, তবুও লক্ষণ প্রকাশ না-ও পেতে পারে।

হেপাটাইটিস
হেপাটাইটিস (যকৃতের প্রদাহ), যা সাধারণের মধ্যে জন্ডিস নামে অধিক পরিচিত। ভাইরাস সংক্রমণসহ নানা কারণে এটি হয়ে থাকে। তবে আমাদের দেশে ব্যাপকহারে যে জন্ডিস দেখা যায়, তা ভাইরাসঘটিত। এই ভাইরাসের মধ্যে রয়েছে হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি এবং ই। এর মধ্যে এ ও ই পানি এবং খাদ্যবাহিত ভাইরাস; বি, সি ও ডি রক্ত কিংবা দূষিত সিরিঞ্জ সুচের মাধ্যমে বাহিত হয়। ই-ভাইরাস রক্তের মাধ্যমেও ছড়ায়।
লক্ষণ
দূষিত পানি কিংবা খাদ্যবস্তু গ্রহণের দুই থেকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে হেপাটাইটিস এ এবং ই দ্বারা আক্রান্ত হলে লক্ষণ প্রকাশ পায়। অপরদিকে হেপাটাইটিস বি এবং সি রোগের লক্ষণ দূষিত রক্ত কিংবা সিরিঞ্জের মাধ্যমে রোগ সংক্রমিত হওয়ার চার থেকে ছয় মাসের মধ্যে প্রকাশ হয়। অনেক ক্ষেত্রে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস রোগীর দেহে বাহক হিসেবে সুপ্ত থাকে। রোগের লক্ষণ দেখে পরীক্ষা ছাড়া বোঝার উপায় নেই কোন ভাইরাস হয়েছে। জন্ডিসের অন্যতম লক্ষণ হলো_হঠাৎ করে বমি বমি ভাব কিংবা তীব্র বমি হওয়া, দুর্বলতা এবং অবসাদ, খাদ্য গ্রহণে অরুচি, অনীহা কিংবা তীব্র দুর্বলতা, শরীর চুলকানো ইত্যাদি। কখনো জ্বর জ্বর ভাব বা জ্বরের মাধ্যমেও রোগের সূত্রপাত হতে পারে। এমনকি পায়ে এবং পেটে পানিও আসতে পারে।
রোগ নির্ণয়
রক্ত পরীক্ষা করে কোন জীবাণুর অ্যান্টিজন বা অ্যান্টিবডি আছে তা জানা যায়। হেপাটাইটিস-বি নির্ণয়ের জন্য রক্তকে এইচবি সারফেস অ্যান্টিজেনের (HBsAg) জন্য টেস্ট করতে হয়। সংক্রমণের ছয় থেকে ১২ সপ্তাহের মধ্যে রক্তে এই অ্যান্টিজেন দেখা দেয়। টেস্ট পজিটিভ হলে চিকিৎসক আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবেন।
হেপাটাইটিস-সির জন্য প্রথমে চেক করা হবে এইচসিভি অ্যান্টিবডি (anti-HCV)। হেপাটাইটিস-সি অ্যান্টিবডিগুলোর রক্তে আবির্ভূত হতে সংক্রমণের পর সাত থেকে ৯ সপ্তাহ সময় লাগে। প্রথম টেস্ট পজিটিভ হলে আরো টেস্ট করতে হয়। যেমন_এইচসিভি আরএনএ। এটিও পজিটিভ হলে হেপাটাইটিস-সি রয়েছে বুঝতে হবে।
চিকিৎসা
হেপাটাইটিস যত তাড়াতাড়ি শনাক্ত করে চিকিৎসা শুরু করা যায়, ততই লিভারের (যকৃত) বিকলতা এবং মৃত্যুর ঝুঁকি এড়ানো যায়। হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হলে_
- পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে।
- স্বাভাবিক পরিমাণে বিশুদ্ধ পানীয় পান করতে হবে। অ্যালকোহল এড়িয়ে চলতে হবে।
- স্বাভাবিক খাওয়াদাওয়া যেমন_তরিতরকারি, মাছ, মাংস, হলুদ, মরিচ ইত্যাদি খেতে হবে।
- ফল, ডাবের পানি, আখের রস ইত্যাদি খাওয়ানোর প্রয়োজন নেই।
- ঘন ঘন গোসল করানোর প্রয়োজন নেই।
- যকৃতের জন্য ক্ষতিকর ওষুধ বর্জন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, লিভারের কোনো অসুখ হলে বহু ওষুধ এড়িয়ে চলতে হয়। তাই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খাওয়া চলবে না।
- দীর্ঘ সময়ব্যাপী এবং দেহের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে এমন শরীরচর্চা এড়িয়ে চলতে হবে
- জন্ডিস হওয়ার এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে যদি রোগের লক্ষণ ভালো না হয়, তবে হাসপাতালে নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। তবে জন্ডিস হওয়ার পর কেউ অস্বাভাবিক অস্থির হলে, অস্বাভাবিক আচরণ করলে বা অজ্ঞান হলে অবিলম্বে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।

ক্রনিক হেপাটাইটিস
লিভারের দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহের ফলে যেসব রোগ হয়ে থাকে তাকে ক্রনিক হেপাটাইটিস বলে। বাংলাদেশে ক্রনিক হেপাটাইটিসের প্রধান কারণ হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাস।
রোগী প্রাথমিক অবস্থায় বুঝতেই পারেন না কখন তিনি বি অথবা সি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। চিকিৎসাবিহীন থাকলে এই সংক্রমণ মাসের পর মাস লিভার ক্ষতি করে। এমনকি লিভার সিরোসিসে রূপ নেয় এবং পরে লিভার ক্যান্সারে রূপান্তরিত হতে পারে।

ফ্যাটি লিভার
লিভার কোষে অতিরিক্ত চর্বি জমা হলে (গাঠনিক উপাদানের ৫ থেকে ১০ শতাংশ) তাকে ফ্যাটি লিভার বলে। যখন কোনো মানুষ তার দেহের প্রয়োজনের অতিরিক্ত চর্বি খাবারের সঙ্গে গ্রহণ করে, তখন এ চর্বি ধীরে ধীরে তার কলা বা টিসুতে জমতে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এটি অতিরিক্ত অ্যালকোহল বা মদ্যপানের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু যাঁরা মদ্যপানের সঙ্গে যুক্ত নন, তাঁদেরও এই রোগ হতে পারে।
কারণ
সাধারণত মধ্যবয়সী মহিলাদের দেখা দেয়। স্থূলতা ফ্যাটি লিভারের একটি প্রধান কারণ।
এ ছাড়া ডায়াবেটিস, রক্তে চর্বির মাত্রা বেশি (হাইপার লিপিডেমিয়া), বংশগত, ওষুধ এবং বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য যেমন_মদ বা অ্যালকোহল, স্টেরয়েড, টেট্রাসাইক্লিন এবং কার্বন টেট্রাক্লোরাইড ইত্যাদি কারণে ফ্যাটি লিভার হতে পারে। যাদের ওজন আদর্শ ওজনের ১০ থেকে ৪০ শতাংশ বেশি, তাদের ফ্যাটি লিভার হওয়ার ঝুঁকি বেশি। মুটিয়ে গেলে শিশুদেরও এ রোগ হতে পারে।
লক্ষণ এবং রোগ নির্ণয়
রোগীরা সাধারণত ক্লান্তি, অবসাদ, ওপরের পেটের ডান দিকে ব্যথা নিয়ে ডাক্তারদের কাছে আসেন। পরীক্ষা করলে দেখা যায়, রোগীদের এসজিপিটি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। এদের বিলুরুবিনের মাত্রা স্বাভাবিক থাকে। কারো ক্ষেত্রে দেখা যায়, লিভারে অ্যানজাইমের মাত্রা স্বাভাবিক অথচ লিভারের আল্ট্রাসনোগ্রামে চর্বির মাত্রা বেশি। পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাম, লিভার বায়োপসি পরীক্ষা করলে রোগটি নির্ণয় করা যায়।
ফ্যাটি লিভার প্রতিরোধে যা করতে হবে
- সুষম খাদ্য খেতে হবে, যাতে সম্পৃক্ত চর্বির পরিমাণ অল্প এবং তন্তু বা আঁশজাতীয় খাবারের পরিমাণ বেশি থাকে।
- অতিরিক্ত ওজনের ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে ওজন কমাতে হবে।
- সপ্তাহে অন্তত চারবার ব্যায়াম করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নিয়মিত হাঁটা, সাঁতার কাটা, সাইকেল চালনা, বাগানে কাজ করা ইত্যাদির অভ্যাস করা যেতে পারে।
- মদ বা অ্যালকোহল এড়িয়ে চলতে হবে।
- ওষুধ খাওয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসরণ করতে হবে।

লিভার সিরোসিস
দীর্ঘস্থায়ী লিভারের প্রদাহ বা রোগের কারণে লিভারের গঠন-কাঠামো নষ্ট হয়ে যায়, কোষগুলো মরে যায়। লিভার তার স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারায়। ফাইব্রাস টিসু সে স্থান দখল করে জন্ম দেয় সিরোসিস নামক মারাত্মক রোগ। অনেক ক্ষেত্রেই লিভার সিরোসিস থেকে লিভারে ক্যান্সারও দেখা দিতে পারে।
লক্ষণ
প্রথম দিকে সিরোসিস আক্রান্ত রোগী বহু বছর পর্যন্ত কোনো রকম রোগের লক্ষণ ছাড়াই স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন। পরে দুর্বলতা, সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়া, জ্বর জ্বর ভাব, পেটের ডান পাশে ব্যথা, দাঁতের মাঢ়ি বা নাক দিয়ে রক্ত পড়া, ঘন ঘন পেটের সমস্যা হতে পারে। লিভার সিরোসিস আরো জটিল আকার ধারণ করলে পেটে পানি আসা, জন্ডিস হওয়া, অজ্ঞান হওয়া, রক্তবমি, পায়খানার সঙ্গে রক্ত যাওয়া, পুরুষত্বহীনতা, কিডনি ফেইলিওর, শরীরের যেকোনো জায়গা থেকে অনিয়ন্ত্রিত রক্তপাত, লিভার ক্যান্সার হতে পারে।
লিভার সিরোসিসের কারণ
উপমহাদেশে প্রধান কারণ হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস আর এর পরই রয়েছে ফ্যাটি লিভার। ইউরোপ ও আমেরিকায় সিরোসিসের প্রধান কারণ অ্যালকোহল ও হেপাটাইটিস-সি ভাইরাস। ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত প্রায় ৩০ শতাংশ রোগী পরে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়।
রোগ নির্ণয়
রক্তস্বল্পতা, রক্ত জমাট বাঁধার অস্বাভাবিকতা, যকৃতে বেশি পরিমাণে জৈব রসায়ন, বেশি বিলুরুবিন, কম সিরাম অ্যালবুমিন ইত্যাদি সমস্যা ধরা পড়তে পারে। সিরোসিস সম্পর্কে নিশ্চিত পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাম, যকৃতের বায়োপসি করতে হয়।
প্রতিরোধে যা করতে হবে
- হেপাটাইটিস বি ও সি সংক্রমণ ঝুঁকি কমাতে হবে।
- আন্তশিরা ওষুধ ব্যবহার পরিহার অথবা পরিষ্কার সুচ ব্যবহার করা এবং অন্য সরঞ্জাম কখনোই অন্যের সঙ্গে ভাগ করে ব্যবহার না করা।
- মদ্যপান করবেন না।
লিভারকে বলা হয় শরীরের পাওয়ার হাউস। তাই লিভারের অসুস্থতার ফলাফল ক্ষেত্রবিশেষে হতে পারে ব্যাপক ও ভয়াবহ। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ নিরাময় এবং জটিলতামুক্ত থাকা যায়। লিভার সুস্থ রাখতে আপনার সচেতনতাই আসলে সবচেয়ে বড় চিকিৎসা।

0 comments:

Post a Comment

 
Support : Dhumketo ধূমকেতু | NewsCtg.Com | KUTUBDIA @ কুতুবদিয়া | eBlog
Copyright © 2013. XNews2X - All Rights Reserved
Template Created by Nejam Kutubi Published by Darianagar Publications
Proudly powered by Dhumketo ধূমকেতু